ভোট বাজারের ঝুমলা

ম্যাক্সিম গোর্কি একবার প্যারিসে গেছেন। লেখক মানুষ।  আলাপ করছেন নানাজনের সঙ্গে। পরিচয় হল, এক অন্যরকম মানুষের সঙ্গে। কথা হল। এইরকম ধরনে।
কী করেন?
ট্রেনে বাসে ট্রামে উঠি। লোকজনকে বিরক্ত করি। পারলে মেয়েদের অস্থানে-কুস্থানে হাত দিই।
সেকি? এসব করলে তো লোকে আপনাকে মারবে!
ধুর মশাই, মার খেলেই তো লাভ। চড় থাপ্পড় দিলে সাতদিনের বাড়তি বেতন।
ম্যাক্সিম গোর্কি বিরক্ত।  কী পাগলের  পাল্লায় পড়েছেন। তবু জানার খাতিরে কথা চালালেন।
চড়, থাপ্পড় কী মশাই, দিনে দুপুরে এসব করলে তো লোকে হাত পা ভেঙে দেবে।
শুনে লোকটি উত্তেজিত। ‘হাত পা ভেঙে দিলেই তো পোয়াবারো। ছ’মাসের বাড়তি বেতন। ডাবল ইনক্রিমেন্ট।  বউ বা ছেলের চাকরি।  বিনা ইন্টারভিউয়ে।’
ম্যাক্সিম গোর্কি খুবই বিরক্ত। তবু জানার আগ্রহ।
আপনার নয় মহিলাদের উত্যক্ত করে লাভ। কিন্তু যাঁরা টাকা দেন আপনাদের তাঁদের কী লাভ?
এবার লোকটি ক্ষিপ্ত।
‘মশাই দিন-দুনিয়ার খবর কিছুই রাখেন না। দুনিয়া চলে কমিশনে। ওরা কমিশন পান।
কমিশনটা কে দেয় শুনি? তাঁদের কী স্বার্থ?
কমিশন দেয় বড় বড় শিল্পপতি আর রাজনীতিক বা মন্ত্রীর দল। তারা যে সব বড় বড় কেচ্ছা যথা কর ফাঁকি, দুর্নীতি, প্রতিশ্রুতিভঙ্গ, ফেরেব্বাজি করে বেড়ায় তা নিয়ে যাতে লোকে আলোচনা না করে, তার জন্য আমার মতো লোকদের আর কাগজের লোকদের গোপনে পোষে। যাতে আমরা ছোটখাটো কেচ্ছা ঘটাই আর লোকে এবং কাগজে সে নিয়ে মশগুল থাকে। বড় বড় কেচ্ছাগুলো, জনগনের আসল সমস্যাগুলো ধামাচাপা পড়ে যায়।
লোকটি তাঁর কথার সপক্ষে আইডেন্টিটি কার্ডও দেখাল। ২৯৯৯।
এ রকম আর কত গোপন ও প্রকাশ্য কেচ্ছা-দালাল আছে সে জানা নাকি যিশুরও অসাধ্য।

মন্দির মসজিদ, তাজমহল, গোমাংস, ধর্মান্তরকরণ, ভাগাড়, পাতালকাহিনী-এসব ফরাসি কেচ্ছা দালালের সম্প্রসারিত রূপ।
তাতে সর্বশেষ সংযোজন: আলিগড়ে জিন্নার ছবি।
আর এইসব ঘটছে, বলা ভালো ঘটানো হচ্ছে-পরিকল্পনা করে, হিসেব করে।
লক্ষ্য, ভোটে মেরুকরণ।
একটা ভোট আসে।
বাজারে ‘এও এক লতুন হৌল’-বলিয়া তৈলমর্দনকারী কেচ্ছা কোম্পানিগুলি ঝাঁপিয়ে পড়ে।
দেশে ক্ষমতায় আসতে, সংরক্ষণ ঠেকাতে ১৯৮৯ থেকে শুরু হয় রামমন্দির ইস্যু।  তাতে সাফল্য এল। গুজরাতে ২০০২এ ভোটে হার ঠেকাতে দাঙ্গা, আগুন, গণহত্যা। ২০০৪ এ হার। ২০১৪ তে কেন্দ্রে ক্ষমতার তাস হল, যত না ধর্ম তার চেয়ে বেশি বিকাশ, উন্নয়ন, দুর্নীতিহীন সমাজের স্বপ্ন।
বিদেশ থেকে কালো টাকা ফিরবে, ১৫ লাখ টাকা প্রতি অ্যাকাউন্টে, প্রতি খেতে জল, প্রতি হাতে কাজ, সব ঘরে বিদ্যুৎ এবং বছরে দুই কোটি চাকরি। তার সঙ্গে গাল ভরা স্লোগান: সবকা সাথ সবকা বিকাশ।

বিকাশ তো গুজরাতের নির্বাচনে হাফ পাগল। ইভিএম ভর্তি গাড়ি পুনর্গণনার হাত থেকে বাঁচতে উল্টে দিতে হয়েছে। রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, পাঞ্জাব, মহারাষ্ট্র, উত্তর প্রদেশ-যেখানে উপনির্বাচন– সেখানেই পরাজয়।
বাঙালি যেখানে নেই, সেখানে বিজেপির অবস্থা বেশ খারাপ। আপাতত।
দেশভাগের ক্ষত এবং মুসলিমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে যাবে এই বাণী এবং বামপন্থীদের ব্যর্থতা, অপশাসন-এই প্রচারে কিছুটা চিঁড়ে বাংলায় আপাতত ভিজছে। কিন্তু তাতে কর্ণাটকের নির্বাচনী পরাজয় ঠেকানো অসম্ভব। তাই চাই হাতে গরম নতুন ইস্যু।

সেই ইস্যুর নাম দেশভাগ।  হিন্দু-মুসলমান বিদ্বেষ।  এবং তাঁকে উস্কানি দিতে জিন্নাহর ছবি। স্বাধীনতার আগে থেকে আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদে জিন্নাহর ছবি আছে। এর পর উত্তর প্রদেশে একাধিকবার বিজেপি ক্ষমতায় এসেছে। দিল্লিতে নেই নেই করে চারবার। তখন কারও এই সব নিয়ে টনক নড়েনি। কর্ণাটকের ভোটে কোনও বলার মতো কথা নেই। দলিতরা বিদ্রোহী, লিঙ্গায়েতরা বিরুদ্ধে।  টিপু সুলতানকে নিয়ে বিভেদ ও বিদ্বেষমূলক সাম্প্রদায়িক রাজনীতির প্রভাব তত পড়েনি। নোটবন্দি, জিএসটিতে দেশের উন্নয়ন থেমে গেছে।  বাংলাদেশ এখন উন্নয়নশীল দেশ। আর মোদির ভারত এক ধাপ নেমে গেছে। দুর্নীতি, বেকারি, নারী লাঞ্ছনা, সাংবাদিক নিগ্রহ, বিদ্বেষ প্রচার-এই সব বিষয়ে বিশ্বে প্রথম সারিতে ভারত। দেশে তীব্র মন্দা। তথ্য-প্রযুক্তিসহ সব শিল্পে ছাঁটাই। কৃষক আত্মহত্যা বেড়েছে। দলিত ও সংখ্যালঘু হত্যা প্রতিদিনের খবর। ধর্ষণ সীমাহীন।  ১৫ লাখ কারও অ্যাকাউন্টে ঢোকেনি। উল্টে সাত হাজার ধনী ভারতীয় দেশ ছেড়েছে। ব্যাঙ্ক তুলে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে।  ললিত মোদি, নীরব মোদি,  বিজয় মালিয়ার দল ব্যাঙ্কের টাকা খতম করে বিদেশে। মোদির বিদেশ ভ্রমণ এবং বিদ্বেষ প্রচার বেড়েছে। ব্যাঙ্কে সুদ কমেছে, স্বল্প সঞ্চয় এবং ভবিষ্য নিধি বা প্রভিডেন্ট ফান্ডে সুদ কমে গেছে । ১৯৯৮ এ বিজেপি আসার আগে যা ছিল এখন প্রায় তার অর্ধেক। জিনিসের দাম কমানোর কথা ছিল ২৫ শতাংশ। এখন তা বেড়ে গেছে ২০০-৩০০ শতাংশ। অতএব কর্ণাটক জিততে আবার মেরুকরণের রাজনীতি।
জিন্নাহ নিজে নামাজ পড়তেন না, রোছা রাখতেন না, শুয়োরের মাংসে প্রাতরাশ সারতেন-ক্ষমতার রাজনীতির কারণে তার লড়াই।
ভারতে ১৯৪১ জনগণনা অনুযায়ী ন কোটি ৪৪ লাখ মুসলিম ধর্মাবলম্বী ছিলেন। ১৯৪৭ এই সংখ্যা দাঁড়ায় নয় কোটি সত্তর লাখের বেশি।
এঁদের মধ্যে মাত্র চার কোটি ৭৯ লাখ মানুষ পাকিস্তানে যান বা যেতে বাধ্য হন। অর্ধেকের বেশি মানুষ, চার কোটি ৯০ লাখ ভারতে থেকে যান। পাকিস্তান যাননি।
পূর্ববঙ্গের বিপুল মানুষ, সীমান্ত প্রদেশের মানুষ, পাঞ্জাবের মানুষ তো দেশভাগ চাননি। দেশভাগ চেয়েছে হিন্দু মহাসভা, আরএসএস এবং মুসলিমরা লিগ।
তার দায়িত্ব সাধারণ হিন্দু মুসলমানের নয়।
জিন্নাহর ছবি থাকল, না থাকল না তার চেয়ে বড় কথা ভোট।
জিন্নাহ নিয়ে এত আপত্তি হলে আদবানি, যশোবন্ত সিনহাদের বই তো আগে নিষিদ্ধ করতে হবে। কারণ, সেখানে জিন্নার প্রশংসা আছে।  তাঁদের দল থেকে তাড়াতে হবে।
মোদি অমিত শাহের সে হিম্মত আছে তো?

শেষকথা:
জুমলা হচ্ছে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি।
ঝুমলা???
মিথ্যা তৈরি করে বানানো ঝামেলা

(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)

Leave A Reply

Your email address will not be published.