‘বিপ্লব স্পন্দিত বুকে মনে হয় আমিই লেনিন’, সুকান্তর কবিতা-সুদীপ্ত গুপ্তর ছবি, কোঁকড়াঝাড়ে লাল ঝড় দেশে কনিষ্ঠতম প্রার্থী বিরাজ ডেকার

ফেসবুকে তাঁর পেজের বায়োতে অসমিয়া ভাষায় লেখা, ‘পৃথিবীর ঘরে ঘরে যেদিন ফুটবে মুক্তির লাল রঙা ফুল, সেই দিনটির নাম আমি দেব, কমরেড লেনিন।’ তিনি বিরাজ ডেকা। অসমের কোঁকড়াঝাড় লোকসভা আসনে এবার সিপিএম প্রার্থী। দেশের তরুণতমও বটে।

বেঙ্গালুরু দক্ষিণ কেন্দ্রের বিজেপির তরুণ প্রার্থী ২৭ বছর বয়সী তেজস্বী সূর্যকে নিয়ে যখন মহাব্যস্ত সারা দেশের সংবাদমাধ্যম, তখন প্রচারের আলো থেকে শতহস্ত দূরে, লাল ঝাণ্ডা কাঁধে নিজের কাজ করে যাচ্ছেন, দেশের সর্বকনিষ্ঠ প্রার্থী, ২৫ বছরের বিরাজ।
বেঙ্গালুরু থেকে কোঁকড়াঝাড়ের দুরত্ব কত? গুগল বলছে, ২ হাজার ৬০০ কিলোমিটারেরও বেশি। কিন্তু অসমের এই প্রান্তে গেলে মনে হবে, দূরত্বটা বুঝি কয়েক আলোকবর্ষের। ফ্ল্যাশ বাল্বের ঝলকানি নেই, নেই বৈদ্যুতিন সংবাদমাধ্যমের হামলে পড়া কভারেজ। বিরাজকে নিয়ে নেই সোশ্যাল মিডিয়ায় উন্মাদনা। কিন্তু তাতে কী, লাল ঝাণ্ডা হাতে বাড়ি বাড়ি প্রচার করে চলেছেন সদ্য ২৫ এ পা দেওয়া বিরাজ ডেকা। অসমের গোরেশ্বর হাইস্কুল এবং কলেজ পেরিয়ে বোড়োল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েছেন। কলেজ থেকেই এসএফআইয়ের সঙ্গে যুক্ত। সদ্য একটি স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেছেন, তারই মধ্যে নেমে পড়েছেন ভোট-যুদ্ধে।
চোখে মুখে এখনও শিশুসুলভ সারল্য, সিপিএম প্রার্থী বিরাজ প্রচারে তুলে ধরছেন বিজেপির ভাগাভাগির রাজনীতির কথা। ‘সদ্য যুবক থেকে নবতিপর, একেবারে অন্যরকম সাড়া পাচ্ছি’, বলছেন দেশের সবচেয়ে কমবয়সী প্রার্থী বিরাজ। ২০১৪ সালে ভোটের আগে মোদী প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন বছরে ২ কোটি চাকরির, প্রত্যেক ভারতীয়র অ্যাকাউন্টে ১৫ লক্ষ টাকা দেওয়ার। কিন্তু সেই প্রতিশ্রুতির কণামাত্রও পালন করেনি বিজেপি। মানুষ যাতে সেই প্রশ্ন ভুলে থাকে, বিজেপি সেই জন্য জাতীয়তাবাদের ঝড় তুলে ভোটে বাজিমাত করতে চাইছে। আসলে বিজেপি মানুষকে ভাবতে দিতে চায় না, ভোটারদের বোঝাচ্ছেন বিরাজ ডেকা।

তাঁর বাম রাজনীতিতে আসা মায়ের হাত ধরে। বর্তমানে ঘর সামলালেও, একটা সময় এলাকায় দাপিয়ে বাম ছাত্র রাজনীতি করেছেন বিরাজের মা। মায়ের কাছ থেকেই বামপন্থার প্রাথমিক পাঠ তরুণ বিরাজের। স্কুল শিক্ষক বাবা বাম রাজনীতির প্রতি সহানুভূতিশীল হলেও, প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে ছিলেন না। বরং গরিব মানুষের অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে মায়ের লড়াই, অনুপ্রেরণা সদ্য ২৫ এ পা দেওয়া বিরাজের। মায়ের লড়াই বিরাজকে শিখিয়েছে, শত বাধার মুখেও কীভাবে মানুষের অদম্য লড়াই লড়ে যেতে হয়। কীভাবে ছিনিয়ে আনতে হয় মানুষের অধিকার। বোড়োল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের জনপ্রিয় ছাত্রনেতা বিরাজের মূলধন সেটাই। বিরাজকে ভালোবেসে বন্ধুরা তাঁকে পল নামে ডাকে। পল ভোটে লড়ছেন খবর পেয়ে, বিভিন্ন জায়গা থেকে পলের পাশে হাজির তাঁর বন্ধুরাও।
ভোটে লড়তে দরকার প্রচুর টাকা। বেগুসরাইয়ে কানহাইয়া কুমার, রায়গঞ্জে মহম্মদ সেলিম ক্রাউড ফান্ডিংয়ের পথে গিয়েছেন। আপনি কী করবেন? বিরাজ ডেকা বলেন, লড়াইটা কোঁকড়াঝাড় কেন্দ্রের। সেখানকার মানুষ যেভাবে দু’হাত ভরে সমর্থন করে আমার জন্য এগিয়ে আসছেন, তাতে বাইরের সমর্থনের কী প্রয়োজন? কোঁকড়াঝাড়ের মানুষই আমাকে জেতাবেন। আনুষ্ঠানিকভাবে ক্রাউড ফান্ডিংয়ে না গেলেও, প্রচুর মানুষ তাঁর সমর্থনে অর্থ সাহায্য করছেন বলেও জানিয়েছেন বিরাজ। তরুণ এই সিপিএম প্রার্থীর সমর্থনে ত্রিপুরার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী তথা সিপিএম পলিটব্যুরো সদস্য মানিক সরকার এবং বৃন্দা কারাট যাবেন কোঁকড়াঝাড়ে প্রচার করতে।
বিরাজের ফেসবুক পেজে জ্বলজ্বল করছে সুদীপ্ত গুপ্তর ছবি। বিরাজ বলেন, কমরেড সুদীপ্তর স্বপ্নকে সত্যি করতেই আমাদের লড়াই। বেগুসরাই থেকে কোঁকড়াঝাড়, মানুষের এই লড়াইকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াই আমাদের একমাত্র লক্ষ্য। আগুনে ভাষণের পাশাপাশি উদাত্ত কণ্ঠে আবৃত্তি করাতেও বিরাজের নামডাক রয়েছে। ভীষণ প্রিয় সুকান্ত ভট্টাচার্য। আর প্রিয় কবিতা? এক মুহূর্তও না ভেবে বিরাজের উত্তর, ‘লেনিন’। তারপরই উদাত্ত গলায়, ‘লেনিন ভূমিষ্ঠ রক্তে, ক্লীবতার কাছে নেই ঋণ, বিপ্লব স্পন্দিত বুকে মনে হয় আমিই লেনিন।’

Comments are closed.