বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের লেখা নতুন বই ‘নাৎসি জার্মানির জন্ম ও মৃত্যু’তে প্রচুর তথ্যগত ভুল, সাংবাদিক সুমন চট্টোপাধ্যায়ের ফেসবুক পোস্টে বিতর্ক

বামফ্রন্ট সরকারের ৩৪ বছরের যাত্রা নিয়ে দুই পর্বে ‘ফিরে দেখা’ নামে শেষ বই লিখেছিলেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। তারপর শারীরিক অসুস্থতা, চোখের চরম অবনতিতে লেখালেখি থেকে দূরেই ছিলেন বুদ্ধদেববাবু। কিন্তু সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে তাঁর নতুন বই ‘নাৎসি জার্মানির জন্ম ও মৃত্যু’। বইটির প্রকাশনা সংস্থা ন্যাশনাল বুক এজেন্সির তরফে জানানো হয়েছে, বইটির প্রথম সংস্করণ বাজারে আসার তিন দিনের মধ্যেই সব কপি বিক্রি হয়ে গেছে। দীর্ঘ দিনের অসুস্থতা ও ক্ষীণ দৃষ্টি নিয়েও সম্প্রতি বইটি লেখার কাজ শেষ করেছেন বুদ্ধদেববাবু।
কিন্তু বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের লেখা সদ্য প্রকাশিত এই বই নিয়েই এবার শুরু হয়েছে বিতর্ক। বিতর্কের কেন্দ্রে সাংবাদিক এবং ‘এই সময়’ সংবাদপত্রের সম্পাদক সুমন চট্টোপাধ্যায়ের করা একটি ফেসবুক পোস্ট। বৃহস্পতিবার ফেসবুক পোস্টে সুমন চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন, রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর লেখা এই বইতে প্রচুর তথ্যগত ভুল রয়েছে। তিনি লিখেছেন, বইটির সূচনাতে প্রথম কয়েকটি পাতাতেই প্রচুর ভুল রয়েছে। যাতে বোঝা যাচ্ছে স্থান, কাল, পাত্র গুলিয়ে ‘গ’ করা হয়েছে। সুমন চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন, ‘বইটির প্রাক কথনে লেখা হয়েছে সভ্যতার উত্থানের প্রথম যুগের শীর্ষে ছিল ইতালির নবজাগরণ (চতুর্দশ থেকে ষোড়শ শতাব্দী পর্যন্ত)’। সুমনবাবুর প্রশ্ন, এ কী করে হয়! মানব সভ্যতার উত্থানের আদি পর্ব কি তাহলে গ্রিস, রোমের সাধারণ ইতিহাস নয়, একেবারে নবজাগরণ পর্ব? নিজের পোস্টের আর এক জায়গায় সুমনবাবু লিখেছেন, বইতে লেখা হয়েছে, ‘ইতালির নবজাগরেণের পুনরাবির্ভাব ঘটেছিল গ্রিস ও রোমের সভ্যতায় অ্যারিস্টটল, সক্রেটিস প্রমুখের চেষ্টায়।’ সুমনবাবুর প্রশ্ন, ইতিহাস বলছে সক্রেটিস, অ্যারিস্টটল খ্রীষ্ট পূর্ব পঞ্চম শতকের গ্রিক দার্শনিক ছিলেন, তাহলে প্রায় ২১০০ বছর পর তাঁদের আবার পুনর্জন্ম হয়েছিল না কি? একইভাবে কলম্বাস, ভাস্কো ডা গামা, নেপোলিয়ানকে নিয়েও বইটিতে নজরে পড়ার মতো তথ্যগত ভুল রয়েছে বলে নিজের ফেসবুক পেজে লিখেছেন সুমন চট্টোপাধ্যায়।

সুমনবাবুর এই পোস্ট ভাইরাল হতেই তা সোশ্যাল মিডিয়ায় আলোচনার কেন্দ্রে উঠে এসেছে। কেউ কেউ সুমন চট্টোপাধ্যায়ের পোস্টের সমর্থনে লিখেছেন, ‘লেখার সময় হয়তো মন দিয়ে তথ্য যাচাই করেননি বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য।’ কেউ কেউ কটাক্ষের সুরে লিখেছেন, ‘এরকম ঐতিহাসিক ভুল ক্ষমতায় থাকাকালীন বুদ্ধদেববাবুরা অনেক করেছেন।’
কিন্তু বিতর্কের এখানেই শেষ নয়। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর ভুল ধরতে গিয়ে সুমন চট্টোপাধ্যায়ের ফেসবুক পোস্টেও কিছু তথ্যগত ভুল রয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন অনেকে। সুমন চট্টোপাধ্যায়ের দেওয়া তথ্যেরও ভুল ধরে এক ব্যক্তি ফেসবুকেই কমেন্ট করেছেন, ‘অ্যারিস্টটল খ্রীষ্ট পূর্ব পঞ্চম শতকের দার্শনিক ছিলেন না, আরও এক দশক পরের ছিলেন।’ কটাক্ষ উড়ে এসেছে, ভাস্কো ডা গামার জন্ম সালসহ আরও অনেক তথ্য নিজের পোস্টে সুমন চট্টোপাধ্যায়ও ভুল লিখেছেন। জনৈক বিশ্বজিৎ মুখার্জি নামে এক ব্যক্তি সুমনবাবুকে পরামর্শ দিয়েছেন, ‘যদি সত্যিই কিছু ভুল বুদ্ধদেববাবুর বইয়ে লেখা হয়ে থাকে, তবে তা চিঠি লিখে তাঁকে জানাতে, যাতে তা পরবর্তী সংস্করণে শুধরে নেওয়া যায়।’
এবিষয়ে প্রতিক্রিয়া নেওয়ার জন্য, thebengalstory.com এর পক্ষ থেকে ‘এই সময়’ এর সম্পাদক সুমন চট্টোপাধ্যায়ের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সমালোচনা করা বা ব্যক্তিগতভাবে তাঁকে অপমান করা আমার উদ্দেশ্য নয়। আমি যেহেতু ইতিসাসের ছাত্র তাই অনেক আগ্রহ ভরেই বইটা কিনেছিলাম, নাৎসি জমানা নিয়ে তাঁর কী মত, কী ব্যাখ্যা তা জানার জন্য। কিন্তু বইটির প্রাক কথন পড়তে গিয়েই তথ্যের এই বিচ্যুতিগুলি আমার চোখে পড়ে। যদি এক আধটা ভুল হতো, তো ধরে নিতাম যে, ঠিক আছে মানুষের ছোট-খাটো ভুল হতেই পারে। কিন্তু পড়ে দেখি এই লেখায় উপুর্যপরি, স্থান-কাল-পাত্র নিয়ে সব গুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য অসুস্থ, তাঁর দৃষ্টিশক্তিও কমে গেছে, তাই নিশ্চই তিনি বইটি লেখার জন্য কারোওর উপর নির্ভর করেছিলেন। কেউ তথ্য যাচাই করেছেন, প্রেসে দিয়েছেন, প্রুফ দেখে দিয়েছেন। বুদ্ধদেব ভটাচার্য নিজের জায়গায় একজন প্রতিষ্ঠিত মানুষ, কোনও সাধারণ লোক নন। উনি ইচ্ছাকৃতভাবে ভুল তথ্য দিয়েছেন বলছি না, বা শ্লেষাত্মক অর্থেও আমি এটা লিখিনি। হয়তো যাঁকে লেখার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য তাঁকে মৌখিকভাবে বলেছিলেন। কিন্তু ওই ব্যক্তি তথ্য যাচাই না করে এই ভুল করে বসেছেন বা বুদ্ধদেববাবুর কথা ঠিক বুঝে উঠতে পারেন নি।’ তবে ফেসবুকে তাঁর উদ্দেশ্যে ধেয়ে আসা পালটা কটাক্ষ প্রসঙ্গে সুমনবাবু বলেন, ‘বিষয়টি তর্ক-বিতর্ক, যুক্তি-পালটা যুক্তির জায়গা না, লেখায় তথ্যগত কিছু ভুল আছে, সেগুলি সংশোধন করা উচিত।’ তাঁর লেখাকে গঠনমূলক সমালোচনা হিসেবে দেখে প্রকাশক সংস্থার উচিত পরবর্তী সংস্করণে ভুল শুধরে নেওয়া।
বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের বইয়ের ব্যাপারে প্রকাশনা সংস্থার পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, বইটি প্রকাশের পর তাতে কিছু ভুল নজরে এসেছে। অনুলিখনকে কেন্দ্র করে কিছু অনিচ্ছাকৃত ত্রুটি বইটিতে থেকে গিয়েছে। দ্বিতীয় সংস্করণেই তা যথাসম্ভব সংশোধন করা হয়েছে। পরবর্তী সংস্করণগুলিতে সমস্ত ভুল সংশোধন করে তা প্রকাশের চেষ্টা চলছে।

Comments are closed.