বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের চোখের গুরুতর অবনতি। ফ্যাসিজমের উত্থান এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দলিল লেখার কাজ থমকে।

কংগ্রেস নিয়ে দলের অবস্থান কী হবে সেই প্রশ্ন সিপিএমে যুগের পর যুগ অমীমাংসিত এবং মাঝে-মাঝেই পরিবর্তনশীল। এরই মধ্যে সম্প্রতি নতুন এক বিতর্ক তৈরি হয়েছে সিপিএম শীর্ষ নেতৃত্বের মধ্যে। এই বিতর্কের সূত্রপাত ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে বিজেপির কেন্দ্রে সরকার গঠনের এক-দেড় বছর পর থেকেই। বিজেপিকে কি ফ্যাসিস্ট বলা যায়? সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি অনেক দিন ধরেই বিজেপিকে ‘ফ্যাসিস্ট’ বা ‘ফ্যাসিস্ট সুলভ’ আখ্যা দিয়ে তার বিরুদ্ধেই লড়াইকে কেন্দ্রীভূত করার পক্ষে। অন্যদিকে, প্রকাশ কারাট নিজে মনে করেন, বিজেপিকে ‘ফ্যাসিস্ট’ বলা যায় না। বরং তাঁর মতে, বিজেপি স্বৈরতান্ত্রিক একটি দল।
একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকে এসে সিপিএমের দুই শীর্ষ নেতা, সাধারণ সম্পাদক এবং প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক যখন ফ্যাসিজমের সংজ্ঞা নিয়ে বিতর্কে ব্যস্ত, তখন দলের সমস্ত কর্মসূচি থেকে নিজেকে কার্যত গুটিয়ে নিয়ে রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব কলম ধরলেন দুনিয়ায় ফ্যাসিজমের উত্থান এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে এক দলিল লেখার জন্য। টানা শারীরিক অসুস্থতা এবং চোখের গুরুতর সমস্যার জন্য সেই কাজ ইদানীং খানিকটা বাধাপ্রাপ্ত হলেও, রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী চাইছেন যত দ্রুত সম্ভব দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে বই লেখা শেষ করতে।

২০১১ সালে রাজ্যে সরকার বদলের পর সক্রিয়ভাবে বছর দেড়-দুয়েক রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশ নিলেও, তারপর আস্তে আস্তে দলীয় কাজ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতে শুরু করেছিলেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী। দিল্লি বা অন্য রাজ্যে দলীয় মিটিংয়ে যাওয়া অনেক বছরই বন্ধ করে দিয়েছিলেন তিনি। শারীরিক অসুস্থতার জন্য কলকাতাতেও দলীয় কর্মসূচি থেকে নিজেকে আস্তে-আস্তে সরিয়ে নিচ্ছিলেন বুদ্ধদেববাবু। বেশিরভাগ সময়েই পার্টি অফিসে থেকে লেখালেখির কাজ করেছেন। বামফ্রন্ট সরকারের ৩৪ বছর সরকার চালানোর ওপর একটি পর্যালোচনামূলক দলিলও লেখেন তিনি। এর পাশাপাশি তিনি ‘ফিরে দেখা’ নামে দু’খণ্ডে একটি বই লেখেন, যেখানে ১৯৭৭ সাল থেকে ২০১১ পর্যন্ত সিপিএম নেতৃত্বাধীন নিরবিচ্ছিন্ন বাম সরকারের বিভিন্ন কাজকর্ম এবং সাফল্য-ব্যর্থতা লিপিবদ্ধ করেন। ২০১৭ সালে ‘ফিরে দেখা’র দ্বিতীয় খণ্ড প্রকাশের পর দলের মধ্যে আলোচনা শুরু হয়েছিল, প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী তৃণমূল সরকার নিয়ে কিছু লিখবেন কিনা তা নিয়ে। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কিংবা তৃণমূল সরকার নিয়ে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য আগাগোড়া আক্রমণাত্মক হলেও, ২০১১ সাল পরবর্তী রাজ্য রাজনীতির কোনও বিষয়ের বদলে তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাস বেছে নেন তাঁর পরবর্তী বই লেখার জন্য।
কয়েক মাস আগে বুদ্ধদেববাবু ফ্যাসিজমের উত্থান এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, বিশেষ করে গত শতকের দুই এবং তিনের দশকে ইতালি, জার্মানির রাজনৈতিক অবস্থা থেকে শুরু করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ পর্যন্ত গোটা ঘটনাকে লিপিবদ্ধ করার কাজ শুরু করেন। সেখানে সোভিয়েত ইউনিয়ন, গ্রেট ব্রিটেনের ভূমিকা থেকে ইওরোপের রাজনৈতিক ক্ষমতার ভারসাম্য সব নিয়েই এক বৃহৎ দলিল লেখার কাজে হাত দেন তিনি। সূত্রের খবর, এই পুরো ইতিহাসকে ২১টি অধ্যায়ে ভাগ করার কথাও ভেবেছিলেন তিনি। সেই অনুযায়ী তিনি লেখা শুরু করেন। লেখা খানিকটা এগনোর পর একদিন আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের পার্টি অফিসেই অসুস্থ হয়ে পড়েন বুদ্ধদেববাবু। তারপর থেকে বেশিরভাগ সময়ই তিনি বাড়িতে বন্দি। তখনই ঠিক হয়েছিল, বুদ্ধদেববাবু নিজে লিখতে না পারলেও তিনি মুখে বলবেন, একজন সেটার নোট নিয়ে বই লেখার কাজ শেষ করবেন। এভাবেও বইয়ের কাজ এগিয়েছে অনেকটাই।
কিন্তু সূত্রের খবর, দীর্ঘদিন ধরেই ফুসফুসের রোগে আক্রান্ত হলেও সম্প্রতি বুদ্ধদেববাবুর চোখের অবস্থার মারাত্মক অবনতি হয়েছে। এরই মধ্যে গত মার্চ মাসে রাজ্য সম্মেলন চলাকালীন অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে তিনি সম্মেলনে গিয়েছিলেন। তারপর তাঁর দুই চোখেরই অবস্থার আরও অবনতি হয়। একটি চোখের অবস্থা রীতিমতো গুরুতর, অন্যটির অবস্থাও খুব একটা ভাল নয়। সব মিলে আপাতত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে বইয়ের কাজ একটু থমকে গিয়েছে। ইদানীং আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে যাওয়া একেবারেই বন্ধ করে দিয়েছেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী। চোখের জন্য বই পড়াও প্রায় বন্ধ। কিন্তু ডিকটেশন দিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দলিল লেখার কাজ দ্রুত শেষ করতে চাইছেন তিনি। সিপিএমের এক নেতার কথায়, আমাদের দলে বিতর্কের কোনও অভাব নেই। কিন্তু এই বই লেখা শেষ হলে ফ্যাসিজমের উত্থান তো বটেই, তা মোকাবিলার রাস্তা নিয়েও রাজ্য পার্টির কাছে একটা দিশা অন্তত মিলবে।

Leave A Reply

Your email address will not be published.