শিশু সুরক্ষায় নয়া আইনের থেকেও বেশি প্রয়োজন বর্তমান আইনের সঠিক প্রয়োগ

আজ দেশজুড়ে কাঠুয়া কাণ্ড নিয়ে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। ঘটনার নৃশংসতা ও ঘটনা পরবর্তী কয়েকটি বিষয় সামনে আসার পর নড়ে উঠেছে সভ্য সমাজ। ঘটনার অভিঘাত আজ আমাদের ভাবতে বাধ্য করছে বর্তমান সমাজের অবস্থা নিয়ে। কিন্তু আমাদের দেশে কন্যা সন্তানদের সুরক্ষা ও নিরাপত্তার বিষয়টি ঠিক কতদূর অবহেলিত এবং উপেক্ষিত সেটা শুধু মাত্র এই ঘটনা দিয়ে প্রকাশ হয় না। এর আগেও একের পর এক যে সকল ঘটনা ঘটেছে তা আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে কাঠুয়ার ঘটনাটি যতই দুঃখজনক হোক, তা কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। অসংখ্য ঘটনার সুদীর্ঘ তালিকাতে কাঠুয়া একটি সংযোজন মাত্র।

কিন্তু দেশজুড়ে এই ধরণের ঘটনা ঘটে চললেও এর স্থায়ী কোনও সমাধান এখনও আমাদের অধরা। যতবার এরকম কোনও ঘটনা সামনে আসে ততবার সেটির একটি তাৎক্ষণিক রাজনীতিকরণ ঘটে। সংবাদমাধ্যমে নাগরিক সমাজে তা নিয়ে চর্চা চলে। তড়িঘড়ি নয়া আইন প্রণয়নের দাবি তুলে জনগণের মানসিক দিক পরিবর্তনের চেষ্টা করা হয়। অথচ শিশুদের সার্বিক যে সুরক্ষা সেটি সুনিশ্চিত করার জন্য আইন সংশোধনের চেয়েও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে যে সমস্ত  আইন ইতিমধেই রয়েছে সেগুলির যথাযথ প্রয়োগ। দিল্লির নির্ভয়া কাণ্ডের মতো এবারেও দাবি উঠেছে অপরাধীদের সর্বোচ্চ সাজা দেওয়ার। কিন্তু তথ্য বলছে নির্ভয়া কাণ্ডের পর আইন আরও কড়া হলেও নারী উপর নির্যাতন বেড়েই চলেছে। একই কথা শিশু সুরক্ষার ক্ষেত্রেও সমানভাবে প্রযোজ্য। ঘটনা ঘটানোর আগে অপরাধী দু’বার ভাবছে না।

ন্যাশেনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোর নথি ও তথ্য বিশ্লেষণ করে আমরা দেখেছি, গত এক দশকে সারা দেশে শিশুদের বিরুদ্ধে সংঠিত অপরাধ বেড়েছে প্রায় পাঁচশ শতাংশ। পকসো আইন কার্যকর হওয়ার পরও উল্লেখযোগ্য কোনও পরিবর্তন ঘটেনি। পকসো আইন হল এমন একটি আইন যেখানে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে শিশু নির্যাতন বা শিশুদের উপর যৌন নির্যাতনের কোনও ঘটনা ঘটলে কী ভাবে বিশেষ আদালতে তার বিচার করতে হবে। নির্দিষ্ট দিনের মধ্যে তদন্ত শেষ করে চার্জশিট পেশেরও উল্লেখ রয়েছে এই আইনে। অথচ অধিকাংশ পুলিশ আধিকারিক বা তদন্তকারীরাই এই আইন সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল নন। সাধারণ আদালতকেই বিশেষ আদালতের তকমা দিয়ে, নির্যাতিতা শিশুকে অভিযুক্তের সামনে এনে মামলার শুনানি করা হচ্ছে। অথচ পকসো আইনে স্পষ্ট বলা রয়েছে শিশুকে অভিযুক্তের সামনে আনা যাবে না। ইন ক্যামেরা ট্রায়াল চালাতে হবে। নানা জটিলতায় দীর্ঘায়িত করা হচ্ছে রায় দান প্রক্রিয়া। আইনের ফাঁক গলে অপরাধীদের পার পেয়ে যাওয়ার সম্ভবনা দেখা দিচ্ছে। অন্যদিকে, শিশুটিকে যেতে হচ্ছে মানসিক যন্ত্রণা ও আতঙ্কের মধ্যে দিয়ে। তাই বর্তমান আইনগুলির ফাঁক পূরণ না করে শুধুমাত্র নতুন আইন আনলেই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে, এটা ভাবা ভুল।

২০১৬ সালের তথ্য বলছে সারা দেশে শিশুদের বিরুদ্ধে যত অপরাধমূলক ঘটনা ঘটে তার এক তৃতীয়াংশই যৌন অপরাধ এবং বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অপরাধীরা শিশুদের পূর্ব পরিচিত। আমরা যদি খতিয়ে দেখি দেখা যাবে শিশুদের উপর অত্যাচারের ক্ষেত্রে সামান্য এক ভগ্নাংশ অপরাধীই সাজা পায়। তাই নয়া আইন রূপায়নের থেকেও বেশি জরুরি বর্তমান আইনের সঠিক প্রয়োগ ও রূপায়ন। তবে সর্বাগ্রে প্রয়োজন যে মানসিকতা এই ধরণের অপরাধ সংগঠিত করার সাহস যোগায় তার পরিবর্তন। সুস্থ, স্বাভাবিক পরিবেশে মানুষ যাতে বেড়ে উঠতে পারে, স্বাস্থ্য-শিক্ষা-খাদ্যের অধিকার পায় তা সুনিশ্চিত করতে হবে। তবেই আমরা পারব শিশুদের সুস্থ জীবন ও অধিকার ফিরিয়ে দিতে।

(কথা বলেছেন শুভঙ্কর বড়ুয়া)

Leave A Reply

Your email address will not be published.