কলকাতার চিনে পাড়ায় হাজারো রেস্তরাঁর ভিড়ে কি আজ হারাতে বসেছে ঐতিহ্যশালী চিনা সংস্কৃতি

বাঙালি যে বরাবরই খাদ্যরসিক। আর এক সময় জিভে জল আনা চাইনিজ খাবারের একমাত্র ঠিকানা তো চায়না টাউনই ছিল! সুস্বাদু চাইনিজ খাবারের খোঁজে বারবার বাঙালি ছুটে আসত এই চিনা পাড়ায়। শুধু বাঙালি কেন? বিদেশিদের কাছেও তো প্রিয় ছিল চায়না টাউন। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রতিযোগিতা বেড়েছে, পাড়ার রাস্তার মোড় থেকে অধুনা শপিং কমপ্লেক্স, সর্বত্রই চাইনিজ ফুডের রমরমা বাজার, বিক্রি হচ্ছে হাতে গরম করা চাইনিজ খাবার।
কিন্তু ট্যাংরার চায়না টাউন একটাই, শহরজোড়া চিনা খাবারের হাজারো রেস্তরাঁর মাঝে এখনও যেন দাঁড়িয়ে আছে কলকাতায় চিনা খাবারের স্বতন্ত্র এক চরিত্র নিয়ে!
আসলে চিনাদের সঙ্গে ভারতীয়দের যোগাযোগটা বেশ পুরনো। এই যেমন, ফা হিয়েন, যিনি ছিলেন চিনা পরিব্রাজক, দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের আমলে ৪০৫ থেকে ৪১১ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে ভারতে আসেন। কিংবা হিউয়েন সাঙ ৬৩০-৬৩৫ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে হর্ষবর্ধনের সময়ে ভারতবর্ষে এসেছিলেন। এঁদের রচিত ভ্রমণ কাহিনী তো ভারতের ইতিহাসের এক অমূল্য উপাদান। চিনাদের সঙ্গে ভারতের ব্যবসা-বাণিজ্যের ইতিহাসটাও বেশ প্রাচীন। ব্যবসার জন্যই তো প্রসিদ্ধ হয়েছিল ‘সিল্ক রুট’, যা হাজার বছর আগেও বিরাজমান ছিল। আর এই পথেই চিন থেকে সিল্ক আসত ভারতে।
কিন্তু, টং অ্যাটছিউ-এর নাম শুনেছেন কখনও? ব্রিটিশ ভারতে ১৭৯৮ সালে এই চিনা ব্যবসায়ী কলকাতায় এসেছিলেন। যত দূর জানা যায়, তিনিই ছিলেন আধুনিক ভারতে প্রথম চিনা নাগরিক, যিনি ব্যবসা করতে ভারতে এসেছিলেন। তখন কলকাতার গর্ভনর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস। বড়লাটের অনুমতি লাভের পরই টং অ্যাটছিউ কলকাতায় কিনে ফেললেন একটা আস্ত চিনির কারখানা। সেই শুরু। তারপর থেকেই কলকাতায় চিনারা আসতে শুরু করলেন। এরপর সময় যত গড়িয়েছে চিনাদের সংখ্যা ততই বেড়েছে। ১৮২০ সালে কলকাতা পুলিশের সেনসাসে বলা হয়েছিল, শহরে চিনাদের সংখ্যা ৩৬৭। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মাঝে সে সংখ্যা অনেক বেড়েছে। স্বাধীনতার পর ভারতে অহরহ আসতে থাকে চিনারা। মোটামুটিভাবে ১৯৬২ সালের ইন্দো-চিন যুদ্ধের পর থেকে তপশিয়া, ট্যাংরা অঞ্চলে চিনারা একসাথে থাকতে শুরু করলেন।
চামড়া শিল্পে যথেষ্ট দক্ষ ছিলেন ‘হাক্কা’রা। এই ‘হাক্কা’ মানে কিন্তু হাক্কা চাউমিন না। এই ‘হাক্কা’ হল চিনের একটি জাতি। যাঁরা কিনা ট্যাংরা অঞ্চলে চামড়া শিল্পের শ্রমিক ছিলেন। কেউ কেউ আবার মালিকও ছিলেন বটে। বছর বিশেক আগে পর্যন্ত এই অঞ্চলে চিনাদের সংখ্যা ছিল প্রায় বিশ হাজারের কাছাকাছি। তথ্য বলছে, ১৯৮৭ সালে সুপ্রিম কোর্টে এক জনস্বার্থে মামলা হয়। বিষয়বস্তু ছিল, ট্যাংরা, তপশিয়া অঞ্চলের চামড়ার কারখানাগুলি পরিবেশ দূষণের আঁতুড়ঘর। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মামলায় গড়াল। পরিশেষে সুপ্রিম কোর্টের রায় অনুযায়ী, এই অঞ্চলে চামড়ার কারখানা বন্ধ করা হল। কাজ হারালেন অসংখ্য মানুষ। এঁদের মধ্যে কেউ কেউ শুরু করলেন খাবারে ব্যবসা। গড়ে উঠল একের পর এক অথেনটিক চাইনিজ ফুডের রেস্তরাঁ। জীর্ণকায় কারখানাগুলি পরিণত হল ঝাঁ চকচকে চাইনিজ রেস্তরাঁয়। ১৯৯০ আর ২০০০ এর দশক জুড়ে বাঙালির চাইনিজ খাওয়ার ঠিকানা হয়ে উঠল এই চিনা পাড়া। একটা সময় এসেছিল, তৎকালীন সরকার ঠিক করেছিল এই অঞ্চলকে কেন্দ্র করে গড়ে তোলা হবে ‘চাইনিজ হেরিটেজ কলোনি’।

তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর খুব ফেভারিট ছিল চিনা পাড়ার খাবার। চায়না টাউন গড়ে ওঠার পেছনে তাঁর অবদান যে অনস্বীকার্য, অকপট স্বীকারোক্তি নেভিল ডি ক্রজের। মাঝবয়সী নেভিল দু’দুশক ধরে চায়না টাউনের এক নামী রেস্তরাঁর ম্যানেজার। শুরুতেই অবশ্য সব ট্যানারি বন্ধ হয়ে গিয়ে রেস্তরাঁ হয়ে গিয়েছিল, এরকমটি নয়। প্রথম দিকে রেস্তরাঁর সংখ্যা ছিল মাত্র ১৬ টি, সেই সঙ্গে ট্যানারিও ছিল কিছু। কিন্তু সেগুলি ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে গিয়ে বাঙালির স্বাদ পূরণের জন্য খুলল একের পর চাইনিজ রেস্তরাঁ। এখন নয় নয় করে ৪০ এর বেশি চিনা রেস্তরাঁ রয়েছে এখানে। তবে কি চায়না টাউন মানেই অথেনটিক চাইনিজ খাবার? উত্তরে সটান ‘না’ বললেন নেভিল। আসলে অথেনটিক চাইনিজ ফুড একমাত্র তৈরী হয় চিনাদের বাড়িতে তাঁদের নিজেদের জন্য। আর রেস্তরাঁয় যেটা বিক্রি হয় সেটা আসলে ‘ইন্ডিয়ান চাইনিজ’, মানে চাইনিজ খাবারের মেলবন্ধন ঘটেছে কলকাতার রেসিপির সঙ্গে। আর সেখানেই চাইনিজ ফুডে মশলাপাতির পরিমাণটা একটু বেড়েছে। কারণ, বাঙালির তো ঝাল আর মশলা ছাড়া খাবার ঠিক হজম হয় না। তাই প্রয়োজনের খাতিরে একটু পরিবর্তন আর কী! কিন্তু সসের সঙ্গে কোনও কম্প্রোমাইজ নেই এঁদের। প্রতিদিন শেফ এসে নিয়ম করে সস তৈরি করে দিয়ে যান। যেমন, হট গার্লিক সস, বোম্বে সস, সেজুয়ান সস, মাঞ্চুরিয়ান সস, কুম্পাও সস ইত্যাদি। এগুলোর রেসিপির কিন্তু হেঁসেলের মধ্যেই থাকে। আর সবথেকে বড় কথা হল, এখনও পর্যন্ত চিনারা বংশ পরম্পরায় চালিয়ে যাচ্ছে এই চায়না টাউনের একাধিক রেস্তরাঁ। সেটাও জানালেন নেভিল।

বেজিং, গোল্ডন জয়, মিং গার্ডেন, বিগ বস , কিম্ফা, হট ওক, কিম লিং নাম বলে শেষ করা যাবে না। কোনটা ছেড়ে কোনটায় ঢুকবেন?
এই যেমন, দক্ষিণ কলকাতার বাসিন্দা মহুয়া ঘোষ নয়ের দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে চায়না টাউনে আসছেন। এডুকেশন সেক্টরে কর্মরতা মহুয়া চাইনিজ খাবার অন্তপ্রাণ। বিয়ের আগে একা আসলেও এখন সময় পেলেই মেয়েকে নিয়ে মাঝে মধ্যেই ঢুঁ মেরে যান চিনা পাড়ায়। এনার অবশ্য কিম লিং অল টাইম ফেবারিট। তাই বারবার চাইনিজ ফুডের জন্য নেশায় এসে পড়েন চিনা পাড়ায়, জানালেন মহুয়া। কিন্তু চায়না টাউন মানে কি শুধুই চাইনিজ খাবার?
চায়না টাউনে এসেছেন অথচ ঠাণ্ডা পানীয়ে গলা ভেজাবেন না? আসলে ওটাও এখানে আসার একটা কারণ বটে। আসলে ব্যাপারটা হল, এখানেই একমাত্র পেগ সিস্টেমের পাশাপাশি চাইলে হাতে পেয়ে যাবেন গোটা বোতল, সেখানে খরচটাও যে অনেকটা কমে যাবে। কলকাতা শহরের অন্য কোথায় খুব একটা এই নিয়ম চোখে পড়ে না। তাহলে কি এই নিয়ম শুধুমাত্র চায়না টাউনের জন্যই? আজ্ঞে না! সব জায়গাতেই আছে, কিন্তু মুনাফার জন্য এই সিস্টেম চালু করেনি অন্যরা।
আর পর্ক? সব রেস্তোরায় পর্ক পাবেন না। যদিও চাইনিজ ফুডের মধ্য অন্যতম হল পর্কের রেসিপি। না পাওয়ার কারণটা খুব একটা গুরতর নয়। অনেকের পর্ক ঠিক পছন্দ হয় না, তাই আর কি!

মনিকা লিউ চিনা পাড়ার এক অত্যন্ত পরিচিত নাম। নয়ের দশকে এই গৃহবধু নিজের হাতে করে গড়ে তুলেছিলেন আস্ত একটা রেস্তরাঁ। আর এখন তাঁর রেস্তরাঁটি শহরের অন্যতম চিনা খাবারে অপর নাম। বেজিং, যাঁরা ফুড কোয়ালিটি নিয়ে কখনও কম্প্রোমাইজ করেন না। কিমলিং এরও মালিকও স্বয়ং লিউ ম্যাডাম, বারবার যিনি খবরের শিরোনামে এসেছেন তাঁর কীর্তির জন্য।
সকালে হাতে গরম করা ব্রেকফাস্ট নিয়ে চিনারা উপস্থিত হয় টিরীটি বাজারে, এটা আমাদের অনেকের জানা আছে। আর চায়না টাউনে? হ্যাঁ, এখানেও প্রতিদিন সকালে পাবেন অথেনটিক চাইনিজ ব্রেকফাস্ট। ঠিক চাইনিজ কালী বাড়ির পাশে এঁরা পসরা সাজিয়ে বসেন। ব্রেকফাস্টের মধ্যে ওয়ান্টন আবার খুব প্রিয় সুমনের। বছর তিরিশের এই যুবকের বড় হয়ে ওঠা ট্যাংরা চত্বরে, কিন্তু ছোটবেলার চায়না টাউনের সঙ্গে আজকের চায়না টাউনের অনেক তফাত খুঁজে পান তিনি। তাঁর মতে, সেই খাবারের মান আজ আর নেই, এখন শুধু চায়না টাউনে লোক আসে খানিক গলা ভেজাতে আর কিছুটা চাইনিজ ফুড খেতে।
কিন্তু এখন চিনা পাড়ায় চিনাদেরই দেখা মেলা ভার। এক সময় চিনারা গমগম করতেন এখানে, আর এখন মাত্র হাতে গোনা হাজার দুয়েক চিনা রয়েছেন। পরবর্তী জেনারেশনের ছেলে-মেয়েরা কলকাতা ছাড়ছেন। চিনা স্কুলটিও আজ তালা বন্ধ। শহরের মধ্যে একমাত্র চাইনিজ মিডিয়াম স্কুল ছিল এটি। এখন সেটি সামাজিক অনুষ্ঠানে ভাড়া দেওয়া হয়। এক টুকরো চিনা সংস্কৃতি যেন আজ বিলীন হয়ে যেতে শুরু হয়েছে। আরও কয়েক বছরে এই অবস্থা ভয়ানক রূপ নেবে, হয়তো সব রেস্তরাঁর হাতও বদল হয়ে যাবে, এমনটাই জানালেন জিমি। জিমি আসলে ট্যানারির মালিক ছিলেন। বছর দশেক হল নিজের ঝাঁ চকচকে রেস্তরাঁ খুলেছেন। কিন্তু রেস্তরাঁর লাইসেন্স পেতে বা সুরা বিক্রির অনুমতির রিন্যুইয়াল করাতে প্রতি বছর তাঁর কালঘাম ছুটে যাচ্ছে। একেই ডিমনিটাইজেশনের প্রভাবে জরাজীর্ণ তাঁর ব্যবসার অবস্থা, তার উপর লাইসেন্স পেতে গেলে সরকারি অফিসারদের পকেট ভর্তি করতে করতে ক্লান্ত জিমি। এমন অনেক সময় হয়, সরকারি অফিসাররা এসেছেন পেট ভর্তি করে খাবার খেয়েছেন, কিন্তু বিল মেটাননি। এভাবে চলতে থাকলে আর বেশিদিন ব্যবসা চালানো সম্ভব নয় তাঁর পক্ষে। শুধু তাঁর না, জিমির আশঙ্কা গুটিকয়েক রেস্তরাঁ ছাড়া সকলেরই অবস্থা প্রায় একইরকম। সরকার শুধুমাত্র রাস্তা পরিষ্কার করেই ক্ষান্ত। মালিক পক্ষের দিকে নজর দেওয়ার সময় তাদের নেই, বলতে কুন্ঠাবোধ করলেন না জিমি।
কিন্তু এইরকম চলতে থাকলে সাধের চায়না টাউন থাকবে, কিন্তু সেই চিনা ফিলিংসটা কোথাও একটা অপূর্ণ থেকে যাবে। ভারতবর্ষে এরকম জায়গা আর দুটো নেই। জাতি, বর্ণ, ধর্ম নির্বিশেষে অসংখ্য মানুষ এখানে কাজ করে রুজি রুটি জোগাচ্ছেন রোজ। কোথাও একটা যেন এঁরা মিশে গেছেন বাঙালি জীবনের সঙ্গে। যদি চায়না টাউনকে বাঁচাতে হয়, থুড়ি যদি চিনা সংস্কৃতিকে বাঁচাতে হয় তাহলে সরকারের পদক্ষেপ নিঃসন্দেহে প্রয়োজনীয়।

Comments are closed.