কলেজ স্ট্রিট বই পাড়া, কেমন আছে আজ বাঙালির বারো মাসের এই বইমেলা চত্বর

‘গল্প হচ্ছে মনের ম্যাসাজ, চিত্তের ডলাই মলাই, পড়লে মেজাজ চাঙ্গা হয়’, গল্প সম্পর্কে এই রকমই ধারণা ছিল লেখক রাজশেখর বসুর। আসলে গল্প আর তার থেকেও বড় কথা গল্পের বই, কিংবা যে কোনও বইয়ের কথা এলেই এক নিমেষে যে নামটি মনে আসবে, তা হল কলেজ স্ট্রিট। আমাদের বই পাড়া। বইয়ের স্বাদ মেটাতে বাঙালি বারবার ছুটে যায় এই কলেজ স্ট্রিটে। কয়েক বছর আগে কলকাতা বইমেলায় ঘুরতে এসে কলেজ স্ট্রিটে গিয়েছিলেন এক ফরাসি সাহিত্যপ্রেমী। কলেজ স্ট্রিট দেখে তিনি যথার্থই বলেছিলেন, ‘মাইন ডি লিভার’, বাংলা ভাষায় যার অর্থ, বইয়ের খনি। বাঙালি জীবনে কলেজ স্ট্রিট ওতপ্রতোভাবে জড়িত, আসলে আমাদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে কলেজ স্ট্রিটের গন্ধ।

১৮১৭ সাল নাগাদ স্থাপিত হল হিন্দু কলেজ, তারপর হিন্দু স্কুল। সংস্কৃত কলেজ, মেডিকেল কলেজ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠতে শুরু করল এই চত্বরে। পরে অবশ্য কলেজগুলোকে কেন্দ্র করে জায়গাটার নাম হয় কলেজ স্ট্রিট। আজকের এই কলেজ স্ট্রিট বা বই পাড়া গড়ে উঠতে শুরু করে মোটামুটিভাবে ১৯৩০-৪০ এর দশক থেকে, যখন ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের এক অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি। কিন্তু বইয়ের দোকানের ইতিহাস আরও প্রাচীন। ইতিহাস বলছে, কলেজ স্ট্রিটের প্রথম বইয়ের দোকানের মালিক ছিলেন গুরুদাশ চট্টোপাধ্যায়। হিন্দু হস্টেলের সিঁড়িতে বইয়ের পসরা সাজিয়ে বসতেন তিনি। সবই ছিল মেডিকেলের বই। এরপর ১৮৮৩ সালে গড়ে উঠল এস কে লাহিড়ী অ্যান্ড কোম্পানি, ১৮৮৬ সালে দাশগুপ্ত অ্যান্ড কোম্পানি। বিদ্যাসাগর মহাশয়ও একটা বইয়ের দোকান খুলেছিলেন বলে জানা যায়, যার নাম সংস্কৃত প্রেস ডিপজিটারি। ধীরে ধীরে একের পর বইয়ের দোকান গড়ে উঠতে লাগল এলাকাজুড়ে।

‘আসলে প্রথমে আমার দাদু যখন দোকানটি চালু করেন, তখন তা এমন বাঁধানো ছিল না, মাটিতে চাটাই পেতে বইয়ের পসরা সাজানো হতো। আর বাবার মুখে শোনা, দুপুর ১২ টা থেকে নাকি আড়াইটে-৩ টে পর্যন্ত বই বেচা-কেনা চলত। এরপরে অবশ্য লম্ফ জ্বালিয়ে সন্ধ্যে পর্যন্ত দোকান চালু করা হয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের দোকান পাকা হয়েছে, মাঝে অবশ্য রেলিংয়ে দড়ি বেঁধে বই ঝোলানো থাকত। নয়-নয় করে ৭০- ৮০ বছর হয়ে গেল আমাদের এই দোকান,’ বলছিলেন আসলাম হুসেন। বাবা আর ছেলে ফারহান বর্তমানে দোকান সামলাচ্ছেন। ঠিক কফি হাউসের উল্টোদিকে ফারহানদের দোকান, নাম এ এইচ বুক স্টল। আসলে এখন বই বলতে বেশিরভাগটাই পড়াশোনার বই, বললেন ফারহান।
‘কিন্তু দুঃখের ব্যাপার হল, অনলাইন দুনিয়া কিছুটা হলেও গ্রাস করছে নতুন বই কিনে পড়ার বিষয়টিকে, আমাদের সময় নতুন বইয়ের গন্ধ একটা নেশার মত ছিল, পুজোতে দু’একটা জামা কম হতে পারে, কিন্তু গল্পের বইয়ের সঙ্গে কম্প্রোমাইজ নৈব নৈব চ! এক সময় পাতিরাম খুব জনপ্রিয় ছিল, যেখানে ছবি বিশ্বাস থেকে শুরু করে বিকাশ রায় সবাই আসতেন বই কিনতে। তাছাড়া আরও একটা জিনিস হল, এক সময় আমরা বিয়ে বাড়িতে বই গিফট করতাম, এখন সেসব রেওয়াজ আর নেই। অনেক বইয়ের দোকান এখন উঠেও গেছে। নকশাল আন্দোলনের আঁতুড়ঘর ছিল এই কলেজ স্ট্রিট, কিন্তু নকশালরা বইয়ের উপর আঘাত হানেনি। একটা সময় সোভিয়েত রাশিয়া নিয়ে অসংখ্য বই প্রকাশ হোত, এখন সে সবও বন্ধ। মানুষের বই পড়ার নেশা মনে হয় কিছুটা হলেও কমেছে, ‘আক্ষেপ করছিলেন সত্যব্রত ঘোষ। বছর ৬৫ র এই মানুষটির কলেজ স্ট্রিটের সঙ্গে সম্পর্ক প্রায় ৪০ বছরের।

সংস্কৃত কলেজের উল্টোদিকে রয়েছে রয়েছে বেঙ্গল পাবলিশার্স। প্রায় ৭৫ বছরের পুরনো দোকান, মনোজ বসু এই দোকানের প্রতিষ্ঠাতা। জীর্ণকায় হলেও এই দোকান আজও তার ঐতিহ্য এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এক সময় খ্যাতনামা লেখকদের আড্ডা বসতো এই দোকানে, জানালেন দোকানের কর্মচারী ব্রজগোপাল দাস।
বইপাড়া নিয়ে কথা বলতে গেলে বটতলার কথা বলতেই হয়। কিন্তু এই বটতলা আদৌ কলেজ স্ট্রিট চত্বরে নয়। যা সম্পর্কে সুকুমার সেন বলেছিলেন, ‘সেকালে, অর্থাৎ আজ থেকে দেড়শো বছর বেশিকাল আগে শোভাবাজার বালাখানা অঞ্চলে একটা বড় বনষ্পতি ছিল, সেই বটগাছের শানবাঁধানো তলায় তখনকার পুরবাসীদের অনেক কাজ চলত। বসে বিশ্রাম নেওয়া হতো, আড্ডা দেওয়া হতো। গান-বাজনা হতো, বইয়ের পসরাও বসতো। অনুমান হয়, এই বই ছিল বিশ্বনাথ দেবের ছাপা। ইনিই বটতলা অঞ্চলে এবং সেকালের উত্তর কলকাতায় প্রথম ছাপাখানা খুলেছিলেন (বটতলার বইঃ দুই শতকের বাংলা মুদ্রণ ও প্রকাশন পৃ-২৬৯)।
চক্রবর্তী অ্যান্ড কোম্পানি নামক বইয়ের দোকান প্রায় ১০৮ বছরের পুরনো, প্রতিষ্ঠা করেছিলেন আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়। ‘সেদিন আর এদিনের অনেক তফাত। আমাদের দোকানে রীতিমত আড্ডা বসতো, অবশ্য এখনও বসে,’ জানালেন কৌশিকবাবু। দাশগুপ্তদের দোকান কে না চেনেন। শুরু করেছিলেন গিরিশচন্দ্র দাশ মহাশয়। বর্তমান কর্ণধার অরবিন্দ দাশগুপ্ত বললেন, ‘প্রথমদিকে আমাদের নিয়ে হাতে গোণা ১৫-২০ টা বইয়ের দোকান ছিল, এখন যার সংখ্যা প্রায় ১০ হাজারের কাছাকাছি। আসলে চাহিদা অনুসারে বইয়ের দোকানও বেড়েছে।’

বছর ৩২ এর যুবক অর্চিস্মান মনে করেন না, ইন্টারনেট সব কিছুর জন্য দায়ী। বললেন, ‘যাঁদের বইয়ের নেশা তাঁরা ঠিকই কলেজ স্ট্রিটে আসেন বই কিনতে।’ কিন্তু কিছুটা হলেও ইন্টারনেট দুনিয়া বই পড়ার প্রবণতা কমিয়েছে, সেটা অস্বীকার করলেন না। অর্চিস্মানবাবু কর্মসূত্রে কলকাতার বাইরে থাকেন, কিন্তু সুযোগ পেলেই আসেন এই চত্বরে। বললেন, ‘কলেজ স্ট্রিট অনেকটা নস্টালজিয়া আমার কাছে।
আড্ডাটা কলেজ স্ট্রিটের একটা অঙ্গ, এক সময় অসংখ্য জায়গায় আড্ডা বসতো। এক একটি বইয়ের দোকানকে কেন্দ্র করে বসতো আড্ডার আসর। দিলখুশা কেবিনের পাশের রাস্তায় এরকম একটা আড্ডার আসর বসতো দেবী সেনের নিজের দোকানে। দেবীবাবুর ইংরেজি সাহিত্যে অসম্ভব দক্ষতা ছিল। সেখানে আসতেন অসংখ্য মানুষ। প্রেমেন্দ্র মিত্র বহুবার এসেছেন এখানে। তাছাড়াও আড্ডার ঠেক হিসাবে সুপরিচিত ছিল সন্দীপ দত্তের লিটল ম্যাগাজিনের দোকানটি। দর্শক পত্রিকার ছোট্ট ঘরটি প্রতিদিন গমগম করত। বিদগ্ধ মানুষজন আসতেন শুধু আড্ডার নেশায়। দর্শক পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন দেবকুমার বসু, তিনিই ছিলেন আড্ডার মধ্যমণি। সত্যজিৎ রায়, প্রেমেন্দ্র মিত্ররা আসতেন এখানে। অমিতাভ দাশগুপ্ত পরিচয় পত্রিকার অফিস ছেড়ে এখানে আসতেন আড্ডার আসরে যোগ দিতে।
‘আসলে আজকাল এই আড্ডার আসরগুলো আর বসে না। এক সময় বসন্ত কেবিনের আড্ডায় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়রা নিয়মিত যেতেন, এখন এসব অনেকটাই ম্লান। নতুন প্রজন্ম কলেজ স্ট্রিটে আড্ডার বদলে বেছে নেয় কোনও শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কফিশপ,’ আক্ষেপ করে জানালেন ডঃ শম্পা সেন। শম্পাদেবী বর্তমানে সরকারি কলেজের অধ্যাপিকা, যাঁর ছাত্রজীবন কেটেছে কলেজ স্ট্রিট চত্বরে। বললেন, ‘বাবার হাত ধরে কলেজ স্ট্রিটে এসেছিলাম। বাবাই প্রথম পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়, অমিতাভ দাশগুপ্তের সঙ্গে। এখনও কলেজ স্ট্রিট দিয়ে হাঁটলে ছাত্র আন্দোলন, কফি হাউসের আড্ডা, নতুন বই কেনার উৎসাহগুলো যেন ভেসে ওঠে।’

প্রেসিডেন্সির ফুটপাতজুড়ে একাধিক বইয়ের দোকান। যেখানে এখনও লোকে ভিড় করে। ইউনিভার্সাল বুক স্টল প্রায় ১০০ বছরের পুরনো। ‘এখন বেশি বিক্রি হয় শুধু পড়াশোনোর বই,’ জানালেন খালিদ ভাই। খালিদ ভাই প্রায় ২৫ বছর ধরে এই দোকানে বসছেন। অনেক পরিবর্তন নিজের চোখে দেখেছেন। মানুষ নাকি এখন পড়াশোনোর মধ্যে এত ঢুকে গেছে, তাঁদের নাকি অন্য বই পড়ার সময় নেই, আক্ষেপ খালিদের।
একটা সময় ছিল যখন, প্রেসিডেন্সির রেলিং দিয়ে থাকত উন্মুক্ত লাইব্রেরি, অসংখ্য পুরনো বইয়ের দোকান। দুষ্প্রাপ্য বইয়ের সব সম্ভার, বইপ্রেমী বাঙালির কাছে যা ছিল অন্যতম আর্কষণ। এক সময় মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায় এই সব দোকান তুলে দিতে চেয়েছিলেন। সুনীতি কুমার চট্টোপাধ্যায়ের আবেদনে সাড়া দিয়ে অবশ্য সেই পরিকল্পনা রদ করা হয়েছিল পরে।


পড়ুনঃ জানেন, কলকাতার এই রাস্তা এবং এলাকাগুলোর এমন নামকরণের কারণ কী?


আসলে বই জিনিসটি আমাদের সঙ্গে ওতপ্রতোভাবে জড়িয়ে। এখনও বাঙালির কাছে বই প্রেশাস লাইফ ব্লাড। আবার অন্যভাবে দেখতে গেলে বই হল ‘ফ্রেন্ড ফর এভার’। বইয়ের সঙ্গে এই বন্ধুত্ব বাঙালির অমলিন, বন্ধুত্বকে সম্মান জানাতে আজও মানুষ ভিড় করেন বই পাড়ায় । বলা বাহুল্য, এই বই পাড়া জুড়েই বাঙালির বারো মাসের বইমেলা।

Comments are closed.