শহরজুড়ে নজর রাখছে রাগী হনুমান, শাম্মি কাবাব বদলে হবে সোয়া চাপ।

দিল্লি জুড়ে মঁ মঁ করছে কাবাব, নানরুটি, হালুয়া, গোলাপ জল, হালিম, আতর, ঘিয়ে মাখানো এক মায়াবী মোগলাই গন্ধ। এ গন্ধ মোটামুটি যে কোনও শহরেই পাওয়া যায় রামজান মাসে। ঝলসানো মাংস, ভেজা ফুল, মাজারের সামনে বিকেলবেলা জল ছেটানো সোঁদা গন্ধ যেমন থাকে।
জামা মসজিদের সামনে গোটা রাত উনুন জ্বলবে দোকানে দোকানে। বিরিয়ানি, ডাল গোস্ত, হালিমের রাত উপহার পাবে ইবাদত শেষে। উদযাপনের রাত লেগে থাকবে স্বাদে। এ স্বাদের ধর্ম হয় না। সপ্তমীর রাতের খাওয়া এগরোল আরও সুস্বাদু হয় এ সময় গোস্তমুখী হয়ে। খান চাচার ভাজা পরোটা, পেঁয়াজ পেতে আদর করে শুইয়ে দেয় গোটা ছয়েক বোটি কাবাবকে। তারপর লেবুর রস ছড়িয়ে দিতে হবে রোল করার আগে। বিসমিল্লাহ!
২০০১ নাগাদ গোটা দিল্লিতে ত্রাস সৃষ্টি করেছিল “কালা বন্দর” বা কালো বানর। হনুমানরুপী মানুষ। মাথায় লোহার হেলমেট, লোহার নখ, লাল চোখ, নিঝুম রাতে আক্রমণ করে দিল্লিবাসীকে। কখনো পুরনো হভেলীর ছাদে, কখনো লালকেল্লার পাশে বা নির্জন গলিতে। একলা পেলেই আক্রমণ করে। মাংকিম্যান।
ইদানীং গোটা দিল্লি জুড়ে আর কালো বানরের উপদ্রব নেই। উগ্র দেশাত্মবোধের যুগে এখন রাগী হনুমান দেখা যায় পথে প্রান্তরে। লাল চোখ, দাঁত খিঁচিয়ে, কপালে তিলক কেটে তাকিয়ে আছে আপনার দিকে। গাড়ির পিছন থেকে, রিক্সা থেকে, মোবাইল কভার থেকে, কম্পিউটার ওয়ালপেপারে। লস্যির দোকানের পান্ডেজী বা ড্রাইভার ভাই যিনি জয় শ্রী রাম উল্কি করে রেখেছেন হাতে, তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম এই ছবির বা স্টিকারের মাহাত্ম্য। ঘন গলায় কোরাস শুনবেন।

‘জনাব, ইনি হিন্দুত্ব রক্ষা করতে এসেছেন। রাম মন্দির আজও তৈরি হলো না, রামকে বনবাসে পাঠাতে চাইছে কিছু রাষ্ট্রবিরোধী, তাতে ক্ষোভ বাড়ছে পবনপুত্রের। ওনার চোঁয়াল শক্ত হচ্ছে। হিন্দু বিরোধীদের বিনাশ করবে এ। দেখবেন, সেদিন দূরে নেই’।
আমি প্রায় বলেই বসেছিলাম, কল্কি অবতারের পরে স্টিকারে বানর অবতার নাকি? চেপে গেলাম। এখান থেকে দাদরি খুব দূর না। ফ্রিজে কোয়েল, গরু না গর্ধবের মাংস আছে জানার আগেই পিটিয়ে দেওয়া দস্তুর এখন। সন্দেহ হলেই গুজব ছড়িয়ে দিন এ গরুখেকো, তারপর ওই কবে যেন জনগণমন চলাকালীন দাঁড়ায়নি।
দিল্লি শহরটা ছিল মোগলাই রোয়াবের। একে বদলে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। মোগলাই মন্ত্রী-শন্ত্রী, নাতি-পুতি, খানসামা-আর্দালিদের উচ্ছিষ্ট যেটুকু আজও আছে, তাঁদের ধমকে-চমকে বলা হচ্ছে দেশের ভাষা হিন্দি, দেশের ফুল পদ্ম, দেশের রঙ গেরুয়া আর দেশের খাবার মানে, রাজমা আর সোয়াবিন। এর বাইরে যা কিছু তা রাষ্ট্রবিরোধী। তা হিন্দুবিরোধী, তা হিন্দুস্থান নয়।
দিল্লি প্রাচীন বাসিন্দাদের একটু মুড ভালো থাকলে, ঘরের তৈরি কাবাব, নরম পরোটা আর ঘোল পেলেও পেতে পারেন। পড়ন্ত বিকেলে শুনবেন নবাবি নস্টালজিয়া। নবাব শাহজাদাদের উদ্ধৃত করে একটা কথা খুব বলে এরা: ‘এক লুকুম কাবাব হো, এক পেয়ালা শরাব হো। সুলতানাত-এ নুর-এ-জাহানি, আবাদ হো, বরবাদ হো’!
অর্থাৎ, এক কাঁমড় কাবাবের, এক পেয়ালা শরাবের। এরই ঘ্রাণে ও স্বাদে দিল্লির সুলতানাত, তার মধ্যমণি যা কিছু তার উন্নতি হোক, তার অধঃপতন হোক!
ফিরোজ শাহ তুঘলকের শাসনকালে কালি কালান মসজিদের কাছে মধ্যবিত্ত মহল্লায় জনপ্রিয় হয়ে ওঠে শাম্মি কাবাব। মুঘল আমলে পারস্য ঘরানার কাবাব রাজ অনুগ্রহ লাভ করে। বাদশাহ আকবর থেকে শাহজাহান, রসনার সমঝদার হিসাবে সমাদৃত। তাঁদের বিশেষ পছন্দের পদ ছিল হাতে গড়া শাম্মি কাবাব। মুমতাজ মহলের রসুইতে নানা পদের অন্যতম ছিল
শাম্মি কাবাব। মুমতাজের মৃত্যুর পরে ছেলে ঔরঙ্গজেবের হাতে বন্দি অবস্থাতেও কাবাবের নেশা ছাড়তে পারেননি তাজমহলের বৃদ্ধ স্রষ্টা। অঢেল মদিরার সঙ্গে সেই কাবাবে বুঁদ হয়ে যেতে হয়।
নিজামুদ্দিন আউলিয়া আর কবি মির্জা আসাদুল্লাহ গালিবের মাজারের পাশেই খোঁজ করলে আজও পাবেন এই কাবাব। নিঝুম রাতে আজ ও এর ঘ্রাণ পেতে অনেক বাদশাহ ভূত ফিরে আসেন নাকি।
এবার কল্পনা করুন আপনাকে গুরু দায়িত্ব দেওয়া হল এই সমস্ত ইতিহাস, রোমান্স, প্রাচীন প্রবাদ, নাগরিক কাব্য মুছে ফেলার। তার জায়গায় গল্প বলতে হবে কোন এক পুরুষোত্তমের, পৌরাণিক চরিত্রদের ঐতিহাসিক চরিত্র বানাতে হবে, মগজে গুজে দিতে হবে সাম্প্রদায়িক বিষ। গাড়ির পিছনে সেঁটে দিতে হবে রাগী হনুমান। আপনি কি অন্য কোন এজেন্ডা নেবেন?
চোখ খুলে দেখুন। লাল কেল্লাকে নিলামে চড়িয়ে দেওয়ার কারণ খুঁজুন। তাজ মহলকে তেজো মহালয়া নামের কারণ খুঁজুন। কেন অচমকা সব মাংসের দোকান বেআইনি হয়ে যায়, প্রশ্ন করুন। কেন ওলা ড্রাইভারদের উদ্বুদ্ধ করা হয় রাগী হনুমানের স্টিকার লাগাতে। কেন শাম্মি কাবাবের স্টল হটিয়ে জোর করে সোয়াবিন চাপ বিক্রি করা হয়। কেন আকবর রোড, শের শাহ রোডে নামান্তরিত হবে ভাবুন। ভাবুন ভাবুন, ভাবা প্র‍্যাকটিস করুন।
আপনার বহুত্ববাদী জীবনটাকে একটা রাজমা বা সোয়ার বিনে বদলে দিতে চাইছে কিছু রাগী হনুমান। প্রভুর নির্দেশ আছে। যারা মাথা নোয়াবে না তাদের দেগে দিতে হবে হরেক বিশেষণে। ল্যাজে আগুন নিয়ে জ্বালিয়ে দিতে হবে প্রতিসংস্কৃতি, পুরানা হভেলি।
একদিন শাম্মি কাবাব বদলে যাবে সোয়া চাপে, গালিব বদলে যাবে গোলওয়ালকারজীতে। মিনারও বদলে হবে মন্দির। হাঁ, মন্দির য়েহি পে বনানো হবে। আপনি ভাববেন আচ্ছে কিছুর জন্য হচ্ছে।
কাবাব, নানরুটি, হালুয়া, গোলাপ জল, হালিম, আতর, ঘিয়ে মাখানো মায়াবী মোগলাই গন্ধ। আর ঝলসানো মাংস, ভেজা ফুল, মাজারের সামনে বিকেলবেলা জল ছেটানো সোঁদা গন্ধ দেখবেন বদলে গেছে। রাজমা, সোয়া চাপ মাখা গন্ধ কীরকম হয় জানেন?

(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)

Leave A Reply

Your email address will not be published.