মহাকরণেই সিদ্ধান্ত নিলাম মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করব। কিছুক্ষণ বাদে পিএ ঘরে এসে বললেন, ‘বিমান বসুর ফোন, কথা বলতে চাইছেন’

আগের পর্বে লিখেছি, ২০১০ সালের নভেম্বর মাসে পার্টি ঠিক করে, খেজুরি, নন্দীগ্রামের ঘরছাড়া নেতাদের এলাকায় ফেরাতে হবে। তারিখটা ঠিক হল ২৪ নভেম্বর, ২০১০। পার্টির সিদ্ধান্ত ও কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা মোতাবেক ২৪ তারিখ ভোর ৫টার মধ্যে খেজুরি পার্টি অফিসে পৌঁছে যান ঘরছাড়া কমরেডরা। তাঁদের সঙ্গে গেলেন পশ্চিম মেদিনীপুরের কমরেড প্রভাকর। তাঁদের যাওয়ার খবর এলাকায় প্রচার হওয়ার সাথে সাথে আশপাশের সমস্ত গ্রাম থেকে আমাদের অনুগামী কর্মী, সমর্থকরা পার্টি অফিসে আসার জন্য রাস্তায় বেরিয়ে পড়েন। দু-তিন ঘণ্টার মধ্যে প্রায় সাত-আট হাজার মানুষ পার্টি অফিসের সামনে জমায়েত হয়ে যান। অন্যদিকে, আমাদের ঘরছাড়া কমরেডরা ঘরে ফিরছেন, এই ঘটনা দেখে বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতারা তখন এলাকা থেকে পালিয়ে যেতে শুরু করেছেন। শুধু খেজুরি, নন্দীগ্রাম এলাকার বিরোধীরা নয়, পূর্ব মেদিনীপুরের বিস্তীর্ণ এলাকার বিরোধীদের মধ্যে সেই সময় একই আতঙ্কের অবস্থা হয় বলে জেলার বিভিন্ন জায়গা থেকে ফোনে খবর আসতে শুরু করে। যাঁরা খেজুরিতে গেছেন তাঁরাও সেখান থেকে একই খবরই দিচ্ছেন তখন।
হঠাৎ বেলা ১০ টা নাগাদ খেজুরি থেকে যে খবর পেলাম, তাতে বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো অবস্থা। ফোনে খবর এল, জেলার পুলিশ হঠাৎ করেই আমাদের জমায়েতকে ছত্রভঙ্গ করে দিচ্ছে। দীর্ঘদিন পর বাড়ি ফেরার জন্য যাঁরা পার্টি অফিসে জমায়েত হয়েছেন, তাঁদেরকে তাড়া করছে পুলিশ। এই খবর পাওয়ার সাথে সাথে আমি পশ্চিম মেদিনীপুর পার্টির জেলা সম্পাদক দীপক সরকারকে ফোন করি। বলি, আপনি কি খবর পেয়েছেন, পুলিশ আমাদের লোককে তাড়া করছে। বললাম, কী করে এটা হয়? আপনিই তো বলেছিলেন, পুলিশ ঘরছাড়াদের সাহায্য করবে বাড়ি ফিরতে। এখন তো দেখছি উল্টো। উত্তেজিত হয়ে বলেছিলাম,যাঁদের সঙ্গে আপনি কথা বলেছিলেন তাঁদের কোনও বিশ্বাসযোগ্যতা নেই? আমি আপনাকে প্রথমেই বলেছিলাম, পার্টির ঘরছাড়া নেতা, কর্মীদের নতুন করে বিপদের মুখে ঠেলে দেবেন না। আপনি জবাবে আপনাকে বিশ্বাস করার কথা বলেছিলেন। আপনাকে বিশ্বাস করেছিলাম, তার এই পরিণতি? আরও বলি, এটা কি ছেলেখেলা হচ্ছে? বারবার আপনাকে আমি বলেছিলাম, নানা ঘটনার কারণে ওই নেতাদের কোনও বিশ্বাসযোগ্যতা নেই আমার কাছে। তখন আপনি আমাকে বলেছিলেন যে, না, রাজ্য প্রশাসনের প্রধান ও পার্টির রাজ্য সম্পাদক দু’জনের সঙ্গেই আপনার কথা হয়েছে, পুলিশ-প্রশাসন কোনও খারাপ ভূমিকা নেবে না। তারপরেই ঘরছাড়াদের এলাকায় ফেরানোর এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। আপনি আরও বলেছিলেন, ২৪ নভেম্বর ঘরছাড়াদের এলাকায় ফেরানোর জন্য পার্টির একজন গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য তথা মন্ত্রীকে, যিনি পরবর্তী সময়ে রাজ্য পার্টির প্রধান পদে এসেছেন, তাঁকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তিনি পুলিশ ও ঘরে ফেরা মানুষদের মধ্যে সমন্বয় সাধনের দায়িত্ব পালন করবেন। কোনও অসুবিধাই হবে না।
উত্তেজিতভাবে টানা কথাগুলো বললাম পশ্চিম মেদিনীপুরের জেলা সম্পাদককে। যাঁর কথার ভরসায় আমি সেদিন খেজুরির ঘরছাড়াদের এলাকায় ফেরানোর ব্যবস্থা করেছিলাম। যদিও তার আগে তাঁকে বারবার না করেছিলাম এই প্রস্তাবে। সেদিন তখন তিনি আমাকে বলেছিলেন, ‘আর সর্বোপরি আমাকে যদি বিশ্বাস করিস, তাহলে আর না করিস না।’ সেদিনের এই সব কথা ওনাকে স্মরণ করিয়ে বললাম, যাঁরা সিদ্ধান্ত নিয়ে আপনাকে দায়িত্ব দিয়েছিল, তাঁরা আজ কোথায়? যাঁকে বিশেষ দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল তিনি কোথায়? তখন উনি বলেন, ‘সেই নেতা নাকি প্রশাসনিক কাজে মালদহে গিয়ে আটকে গেছেন, আর ফিরতে পারেননি সেখান থেকে।’ একথা শোনার পর ক্ষোভের সঙ্গে বলেছিলাম, এঁদের আর কোনও বিশ্বাসযোগ্যতা আছে? নতুন করে এত ঘরছাড়া মানুষকে ঘরে ফেরানো তো হলই না, তাঁদের পরিবারকেও চরম বিপদের মধ্যে ঠেলে দেওয়া হল। ওই জেলায় তৃণমূল কংগ্রেস ও মাওবাদীরা যাতে আবার তৎপর হয়ে নতুন উদ্যমে নতুন করে আমাদের উপর আক্রমণ সংগঠিত করে তারও ব্যবস্থা করা হল। সেদিন কমরেড দীপক সরকার আমার এতগুলো কথার কার্যত কোনও উত্তরই দিতে পারেননি।
সেদিন এই ঘটনার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত থাকা খেজুরির এক নেতা, যিনি তখন পূর্ব মেদিনীপুর পার্টির জেলা কমিটির সদস্য ছিলেন, বর্তমানে রাজ্য কমিটির সদস্য, তিনি এবিষয় নিয়ে এত বছরে কোনও আলোচনা বা চর্চা করেছেন কীনা আমার জানা নেই। রাজ্য প্রশাসন ও রাজ্য পার্টির সর্বোচ্চ ব্যক্তিরা কেন একাজ করলেন বা যাঁর উপরে বিশেষ দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল, তিনিই বা কেন সেদিন অনুপস্থিত থাকলেন, পার্টির অভ্যন্তরে এসব নিয়ে কোনও চর্চা হয়েছে কীনা আমার জানা নেই।
যদিও ২০১১ সালে সরকার বদল হয়েছে রাজ্যে। পার্টির তৎকালীন রাজ্য সম্পাদক ২০১৫ সালে দায়িত্ব ছেড়েছেন। আর সেই ২০১০ সালের ২৪ শে নভেম্বর খেজুরি, নন্দীগ্রামের ঘরছাড়াদের এলাকায় ফেরানোর জন্য যিনি বিশেষ দায়িত্ব ছিলেন, তিনি বর্তমানে রাজ্য পার্টির গুরুত্বপূর্ণ পদে এসেছেন। সকলের কাছেই বিনীতভাবে উক্ত ঘটনার আত্মসমীক্ষা করার জন্যই এই বিষয়গুলো নিবেদন করলাম।
সেদিনের ঘটনার পরিণতি হয়েছিল মারাত্মক। পুলিশ আমাদের লোকেদের তাড়া করছে, এখবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তৃণমূল কংগ্রেসের যে সব নেতা এলাকা ছেড়ে পালাতে উদ্যত হয়েছিলেন, তাঁরাই সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে দাঁড়িয়ে রাস্তা অবরোধ ও সিপিএম কর্মীদের উপর আক্রমণ শুরু করেন। সেদিন যদি পূর্ব মেদিনীপুর জেলার ওই কয়েকশো ঘরছাড়া মানুষ দীর্ঘদিন বাদে বাড়ি ফিরতে পারতেন, প্রশাসন যদি কোনও বাধা হয়ে না দাঁড়াতো, তাহলে সেদিনই গোটা পূর্ব মেদিনীপুরের পরিস্থিতি অন্যরকম হয়ে যেত। সেদিন সকালে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে খেজুরির মানুষের মধ্যে ঘুরে দাঁড়ানোর যে আত্মপ্রত্যয়ী বিশ্বাস দেখা গিয়েছিল, তা দেখে বিরোধীরা এলাকা ছেড়ে পালাতে তৎপর হয়ে ওঠে। যা কমরেড প্রভাকরদের থেকে আমার জানার সুযোগ হয়। কমরেড প্রভাকর সেদিন আমাকে রিপোর্ট দেন। সেই জেলায় মাওবাদী এবং তৃণমূল কংগ্রেসে বিরুদ্ধে ধারাবাহিক সংগ্রামের সঙ্গে যুক্ত থাকা অন্য একজন পার্টি নেতা, যিনি পূর্ব ও পাশ্চিম মেদিনীপুরের কমরেডদের কাছে মাস্টার নামে পরিচিত, তাঁর কাছ থেকেও আগে একই কথা শুনেছিলাম। খেজুরি, নন্দীগ্রাম এলাকার মানুষের আত্মপ্রত্যয়ী মানসিকতার কথা উল্লেখ করে সে বলেছিল, ‘পুলিশ আমাদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে নোংরা ভূমিকা পালন করছে। পুলিশের এই ভূমিকা যদি শক্ত হাতে নিয়ন্ত্রণ করা না যায় তাহলে শুধু পূর্ব মেদিনীপুর নয়, গোটা রাজ্যেই অতি দ্রুত আমাদের চরম বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে হবে। ২৪ শে নভেম্বর সকালে খেজুরিতে পুলিশ আমাদের পার্টির নেতাদের তাড়া করার খবর পাওয়ার পর কমরেড মাস্টারের সেই কথাগুলো বারবার আমার কানে বাজছিল। মাস্টার (ছদ্মনাম) এখনও পার্টিতেই আছে। কিন্তু বাস্তব হল এটাই যে, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দুই মেদিনীপুরজুড়ে যে দায়িত্ব তিনি পালন করেছিলেন, তার কোনও মূল্যায়ন পার্টিতে আজও পর্যন্ত হয়নি, বরং তিনি সংগঠনে উপেক্ষার পাত্র। তবুও আদর্শের প্রতি আনুগত্যের কারণে তিনি সিপিএম পার্টির সদস্যপদ ত্যাগ করেননি। পার্টিতেই আছেন। এঁদেরকে যদি পার্টি সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারতো তাহলে সংগঠনের পক্ষেও ভালো হোত। আমার কষ্ট হয়েছিল যেদিন শুনলাম, এই কমরেডকেই পার্টির জেলা সম্মেলনে প্রতিনিধি হওয়ারও সুযোগ দেওয়া হয়নি।
যাই হোক, সেই ২৪ শে নভেম্বর প্রশাসন যদি ঘরছাড়া মানুষগুলোকে তাড়া করতে শুরু না করত, তাহলে সেদিনই হয়তো রাজ্যে অষ্টম বামফ্রন্ট সরকার গঠনের ভিত্তি প্রস্তুত হয়ে যেত। সারা রাজ্যের মানুষ প্রত্যক্ষ করতেন, বিরোধীদের প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে নন্দীগ্রাম-খেজুরির মানুষ মাথা উঁচু করে বাড়ি ফিরেছেন। না, তা আর হল না। হলো উল্টো। পুলিশের তাড়া খেয়ে ঘরছাড়া মানুষ খেজুরির এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় পালিয়ে বেড়াতে শুরু করলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই পুলিশ সেখানে গিয়ে তাঁদের আবার তাড়া করছে। মন্ত্রী-আমলা-পুলিশ-প্রশাসন যে সরকারের, সেই সরকারের পুলিশই তাড়া করছে দীর্ঘদিনের ঘরছাড়া মানুষদের। এর চেয়ে নিষ্ঠুর পরিহাস আর কী বা থাকতে পারে? এই তাড়া খাওয়া মানুষদের কী পরিণতি হবে সেই চিন্তার মধ্যেই ফোনে প্রতি মুহূর্তের অবস্থার খবর নেওয়ার চেষ্টা করছি তখন। দিন গড়িয়ে সন্ধ্যা এল, রাতের অন্ধকার নামল। কী পরিণতি হবে এই মানুষগুলোর? পুলিশের তাড়া সাময়িক বন্ধ হল। কিন্তু এত মানুষ যাবে কোথায়? ওই জেলায় তখনও একটা জায়গা অবশিষ্ট ছিল, যা বিরোধীরা দখল করতে পারেনি। সেটা নদী ও খাল দিয়ে ঘেরা চরম একটা দুর্গম জায়গা, যার নাম শুনিয়ার চর। সেখানকার কমরেডদের সঙ্গে ঘরছাড়া কমরেডরা যোগাযোগ করেন। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দুর্গম নদী-খাল পার হয়ে, কোথাও একবুক জল ভেঙে, সাঁতার কেটে গভীর রাতে এই তাড়া খাওয়া মানুষগুলো আশ্রয়ের জন্য গিয়ে পৌঁছোন শুনিয়ার চরে। আগেই শুনিয়ার চরের মানুষরা খবর পেয়েছিলেন। তাই এঁদের জন্য যতটা সাহায্য করা সম্ভব তা  নিয়ে তৈরি হচ্ছিলেন। সারাদিনের অভুক্ত ঘরছাড়া কমরেডরা মাইলের পর মাইল পথ হেঁটে, সাঁতার কেটে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যখন শুনিয়ার চরে পৌঁছোলেন তখন তাঁদের আর দাঁড়ানোর অবস্থা নেই। মোবাইলে সেই খবরই পাচ্ছি তখন। নভেম্বরের শীত, সমস্ত জামা-কাপড় ভেজা, কোথাও নদী, খাল সাঁতরে পার হতে হয়েছে। তবু প্রাণ বাঁচাতে তাঁরা পৌঁছোলেন শুনিয়ার চরে। কারোরই পোশাক বদলানোর সুযোগ নেই। এত মানুষের জন্য বিকল্প পোশাকের ব্যবস্থা করার ক্ষমতাও ওখানকার কর্মীদের নেই। না, সেখানেও সারাদিনের এই ক্লান্তির পরে ঘুমানোর কোনও সুযোগ পেলেন না কমরেডরা। পরদিন সকাল হওয়ার আগেই ভীষণ তৎপর পুলিশ-প্রশাসন পৌঁছে গেল শুনিয়ার চরে। ঘরছাড়াদের শুনিয়ার চরছাড়া করার জন্য।
পরদিন, ২৫ নভেম্বর ছিল ক্যাবিনেট মিটিংয়ের দিন। আমি মহাকরণেই ছিলাম। সব খবর পেয়ে সিদ্ধান্ত নিলাম, আর ক্যাবিনেট মিটিংয়ে যাব না। এভাবে আর মন্ত্রিসভায় থাকা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করব। পদত্যাগ পত্র মুখ্যমন্ত্রীর হাতে দিয়ে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হব। প্রশাসনের এই ভূমিকায় ধিক্কার জানিয়ে বাড়ি চলে যাব। এমন সময় মহাকরণে আমার পাশের ঘর থেকে রেজ্জাকদা (মন্ত্রী রেজ্জাক মোল্লা) আমার ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে বললেন, ‘তুমি নাকি পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিয়ে পদত্যাগ পত্র লিখে ফেলেছ?’ আমি বললাম, আপনি কী করে খবর পেলেন? রেজ্জাকদা বললেন, ‘তোমার ঘর থেকেই খবর পেয়েছি।’ আমি বললাম, ঠিক খবরই পেয়েছেন। এভাবে আর থাকা যায় না, তাই আমি চললাম। উনি আমার হাত ধরে বললেন, ‘তুমি খুবই উত্তেজিত, হঠাৎ করে এরকম একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিও না। এতে তোমার এলাকা, তোমার জেলা সংগঠন ও সিবিআইসহ অজস্র কেসে যারা যুক্ত তারা সকলেই অসুবিধায় পড়ে যাবে।’ আরও একটা কথা বললেন, যা খুবই ভয়ঙ্কর। বললেন, ‘তুমি যদি এভাবে পদত্যাগ করে চলে যাও, তাহলে দেখবে পরের দিনই পুলিশ তোমার বিরুদ্ধে তৎপর হয়ে যাবে। এরা সবই পারে।’ আমি বললাম, সে যা হয় হবে, এভাবে মানসিক যন্ত্রণা নিয়ে চলতে পারব না। এরপর উনি বললেন, ‘আমি এক্ষুনি আসছি। আমি না আসা পর্যন্ত তুমি কোথাও যাবে না।’ এর কয়েক মিনিটের মধ্যেই পার্টির রাজ্য
সম্পাদক বিমান বসুর টেলিফোন। আমার পিএ আমাকে বললেন, ‘বিমানবাবু কথা বলবেন।’ আমি ফোন ধরলাম। উনি আমাকে বললেন, ‘তুমি নাকি মাথা গরম করে মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করে চলে যাবে, সিদ্ধান্ত নিয়েছ।’ আমি বললাম, হ্যাঁ, ঠিক জেনেছেন। অনেক কড়া কড়া কথা সেদিন ওনাকে টেলিফোনে বললাম। সেদিন আর ওনার বাকি কথা শোনার আমার মানসিকতা ছিল না। শুনতে ইচ্ছাও করছিল না। এই অবস্থাতে উত্তেজিত হয়েই ওনার ফোন কেটে দিলাম। ভাবছি, রেজ্জাকদা বললেন, এক্ষুনি আসছি, তার মধ্যেই আবার পার্টি রাজ্য দফতর থেকে ফোন আসতে আরম্ভ করেছে। আমি ফোন কেটে দেওয়ার অল্প সময়ের মধ্যেই পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা পার্টির সম্পাদক দীপক সরকারের টেলিফোন এল। ওনাকেও উত্তেজনার বশে অনেক কড়া কড়া কথা বললাম। এবার শেষের একটা কথাতে থমকে গিয়ে ফোন ছেড়ে কয়েক মিনিট চুপ করে বসে থাকলাম। তারপর তখনই মত বদল করে, মহাকরণ থেকে বেরিয়ে সোজা গাড়িতে চেপে পশ্চিম মেদিনীপুর পার্টি অফিসে চলে গেলাম।
আমার জীবনের চরম ক্ষোভ ও আক্ষেপের দিন ছিল সেটা। ওই ঘটনাতে ওই জেলার পার্টিই শুধু ক্ষতিগ্রস্থ হল তাই না, এই ঘটনার মধ্যে দিয়ে ওই জেলার বিরোধীরা প্রত্যক্ষ করল, সরকারটা বামফ্রন্টের হলেও পুলিশ-প্রশাসনে সরকারের আর কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই। পুলিশ-প্রশাসন এক কথায় বিরোধীদের পক্ষেই। এই ঘটনার পর বিরোধী দল অনেক বেশি উৎসাহ নিয়ে ওই জেলাসহ রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে ক্ষমতা দখলের প্রচেষ্টা গ্রহণ করল। মাওবাদীরাও পুলিশের ভূমিকায় অনেক বেশি উৎসাহিত হল। এই ঘটনা কখনওই সেরকমভাবে বিগত কয়েক বছরে প্রকাশ্যে আসেনি। আমার লেখায় আমি পূর্বে উল্লেখ করেছি, এনিয়ে পার্টিতে কোনও চর্চা হয়েছে বলেও আমার জানা নেই। হয়তো অন্তরালে রেখে দেওয়ার উদ্দেশ্যেই বিষয়টি চর্চার মধ্যে নিয়ে আসা হয়নি।
যদি আলোচনায় আসে তাহলে তো অনেকের বিরুদ্ধেই আঙুল উঠবে। বিষয়টি চেপে যাওয়া বা উপেক্ষার অবস্থান হয়তো এই জন্যই। এ বিষয়ে আরও কিছু কথা উল্লেখ করার থাকলেও শিষ্টাচারের কারণে তা উল্লেখ করছি না। এর জন্য পাঠকদের কাছে লেখার মাধ্যমে দুঃখ প্রকাশ করে রাখছি।
২০১০ সালের নভেম্বরের এই ঘটনার পরেই ডিসেম্বরের ১৬ তারিখ পুরুলিয়ার ঝালদা থানার বাগবিনদা গ্রামে রাতের অন্ধকারে মাওবাদীরা নৃশংস গণহত্যা সংগঠিত করে। গ্রামের সাধারণ নিরীহ মানুষকে ঘর থেকে তুলে নিয়ে এসে ওই গ্রামেরই সাত জনকে নৃশংসভাবে খুন করে রাস্তার উপর তাঁদের মৃতদেহ ফেলে রাখে। মাওবাদীরা যখন তাঁদের বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যাচ্ছিল, তখনই পরিষ্কার হয়ে যায়, কী ঘটতে চলেছে। পুরুলিয়ার মানুষ শান্তিপ্রিয়, কী হতে চলেছে বুঝতে পারলেও অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত মাওবাদীদের বিরুদ্ধে সেসময় তাঁদের কিছুই করার ছিল না। ২০০৫ সালের শেষে পুরুলিয়ার তৎকালীন জেলা পরিষদ সভাধিপতি রবীন্দ্র নাথ কর ও তাঁর স্ত্রীকে পুড়িয়ে খুন করার যে ঘটনা ঘটেছিল, ২০১০ এর ১৬ ডিসেম্বর সেই জেলাতেই আবার এরূপ নৃশংস ঘটনা ঘটল।
তার মাঝে জেলাতে অনেক ঘটনাই ঘটেছে, স্কুল শিক্ষক ও পুলিশ কর্মীদের অপহরণ করে খুন করে মাটিতে পুঁতে দেওয়া থেকে শুরু করে, পুলিশ ক্যাম্প উড়িয়ে দেওয়া বা বাম সমর্থকদের খুনের মতো অনেক ঘটনাই এই জেলায় মাওবাদীরা সংগঠিত করেছে। কিন্তু, ২০১০ এর বাগবিনদার ঘটনা হল, পুরুলিয়া জেলার ক্ষেত্রে মাওবাদী নৃশংসতার সবচেয়ে ভয়াবহ রূপ। এই নির্মম গণহত্যার উদ্দেশ্য একটাই, পুরুলিয়ায় বামেদের শক্ত ভিত ভেঙে চুরমার করে দেওয়া। তার জন্য এই ধরনের গণহত্যার খুবই প্রয়োজন ছিল। এতে গোটা জেলা ও রাজ্যের মানুষ স্তম্ভিত হয়ে যান। বিধানসভা নির্বাচনের আগের বছরের শেষ বড় ঘটনা এটাই।

(চলবে। )

Comments are closed.