নেতৃত্বের কাছের এক নেতাকে একই সঙ্গে রাজ্য কমিটি এবং সম্পাদকমণ্ডলীতে নেওয়া হল, অতীতে এমন কখনও হয়নি

নন্দীগ্রামের আন্দোলন যখন তীব্র পর্যায়ে, তখন আমার পরিচিত এক কমরেডকে প্রশ্ন করি, ওখানে এত পার্টির সদস্য, এলাকায় এত পার্টি শাখা, তা সত্ত্বেও কেন সেরকমভাবে গণ প্রতিরোধ গড়ে উঠছে না? তার উত্তরে সেই কমরেড যা বলেছিলেন, তা শুনে আমার হতবাক হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা হয়। তিনি বলেন, দায়িত্বে থাকা অনেক নেতাই পার্টি সদস্যদের থেকে এতটাই বিচ্ছিন্ন যে, তাঁদের ভরসা করতে পারেন না। পাছে তাঁদের পদ চলে যায়, সে জন্য সম্মেলনের অনেক আগেই এই নেতারা পরিকল্পনা করে নিজেদের পছন্দমতো লোককে পার্টি সভ্যের পদ দেয়। যাতে সম্মেলনে নিজেদের আধিপত্য বজায় থাকে। যার ফলে সংঘাত দেখা দেয় নতুন ও পুরানো কর্মীদের মধ্যে। নেতারা পদে থেকে যান ঠিকই, কিন্তু নতুনদের সঙ্গে পুরানোদের যে সংঘাত দেখা যায়, তার প্রতিক্রিয়ায় পুরানো সক্রিয় কর্মীদের বড় অংশই নিস্ক্রিয় হয়ে পড়ে। গণ প্রতিরোধ গড়ে তোলার ঘাটতির ক্ষেত্রে এটাও অন্যতম কারণ।
সংগঠনের ভিতরের এই ধরনের কথা পূর্ব মেদিনীপুরের নেতারা একেবারেই জানতেন না, একথা ভাবা কি ঠিক হবে? নাকি সব জানার পরেও ক্ষমতায় থাকার কারণে নেতারা এবিষয়ে নজর দেওয়ার প্রয়োজন মনে করেননি, তা আমার পক্ষে সবটা বলা সম্ভব নয়। এই সময়কালে পশ্চিম মেদিনীপুরসহ রাজ্যের জঙ্গল এলাকার জেলায় মাওবাদীদের তৎপরতা অনেকটা বেড়ে যায়। একাধারে নন্দীগ্রামের আন্দোলন, অন্যদিকে সারা জঙ্গলমহল এলাকায় মাওবাদী তৎপরতা বৃদ্ধি পাওয়া প্রশাসনের মাথা ব্যাথা বাড়িয়ে দেয়।
নন্দীগ্রামের এই পর্যায়ে বিরোধী শক্তি তাঁদের সুদূর প্রসারী পরিকল্পনায় অনেকটাই সফল হয়। এই সময় সিঙ্গুরের শিল্পায়নে রাজ্যের প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে বিরোধীরা তৎপর হয়ে ওঠে। সিঙ্গুরে শিল্পায়নের পরিকল্পনায় ওই জেলার কৃষক সভা বা পার্টি সংগঠনের সঙ্গে বোঝাপড়ার ক্ষেত্রে রাজ্য প্রশাসনের যে ঘাটতি ছিল, তা নানাভাবে প্রকাশ্যে এসে যায়। জমি অধিগ্রহণের পূর্বে সংশ্লিষ্ট দফতরকে একাজে যুক্ত করা হয়নি। বিভাগীয় দফতরের মন্ত্রী প্রকাশ্যে তা জানিয়ে দেওয়ার ফলে সমস্যা বেড়ে যায়। বিরোধীরা একে কাজে লাগায়। হুগলি জেলার পার্টি ও কৃষক সংগঠন একাজে প্রথম থেকে যুক্ত না হওয়ায় শুধুমাত্র প্রশাসন বা এক কথায় আমলা নির্ভরতায় সিঙ্গুরে কাজ চলতে থাকে। পরে অবশ্য তৎকালীন শিল্পমন্ত্রী, ভূমি রাজস্ব দফতরের বিভাগীয় মন্ত্রী ও মুখ্যমন্ত্রী সকলেই রাজ্যের শিল্পায়নের স্বার্থে নানা স্তরে বারে-বারে আলোচনার মধ্যে দিয়ে এই জটিলতা কাটিয়ে তোলার জন্য আন্তরিকভাবে সার্বিক প্রচেষ্টা শুরু করেন। সমন্বয়ে ঘাটতি ও জটিলতা যা ছিল তা পর্যায়ক্রমে কাটিয়ে তোলার চেষ্টা হয়। সিঙ্গুরে গাড়ি কারখানা তৈরি হলে ওই এলাকাসহ হুগলি জেলা ও রাজ্যের অর্থনীতির ক্ষেত্রে যে সুফল পাওয়া যাবে, তা রাজ্যের মানুষকে বোঝানোর কাজ শুরু হয়। যার ফলে মোট যে পরিমাণ জমি অধিগ্রহণ করার কথা ছিল, তার শতকরা প্রায় ৮০ ভাগ প্রকল্পের জন্য পেতে কোনও অসুবিধা হয়নি। কৃষকেরা স্বেচ্ছায় সেই জমি দিয়ে দেন। প্রথম অবস্থাতেই সিঙ্গুরের কারখানাকে কেন্দ্র করে বিরোধীরা অত্যন্ত তৎপর হয়ে ওঠে। শতকরা ২০ ভাগ জমির মালিককে সংগঠিত করে গোটা প্রকল্পের বিরুদ্ধে আন্দোলনকে সংঘটিত করার চেষ্টা শুরু করে বিরোধীরা। আন্দোলনকে এমন পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হয় যে, এক টানা ১৪ দিন ধরে দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ হাইওয়েকে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়। কলকাতা হাইকোর্ট এই অবরোধকে বেআইনি ঘোষণা করে রাজ্য সরকারকে তা তোলার জন্য, প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ারও নির্দেশ দেয়। এরপরেও দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে অবরোধমুক্ত করার ক্ষেত্রে রাজ্য প্রশাসন যথাযথ ভূমিকা পালন করতে ব্যর্থ হয়। টানা ১৪ দিন হাইওয়ে অবরুদ্ধ থাকায় গোটা রাজ্যেই এক অভাবনীয় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। আদালতের সুস্পষ্ট নির্দেশের পরও রাজ্য প্রশাসনের ভূমিকায় বহু মানুষের মধ্যেই প্রশ্ন ওঠে, রাজ্যে আদৌ সরকার আছে তো? প্রশাসন পরিচালনায় নূন্যতম দৃঢ়তা থাকলে এ জিনিস কখনও চলতে পারে না।
যেটুকু উল্লেখ করা যায় তা হল, অবরোধ যখন ৭-৮ দিন অতিক্রম করেছে, ট্রেনে, বাসে, রাস্তায় সর্বত্র তখন সরকার সম্পর্কে মানুষের তির্যক কথা বার্তা শুরু হয়ে গেছে।
তখন একদিন এক জেলা সম্পাদককে জিজ্ঞেস করেছিলাম, কী হচ্ছে? এখনই ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। তিনি তখন রাজ্য কমিটিরও সদস্য ছিলেন। কী ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে সে কথাও আমি আমার মতো করে তাঁর কাছে উল্লেখ করেছিলাম। কালক্রমে তিনি এখন পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য। আরও তিনজন গুরুত্বপূর্ণ রাজ্য কমিটির সদস্যকে আমার ভাবনার কথা ক্ষোভের সঙ্গে বলেছিলাম। তাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন হুগলির নেতা এবং রাজ্য কমিটির সদস্য। বর্তমানে তিনি দল থেকে বহিষ্কৃত। তবে অন্য কোনও রাজনৈতিক দলে তিনি যোগ দেননি। শুনেছি, জেলায় বামেদের কর্মসূচিতে সাধারণ মানুষের মতোই যোগ দেন। সে সময় দলে তাঁর প্রতি বিশ্বাস ও গ্রহণযোগ্যতা দুইই ছিল। তিনি আমার ভাবনার কথা শুনে বলেছিলেন, ‘রাজ্য প্রশাসন ও সংগঠনের নেতারা এই ধরনের প্রস্তাবে কিছুতেই রাজি নয়। অন্য দুজনের মধ্যে এক রাজ্য কমিটির সদস্য প্রয়াত হয়েছেন। আর অন্যজন তখন ভূমি সংস্কার দফতরের মন্ত্রী। তাঁকেও আমি আমার ভাবনার কথা বলেছিলাম। কিন্তু দফতরের মন্ত্রী হয়েও তিনি কিছু জানতেন না, তাঁকে কিছু জানানো হয়নি। তাঁর সঙ্গে কথা বলার প্রয়োজনই মনে করেননি প্রশাসনের সর্বোচ্চ নেতৃত্ব। এই আক্ষেপ প্রকাশ্যে ব্যক্ত করে নেতৃত্বের সমালোচনাও করেছিলেন ওই নেতা-মন্ত্রী। পরে দলত্যাগ করে তিনি এখন বর্তমান শাসক দলের মন্ত্রীও বটে। একথা উল্লেখ করার উদ্দেশ্য হল, নন্দীগ্রামকে কেন্দ্র করে সংগঠন ও প্রশাসনের যে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল, তা হয়তো সময়ের সঙ্গে প্রশাসনিক ও সাংগঠনিক প্রচেষ্টায় সামলে নেওয়া সম্ভব হোত। কিন্তু চোখের সামনে তৈরি হওয়া কয়েক হাজার কোটি টাকার গাড়ি প্রকল্পের কাজ ৯০ শতাংশ শেষ হয়ে যাওয়ার পরেও (যখন আর একমাস পরে পুরোদমে উৎপাদন শুরু হবে) সেই সংস্থা তা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হল। কেন প্রশাসন যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করল না, মানুষের মধ্যে এই প্রশ্ন জোরালো হল।
সাধারণভাবে প্রশাসন তখন নীরব দর্শক। অন্যদিকে, যিনি রাজ্যের সাংবিধানিক প্রধান হয়েও, নন্দীগ্রামের ঘটনাকে ‘হাড়হিম’ করা বলে সরকারের তীব্র সমালোচনা করতে দ্বিধা করেননি, সিঙ্গুর সমস্যার সমাধানের জন্য তাঁকেই মধ্যস্থতাকারী মানতেও আমাদের দ্বিধা হল না? কীসের প্রয়োজনে? ব্যক্তির স্বচ্ছ ইমেজ বজায় রাখার জন্য, নাকি রাজ্যের শিল্প-অর্থনীতির ভিত্তি মজবুত করার জন্য, তা রাজ্যের বহু মানুষেরই বোধগম্য হয়নি। সিঙ্গুরের গাড়ি প্রকল্প সুদূর গুজরাতের সানন্দে স্থানান্তরিত হয়ে চলে গেল। আপামর রাজ্যবাসী উপলব্ধি করলেন, সরকারের পক্ষে ২৩৫ এর গরিমা, প্রকল্পের ৮০ ভাগ জমিদাতার সহযোগিতা এবং কলকাতা হাইকোর্টের সুস্পষ্ট নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও যে সরকার তৈরি কারখানাকে রক্ষা করতে পারে না, তাদের পক্ষে কীভাবে মানুষের জন্য কাজ করা সম্ভব? সরকারের ভূমিকা নিয়ে তখন এই প্রশ্ন উঠতে আরম্ভ করল।
এর উত্তরের জন্য অবশ্য আর বেশি দিন অপেক্ষা করতে হয়নি। ২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচনেই সেই উত্তর দিলেন রাজ্যের মানুষ। প্রশাসনের ভূমিকার পাশাপাশি পার্টির সংগঠনেও যে গুণগত পরিবর্তন দেখা দিয়েছিল, তাও কিছুটা উল্লেখ না করলে অপূর্ণতা থেকে যাবে। নন্দীগ্রাম আন্দোলনে সংগঠনের কিছু বিচ্যুতির কথা এর আগে বলেছিলাম। ২০০৬ সালের প্রথমের দিকে, বিধানসভা নির্বাচনের পূর্বে হঠাৎ করে রাজ্য সম্পাদক অনিল বিশ্বাসের মৃত্যুতে রাজ্য পার্টিকে এক অপূরণীয় ক্ষতির মধ্যে পড়তে হয়। সংগঠন তার নিজস্ব নিয়মে চলবে, আন্দোলন সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে সংগঠনের যেমন বিকাশ ঘটবে, ঠিক তেমনই প্রয়োজনে প্রশাসনকে পরামর্শ দেবে। পার্টি কখনও প্রশাসনের লেজুরবৃত্তি করবে না, এটাই বাম সংগঠনের প্রথা। আমরা নেতাদের কাছে শিখেছিলাম, বামপন্থীদের কাজে যদি বিরোধী প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি কঠোর সমালোচনা করে, তাহলে বুঝতে হবে, এই সংগঠন বা নেতারা সঠিক পথে চলছেন। আর যদি প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি আমাদের নেতা বা সংগঠনের প্রশংসা করেন, তাহলে বুঝতে হবে, সংগঠনের ভুল বা নেতাদের পদস্খলন হচ্ছে।
২০০৬ সালের বিধানসভা ভোটের পর উপলব্ধি করতে শুরু করলাম, এসব প্রচলিত ধারা বদলে যাচ্ছে। আগের মুখ্যমন্ত্রীর জমানার কাজকর্ম সঠিক ছিল না, বর্তমানে সঠিকভাবে সব কাজ চলছে, এমন প্রচার তো সংবাদমাধ্যমে, বিশেষ করে একটি বড় সংবাদ হাউসে খুব পরিকল্পনা মাফিক প্রচার করা হতে থাকে। এমনকী সেই সংবাদমাধ্যম তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রীকে ওই সময় ‘ভারতবর্ষের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডর’ বলে প্রচার করারও সাহস দেখালো। এই বুর্জোয়া কাঠামোর মধ্যে যেখানে প্রশাসনের সব ক্ষমতাই এক কথায় রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণের মধ্যে, যেখানে প্রতি নিয়ত রাজ্যের প্রতি বঞ্চনা, যেখানে বিপ্লব ছাড়া পরিস্থিতির আমূল পরিবর্তন সম্ভব নয়, সেখান একটি রাজ্যের প্রশাসন ও তার বামপন্থী নেতাকে কেন ব্র্যান্ডের তকমা দেওয়া হচ্ছে তার গভীরে যাওয়ার কোনও প্রচেষ্টাই হল না! উল্টোদিকে আমাদের যা যা করণীয় ছিল, তা করা হল না। সেই সময় থেকে সংগঠনের অভ্যন্তরে পছন্দ-অপছন্দের গুরুত্ব বাড়ছিল। প্রশাসনের অন্দরে ক্রমে আমলাতন্ত্রের প্রাধান্য ক্রমবর্ধমান হচ্ছিল। আর তখন আমাদের অবস্থান কতকটা ‘dont care’ গোছের।
এই সময়কালে পশ্চিমবঙ্গের সংখ্যালঘু, বিশেষ করে মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে বহু বছর ধরে পার্টির যে দৃঢ় ভিত্তি ছিল, তাতে কিছুটা পরিবর্তন লক্ষ্য করা যাচ্ছিল। মুসলিম মৌলবাদীদের একটা অংশ তৎপর হচ্ছিল। ওদের মধ্যে নানা সামাজিক সংগঠন নতুন নতুনভাবে বামফ্রন্টের বিরুদ্ধে ওই অংশের মানুষকে সংগঠিত করার চেষ্টা করছিল। সেই সময় বামফ্রন্টের বিরুদ্ধে ওই অংশের মানুষকে সংগঠিত করতে যারা চেষ্টা করছিল, যারা এই কাজে অত্যন্ত তৎপর ছিল, কলকাতায় অবস্থিত মার্কিন দূতাবাসে তাদের যাতায়াতও বেড়ে যায়। যা সেই সময়কার সংবাদমাধ্যমেও খবর হিসেবে আসে ও রাজ্যের মানুষ জানতে পারেন। ওই সময় সংখ্যালঘুদের মধ্যে আমাদের ভিত্তি যাতে নষ্ট না হয়, আমাদের সমর্থনের ভিত্তিতে যাতে ফাটল না ধরে তার জন্য আমাদের পার্টিগতভাবে যে প্রচেষ্টা থাকার কথা ছিল, তাতেও যথেষ্ট ঘাটতি দেখা দেয়। এই ঘাটতি কাটানোর জন্য সেই সময় বিধানসভায় বামফ্রন্টের মুখ্য সচেতক, বর্ধমান জেলা পার্টিরও তিনি নেতা এবং তৎকালীন ভূমি রাজস্ব দফতরের মন্ত্রী একটা আলোচনা করেন। এই আলোচনার প্রেক্ষিতে ভূমি রাজস্ব মন্ত্রী তৎকালীন পার্টির রাজ্য সম্পাদকের সাথে কথা বলেন। এরপর ওই বিষয় নিয়ে একটি সভা করার প্রয়োজনীয়তার কথা ভূমি রাজস্ব মন্ত্রী আমাকে বলেন। আমাকে বলার কারণ, মহাকরণে আমরা দু’জন পাশাপাশি ঘরে বসতাম। যখন আমি শুধুমাত্র বিধায়ক ছিলাম তখন থেকেই তাঁর সঙ্গে আমার ভালো সম্পর্ক ছিল। সংগঠন নিয়ে নানা ধরনের আলোচনা দু’জনের মধ্যে হোত। উনি আমাকে যখন আলোচনায় বসার কথা বলেন, আমি বলি, কোথায় বসবেন? উনি বলেন, ‘মহাকরণে তো বসা যাবে না। তোমার যদি আপত্তি না থাকে তাহলে তোমার কলকাতার বাসায় বসার ব্যবস্থা করা গেলে ভালো হয়।’ আমি এক কথাতেই রাজি হয়ে যাই।
আমার মিন্টো পার্কের সরকারি আবাসনে পরপর ২-৩ টি মিটিং করা হয়। এই সভাতে বিধানসভার মুখ্য সচেতক এবং ভূমি সংস্কার মন্ত্রী ছাড়াও মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষের কাছে সারা রাজ্যে যথেষ্ট পরিচিতি এবং প্রভাব আছে, যিনি সারা রাজ্যেই সংখ্যালঘু এলাকায় বাৎসরিক ধর্মীয় জলসায় বক্তা হিসেবে একেবারে সামনের সারিতে থাকেন এমন একজনও উপস্থিত ছিলেন। বর্ধমান জেলার এই মানুষটি অনেকাংশে চিন্তাভাবনার দিক দিয়ে প্রগতিশীল মানসিকতাকেই প্রাধান্য দেন। শিক্ষার দিক থেকেও উনি উচ্চ শিক্ষিত। উনি নিজে বর্ধমান জেলার মেমারিতে একটি বড় আবাসিক বিদ্যালয় স্থাপন করেছেন। ঘটনাচক্রে ওই বিদ্যালয়ের উদ্বোধনের জন্য উনি আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। তখন আমি তাঁকে বলেছিলাম, জেলা পার্টি না চাইলে আমি তো নিজের ইচ্ছায় অন্য জেলায় যেতে পারব না। আরও বলি, রাজ্যে শিক্ষা দফতরে অনেক মন্ত্রী আছেন, তা সত্ত্বেও স্কুলের উদ্বোধনে কেন আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হচ্ছে? উনি এর একটা ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। পরে জেলা পার্টির চিঠিও আমাকে পাঠান। সেদিনের সেই অনুষ্ঠানে ওই জেলার পার্টির ও জনপ্রতিনিধিদের অনেকেই উপস্থিত ছিলেন। সেদিন ওনার আন্তরিকতাপূর্ণ ব্যবহার, বিদ্যালয় গড়ে তোলার দৃষ্টিভঙ্গির স্বচ্ছতা সম্পর্কে জেনে এক কথায় আমি অভিভূত হই। এই মানুষটি আমার বাড়ির মিটিংয়ে একাধিকবার যোগ দেন। আলোচনার মধ্যে দিয়ে রাজ্যের সংখ্যালঘুদের মধ্যে বিভ্রান্তি কীভাবে কাটানো যাবে, আমরা পার্টিগতভাবে কী ধরনের কর্মসূচি নেব, সে বিষয়ে একটি নোট তৈরি করা হয়। তারপর সেই নোট তৎকালীন ভূমি রাজস্বমন্ত্রী মারফত দলের রাজ্য সম্পাদককে দেওয়া হয়। পরে মুখ্য সচেতক এবং ভূমি সংস্কার মন্ত্রীর কাছে খোঁজ নিয়ে জানতে পারি, সেই নোটটির আর কোনও খবরই নেই। ওই পর্যায়ে পার্টিগত তৎপরতার ঘাটতিতে সংখ্যালঘুদের সমর্থনে দ্রুত ক্ষয় হতে থাকে। পরবর্তীতে সেই ক্ষয় আর রোধ করা যায়নি।
কেন লিখলাম এই সব কথা? ২০০৬ সাল পর্যন্ত এক নেতা রাজ্য কমিটির সদস্যও ছিলেন না, তাঁকে ২০০১ এ মন্ত্রিসভায় নেওয়ার পরেও ২০০৪ সালে সেখান থেকে সরিয়ে পার্লামেন্টে পাঠিয়ে দেওয়া হল সারা ভারতে সংগঠনের কাজের জন্য। ওই কমরেড অনেকগুলি ভাষায় সাবলীলভাবে ভাষণ দিতে পারতেন, তাঁকে দিল্লি পাঠানোর এটাও একটা কারণ। কেন্দ্রে কাজ করার সুবাদে তিনি কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হয়েছিলেন, কিন্তু রাজ্য কমিটির সদস্য হতে পারেননি। ২০০৬ সালের পর সেই নেতাকেই হঠাৎ করে রাজ্য কমিটিতে কো-অপ্ট (যুক্ত) করা হল। সেই একই দিনে রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীরও সদস্য হয়ে গেলেন তিনি। সেই মুহূর্তে রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীতে পদ খালি ছিল না, কিন্তু তাতে কী? নেতাদের পছন্দ তাঁকে, তাই সম্মেলন পর্যন্ত অপেক্ষা করার কী প্রয়োজন! অতএব রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর একজন বর্ষীয়ান সদস্যকে পদত্যাগ করিয়ে জায়গা খালি করে একদিনের মধ্যে পছন্দের নেতাকে পদ দেওয়ার ব্যবস্থা করা হল। এ কি কম কথা? বামপন্থী সংগঠনে এই ধারা অতীতে কেউ কখনও দেখেছেন বলে আমার মনে হয় না। আবার সেই নেতা একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের। এই লেখার মধ্যে দিয়ে সেই কমরেডকে ব্যক্তি হিসাবে কোনও সমালোচনা করতে চাই না। সেই কমরেডের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক খুবই ভালো। আমি শুধুমাত্র শিষ্টাচার বজায় রেখে সংগঠন পরিচালনার সার্বিক ত্রুটি উল্লেখ করতেই এই ঘটনার কথা বললাম। সেই কমরেডকে কোনওভাবে আঘাত করার জন্য নয়। ওই সম্প্রদায়ের মধ্যে আরও অনেক যোগ্য নেতা থাকলেও, তাঁরা পছন্দের নয় বলে রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলী তো দূর, রাজ্য কমিটিতেও তাঁদের জায়গা হয়নি। কেউ হয়তো রাজ্য কমিটিতে দীর্ঘদিন আছেন, তাঁর যোগ্যতা রয়েছে। কিন্তু সুভাষদার কথা টেনেই বলতে হয়, মানুষের ভালোবাসা থাকলেও তা যোগ্যতার মাপকাঠিতে পছন্দ-অপছন্দের কাছে চাপা পড়ে যায়। এরকম অনেক কথাই উল্লেখ করা যায়, কিন্তু তা শুধুই বর্তমান নেতৃত্বের বিড়ম্বনা বাড়াবে, তাই আর বেশি আলোচনায় যাব না। পরবর্তী পর্বে শুধুমাত্র আর একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করব।

(চলবে)

Comments are closed.