ধর্মীয় নয়, অর্থনৈতিক কারণেই ঘটানো হয় দাঙ্গা

সম্প্রতি আসানসোলে ঘটে যাওয়া দাঙ্গা নিয়ে কিছু কথা। পুত্রহারা ইমাম ইমদাদুল্লাহ রশিদির বিচক্ষণতায় সঙ্ঘ কর্তৃক বানানো আসানসোল-দাঙ্গার ব্লুপ্রিন্ট তছনছ হয়ে যায়। তার মানে কিন্তু এই নয় যে, পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতে আর দাঙ্গা হবে না।

একশো বছর পিছিয়ে যদি আমরা ১৯১৮ ও ১৯২৬ সালে প্রবেশ করি, তাহলে দেখব সেই দাঙ্গার পিছনে ছিল সমষ্টিগত উগ্রতা, যার লক্ষ্য প্রধানত শ্রেণিগত ও ঔপনিবেশিক নিপীড়ন এবং সেখানে ইংরেজ সরকারের ভূমিকা ছিল এখনকার বিজেপির মতোই।

মারওয়াড়ি ব্যবসায়ী থেকে মুসলমান কশাই কিংবা হিন্দু গোয়ালারা প্রত্যক্ষভাবে অংশ নিয়েছিল ১৯৪৬ সালের দাঙ্গায়। মুসলিম লিগের প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবসকে কেন্দ্র করে এই হাঙ্গামার সূত্রপাত, পরে তা অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে। দাঙ্গায় মুসলিম লিগের ভূমিকা
সবচেয়ে বেশি ছিল, এই কথা যেমন জানা যায়, তেমনি জানা যায়, কংগ্রেস ও হিন্দু মহাসভা চেয়েছিল, দাঙ্গার আগুন ভয়ঙ্কর ভাবে ছড়িয়ে পড়ুক যাতে লিগ সরকারকে বরখাস্ত করা এবং গভর্নরের শাসন জারির পথ মসৃণ হয়। ব্রিটিশ কর্মকর্তাদের
ভূমিকাও ছিল অত্যন্ত ন্যক্কারজনক। স্বাধীনতার ঠিক প্রাক্কালে এই দাঙ্গা ভারতের রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িকতাকে পাকাপাকিভাবে স্থান করে দেয়। গোপাল পাঁঠা থেকে গোলাম রসুলরা যে জন্য আজও ‘স্মরণীয়’। মার্কিন সৈন্যদের কাছ থেকে মারওয়াড়ি ব্যবসায়ীরা বন্দুক গুলি কিনে দাঙ্গায় সরবরাহ করে, অন্য দিকে বাংলার প্রধানমন্ত্রী সুহরাবর্দি মুসলমানদের বাঁচানোর জন্য নিজেই পুলিশের কন্ট্রোল রুমে উপস্থিত ছিলেন।

স্বাধীনতার পরের দাঙ্গাগুলো কিন্তু এত সহজ পথে ঘোরাফেরা করেনি। ১৯৬৪ সালে পূর্ববঙ্গে (তখন পূর্ব পাকিস্তান) হিন্দু জনগোষ্ঠীকে পাকাপাকিভাবে উৎখাত করার জন্য শুরু হয় গণহত্যা। এর পেছনে মূল লক্ষ্য ছিল অর্থনৈতিক অঙ্ক। প্রচারের অস্ত্র ছিল জম্মু কাশ্মীরে হজরত বাল মসজিদে নবির মাথার চুল চুরি হয়েছে। দলে দলে পশ্চিমবঙ্গে পূর্ববঙ্গের হিন্দুদের ঢল নামে। ১৯৮৯ সালে যদি ভাগলপুরের দাঙ্গার দিকে চোখ ফেরাই, তাহলে দেখা যাবে, এক মাস ধরে সেখানে মুসলমান নিধন হয়েছে। ভাগলপুরে রেশমের বস্ত্র তৈরি হত। হস্ত ও বিদ্যুৎচালিত তাঁত থেকে এই কাপড় বানাতেন মূলত মুসলমান উনারা।

দাঙ্গার পিছনে লোকধর্ম বলে কিছু থাকে না। সংঘবদ্ধ যে ধর্ম তার ভূমিকা রাজনীতির সঙ্গে মিশে জনগণের আবেগে ঢেউ দিলেও দাঙ্গার মূল কারণ কখনই ধর্ম নয়। অর্থনীতি। যেখানে যত দারিদ্র, সেখানে তত শনি মন্দির গজিয়ে ওঠে, যেখানে
যত কর্মহীনতা সেখানে তত ঝাঁ চকচকে মাজারের রমরমা। অর্থাৎ অর্থনীতির এখানে দুটি মুখ—একটি জনগণের, অন্যটি সরকার এবং সরকারঘনিষ্ঠ ধনী ব্যবসায়ীদের অর্থনীতি। আসানসোলের দিকে যদি আমরা নজর দিই, তাহলে দেখব, এই অঞ্চল
আদিতে ছিল ঘন জঙ্গল, বাস করতেন আদিবাসিরা, যে জঙ্গল-জনপদের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হত সদাপুষ্ট দুই নদী। দুর্ভাগ্যক্রমে সেখানে কয়লাখনি আবিষ্কৃত হল। জঙ্গল কেটে সাফ করা হল, এল বৃহৎ পুঁজি আর সর্বহারা শ্রমিক। কে প্রথমে এসেছিল এই জনপদে, মারওয়াড়ি না বাঙালি নাকি বিহারি—সেই প্রশ্ন অবান্তর। গত দেড়-দুশো বছরে আসানসোলের সমাজ হল বহু ধর্ম, বহুভাষী এবং নানা সংস্কৃতির। ১৯৯২ সালে, যখন বাবরি মসজিদ ধ্বংস করে বিজেপি, সেই সময়ও আসানসোলে দাঙ্গার চেষ্টা করা হয়। মুসলমান জনবসতি তুলে জমির মালিকানা ছিল যার লক্ষ্য। প্রথমেই হত্যা করা হয় একজন মুসলমান দর্জির ছেলেকে। বলা হয়, ছেলেটি নাকি একটি হিন্দু মেয়ের সঙ্গে প্রেম করত, এই ‘অপরাধ’-এ তাকে খুন করা হয়েছে। দাঙ্গাবিরোধী মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় সেই দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়েনি আসানসোলে। কিন্তু ২০১৮ সালে ছড়িয়ে পড়ল রামনবমীর মিছিলকে কেন্দ্র করে। সেই মিছিলে স্থানীয় মানুষ ছিল না বললেই চলে। মুসলমান পাড়ার ভিতরের অলিগলি দিয়ে তারা মিছিল নিয়ে যায় এবং নিজেদের মিছিলে নিজেরাই ইটপাটকেল ছুঁড়ে মুসলমান বস্তিতে আগুন লাগিয়ে দেয়। এই বারে কিন্তু তারা কোনও দর্জির ছেলেকে খুন করে না, হত্যা করে ইমামের পুত্রকে, যাতে দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়তে পারে দ্রুত। কোবরা পোস্টের স্টিং অপারেশনে দেখা গিয়েছে, বহু কোটি টাকা লগ্নি করা হয়েছিল এই দাঙ্গা সংগঠনে। কিন্তু বিচক্ষণ ইমাম রশিদি সেই দাঙ্গার আগুনে জল ঢেলে দেন। নইলে আসানসোলের মুসলমানদের দুর্গতির অন্ত থাকত না। বার বার যে সংঘীরা এমন ভাবে ব্যর্থ হবে, এ কথা ভাবার কোনও যুক্তিগ্রাহ্য কারণ নেই।

টাটা-ধানবাদ- কলকাতার ঠিক মধ্যে হল আসানসোল শহর। বৃহৎ ব্যবসাকেন্দ্র। বিজেপির দাঙ্গার যে পরিকল্পনা, তা হল বাজার দখল। নতুন ব্যবসায়ীদের তারা আসানসোলে ঢোকাতে চায়। সেই জন্য পদাতিক সৈন্য আসছে তাদের জায়গা করে দিতে। নতুন ব্যবসায়ীদের টাকায় বিজেপি পশ্চিমবঙ্গে রাজনীতি কিনতে চাইছে বলেও অনেকে মনে করছেন। রাজনীতিবিদরা কিন্তু জানেন, আসানসোল নিদারুণ জলকষ্টে ভোগে, দুটি নদী থাকা সত্ত্বেও। শহরের বাইরে শহরের আয়তনের সমান আবর্জনার
স্তুপ। নদীতে ভাসছে নোংরা, নগরায়ণের নামে কেটে ফেলা হচ্ছে হাজার হাজার বৃক্ষ। মাত্রাছাড়া দূষণের শহর আসানসোলে এখন দাঙ্গায় ভরসা। বিশেষজ্ঞরা বলতে পারবেন, পরের দাঙ্গা কোথায় হবে! সোশাল মিডিয়ায় বিজেপির আইটি সেল সেই সংকেত তাঁদের দিয়ে দেবে।

এই দাঙ্গার চেষ্টা চলতে থাকবে ২০১৯ পর্যন্ত। সামান্য হলেও মুসলমানরা শিক্ষায় এগিয়ে আসছেন, তৈরি হচ্ছে মধ্যবিত্ত শ্রেণি। জমির মালিকানার চিত্র অল্প বদল হলে সংঘ পরিবার বোঝাতে পারবে, হিন্দুদের দারিদ্রের জন্য, কর্মহীনতার জন্য দায়ী
মুসলমান। শাসক দলের নরম হিন্দুত্ব তাদের সাহায্য করছে ভীষণ। এই নরম হিন্দুত্ব এবং মুসলমান-মসিহা সাজার ভোট রাজনীতিতে আখেরে ক্ষতি হবে শাসক দলেরই। সরকার বাম ও কংগ্রেস দলকে আসানসোলে ঢুকতে দিল না। কিন্তু বিজেপিকে ছাড়পত্র দেওয়া হল। রাজ্যপাল দাঙ্গাপীড়িত আসানসোলে গেলেন, বেছে বেছে হিন্দু পাড়ায় শুনলেন সব কথা। স্থানীয় টিএমসি সাজল মুসলমানদের মসিহা। অথচ পুলিশ খবর পাওয়ার পর দেরি করে গেল অকুস্থলে। সবটাই যেন এক বড় পরিকল্পনার অংশ—হে ঈশ্বর তোমার লীলে কে বুঝিতে পারে!

Leave A Reply

Your email address will not be published.