গ্যালিফ সাহেব ছিলেন টোল কালেক্টর। গ্যালিফ স্ট্রিট এখন মাছ, কুকুর, খরগোশ, পাখি, ফুলের শখের হাট

বাড়িতে কি পোষ্য আছে? মানে রঙিন মাছ, কুকুর, খরগোশ অথবা রঙ বেরঙের পাখি!
কিংবা বাড়ির ছাদে বা বারান্দায় টবে গাছ পরিচর্যা করেন?
নিজের পরিশ্রমে গড়ে তুলেছেন ছোটখাটো বাগান? বাঙালি তো এসব ব্যাপারে আবার বেশ শৌখিন। বনেদিয়ানা হোক বা হালফিলের কর্পোরেট কালচার, সব কিছুর সাথে কিন্তু পোষ্যের ব্যাপারটা কোথাও না কোথাও জড়িয়ে রয়েছে। মধ্যবিত্ত বাঙালি থেকে নিম্নবিত্ত বহু মানুষের মধ্যেই বাড়িতে পোষ্য রাখার একটা ব্যাপক প্রবণতা রয়েছে।
বাড়িতে পোষ্য আছে, অথচ গ্যালিফ স্ট্রিট যাননি এরকম বাঙালির দেখা মেলা ভার।
আজ্ঞে হ্যাঁ, গ্যালিফ স্ট্রিট!
ঘটনাচক্রে সপ্তাহের একদিন, শুধুমাত্র রবিবার এই পোষ্যের হাট বসে। আগে অবশ্য পোষ্যের হাট বসতো হাতিবাগানের রাস্তাজুড়ে, রবিবার মোটামুটিভাবে অবরুদ্ধ থাকত হাতিবাগানের রাস্তা। শহরের এই ব্যস্ততম রাস্তাকে মুক্ত রাখার জন্য, আর পোষ্যপ্রেমীদের কথা মাথায় রেখে এই হাট উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় গ্যালিফ স্ট্রিটে। শ্যামবাজার পাঁচ মাথা মোড় থেকে বিটি রোডের দিকে কিছুটা গেলে বাঁ দিকে সার্কুলার ক্যানালের ঠিক পাশের সরু রাস্তাটাই হল গ্যালিফ স্ট্রিট।

কিন্তু প্রশ্ন হল, এই রাস্তাটার নাম কেনই বা হল গ্যালিফ স্ট্রিট?
ইংরেজি শব্দ GALIFF নামে কোনও ইংরেজ সাহেব ছিলেন কিনা, সে বিষয়ে খোঁজ করা খানিকটা জটিল। কারণ, যত সমস্যা এই GALIFF বানানটি নিয়ে। কলকাতা পুরসভা বা ট্রাম কোম্পানিও তার বোর্ডে ‘GALIFF’ বানানটিই ব্যবহার করেছে। অনেক অনুসদ্ধানের পর ইতিহাসের পাতা ঘেঁটে জানা গেল, এই ‘GALIFF’ নামে একজন ভদ্রলোক ছিলেন, যাঁর নামের বানানটি ছিল ‘GALIFFE’। ১৯১৫ সালের কলিকাতার স্ট্রিট ডাইরেক্টরিতে গ্যালিফ সাহেবের নাম উল্লেখ করা হয়েছিল, যিনি পেশায় ছিলেন কলকাতার টোল কালেক্টর। আবার ‘The Life of Grish Chunder Ghose’ নামক বইটিতে গিরিশ ঘোষের এক চিঠির উল্লেখ রয়েছে, যেখানে নিজের ভাইকে লেখা চিঠিতে তিনি বলেছেন, ‘You doubtlessly have seen from the Patriot’s Register of News that Mr. Galiffe, late Superintendent of Police, has got the Canal Collectorship’। অর্থ্যাৎ, গ্যালিফ সাহেবের নামানুসারে এই রাস্তার নামকরণ হয়েছিল। গঙ্গা থেকে যে নৌকাগুলো ক্যানালে প্রবেশ করত, তার থেকে টোল আদায় করা হত এবং যিনি এর দায়িত্বে ছিলেন তিনি হলেন গ্যালিফ সাহেব।
গ্যালিফ স্ট্রিটে প্রবেশ করলে গঙ্গার হাওয়াটা অনুভব করা যেতেই পারে যদি কাকভোরে পৌঁছানো যায়। কাকভোরে গেলেই দেখা যাবে একে একে পসরা সাজাতে শুরু করেছেন বিক্রেতারা, যাদের মধ্যে অনেকেই দূর-দূরান্তের জেলা থেকে আসেন। কেউ আসানসোল, কেউ মেদিনীপুর, কেউ বা আসছেন দুর্গাপুর,পুরুলিয়া, সুন্দরবন থেকে। মোটামুটিভাবে ৬-৬.৩০টা নাগাদ ক্রেতারা আসতে থাকেন আর ১০.৩০–১১ টা নাগাদ গ্যালিফ স্ট্রিটের ভিড়ে পা ফেলার জায়গা থাকে না। প্রায় ৩ টে পর্যন্ত হাটে কেনাবেচা চলে। এখন অবশ্য হাটের নাম দেওয়া হয়েছে ‘বাগবাজার শখের হাট’।

রাস্তার দু-পাশ দিয়ে সারিবদ্ধভাবে বসে থাকেন ব্যবসায়ীরা। কী নেই সেখানে? মানে আপনি কি পোষ্য কিনতে চান? হ্যাঁ, অবশ্য বাঘ, ভাল্লুক চাইলে হয়ত পাবেন না। হাটে সব থেকে বেশি আসে পাখি। যে পাখি বেশি চোখে পড়ল তা হল বদরী পাখি, দাম প্রায় ৩০০-৩৫০ টাকা জোড়া। জাভা স্প্যারো কিনতে গেলে আপনার পকেট থেকে খসবে মাত্র ১২০ টাকা। হাঁস, মুরগির বাচ্চা তো অহরহ বিক্রি হচ্ছে। কলকাতা শহরে টার্কির চল এখন প্রচুর, তাই বিক্রিও বেড়েছে। টার্কি দেখতে অনেকটা মুরগির মতো, কিন্তু মুরগির থেকে আকৃতিতে অনেকটা বড়। তারও দেখা মিলল এই হাটে। টার্কির দাম প্রায় ৩০০ টাকা জোড়া। লক্কা পায়রাও আছে, যার দাম ১২০০ টাকার কাছাকাছি। ককটেলের নাম শোনা আছে? মানে ককটেল পাখি, যার দাম শুনলে মাথা একটু ঘুরে যেতেই পারে! ককটেল পাখির দাম প্রায় হাজার দুয়েক টাকা। কিন্তু শৌখিন বাঙালি এই হাটে এসে কৃপণতা করে না। আসলে এটা একটা নেশা মাত্র, শখও বলা যেতে পারে, এমনটাই জানালেন প্রবীরবাবু। প্রবীরবাবুর ছেলেবেলাটা কেটেছে বাগবাজারে, এখন অবশ্য লেকটাউনে থাকেন। পাখি কেনা ওনার নেশা একটা। প্রতি রবিবার সকালে নিয়ম করে হাটে আসেন তিনি। কিছু কেনেননি, অথচ হাটটা ঘুরে বেড়িয়েছেন মাত্র, এমন দিনও গেছে। এখন অবশ্য অল্প বয়সী ক্রেতার সংখ্যাও অনেক। এই হাট যেন তাঁর কাছে অক্সিজেনের মতো, জানালেন প্রবীর চৌধুরী।

কুমারটুলির বাসিন্দা রেখা বসাক, অনেকদিন হল কলকাতা ছেড়েছেন। ছোটবেলায় বাবার হাত ধরে হাটে আসা শুরু। আর কলকাতা এসেই নিজের মেয়েকে সঙ্গে করে বেরিয়ে পড়েছেন হাট দেখতে। সেদিন আর এদিনের মধ্যে বিশেষ তফাত তিনি দেখতে পেলেন না, কিন্তু সেই প্রাণবন্ততার অভাববোধ একটু হলেও করছেন, জানালেন রেখাদেবী।
মানুষের সব থেকে প্রিয় পোষ্যটি হল কুকুর। সেটিও এখানে রয়েছে বিক্রির জন্য। কিন্তু দাম শুনলে হয়তো চক্ষু চড়কগাছ হতেও পারে। যেমন, স্পিটজ কিনতে চাইলে আপনার খরচ হতে পারে ৫০০০-৮০০০ টাকা। ল্যাব্রাডার চাই? তাও পাবেন, দাম মোটামুটিভাবে ১২০০০-১৫০০০ টাকার মধ্যে। আবার ৬ টা দু-হাজার টাকার নোটের বিনিময়ে আপনার হাতে চলে আসবে ডোবারম্যান। তাছাড়াও রয়েছে ডালমেশিয়ান, লাসা, গোল্ডেন রিট্রিভার। কিন্তু কুকুর না চিনলে ঠকে যাওয়ার সম্ভবনাও প্রবল, অকপট স্বীকারোক্তি সুমিতবাবুর। যিনি একবার কুকুর কিনতে গিয়ে ঠকেছিলেন।

অন্যদিকে, খরগোশ, ইঁদুরও বিক্রি হচ্ছে। খরগোশের জোড়ার দাম ২৫০ টাকা। সাদা ইঁদুরের দাম ১০০-২০০ টাকা জোড়া। আবার একপ্রকার ইঁদুর আছে যার নাম নাইজেরিয়ান ইঁদুর, দামও সাধ্যের মধ্যে, মাত্র ২৫০ টাকা জোড়া।
হরেকরকমের গাছ দেখতে বা কিনতে চাইলে এখানে আপনাকে আসতেই হবে। ডালিয়া, জবা ,হরেক রকমের গোলাপ, নয়নতারা কী নেই এখানে? কিংবা সব্জির গাছের চারা চাই? তাও আপনি পেয়ে যাবেন। গাছ পরিচর্যা করার জন্য সব রকমের সারের বিক্রির ব্যবস্থাও রয়েছে এখানে।

মাছেরও প্রচুর ভ্যারাইটি। রঙ বেরঙের মাছ দেখলে আপনি হতবাক হতেও পারেন। আপনাকে শুধু পছন্দ করতে হবে, দাম বলবেন বিক্রেতা মশাই। যেমন ধরে নিন, আপনাকে প্যারোটের কথা বলা হল, আপনি ভাববেন হয়ত মাছ বিক্রেতাও পাখির কথা বলছেন! তাহলে মশাই আপনি ভুল ভাবলেন, আসলে প্যারোট এক প্রকারের মাছ। প্যারোট কিনতে হলে আপনার খরচ হবে ৩৫০-৪০০টাকা, ডিসকাসের দাম ৮০০-১২০০ টাকা, এছাড়াও রয়েছে অ্যাঞ্জেল, গোল্ড ফিশ, চিকলেড গ্রপ এরকম অসংখ্য মাছ।
নাম বলা শুরু হলে আপনি হয়ত গুনে শেষ করতে পারবেন না, আর সব রকম মাছের দাম নির্ভর করে তার সাইজের ওপর, জানালেন সুদীপবাবু। যিনি কম করে পাঁচ দশক ধরে মাছ পুষছেন। পুরোটাই শখ আর কী! অ্যাকোয়ারিয়ামটা ফাঁকা থাকলে মনটা ওনার আবার ভালো লাগে না, জানালেন সুদীপবাবু। আর তাই বারবার শখের টানে হাটে ছুটে আসেন। অথবা মাইকেলনগরের পাভেল। পাভেল বয়সে অনেকটাই ছোট, কিন্তু মাছ কেনার শখে তার সাথে পাল্লা দেওয়া কঠিন। পাভেল নিয়ম করে হাটে আসে আর আজ তার ঝুলিতে রয়েছে কিছু প্যারোট আর ফাইটার মাছ।
তিন–চার দশক আগে পর্যন্তও বাংলা সাহিত্যে পোষ্যর হাটের উল্লেখ আছে। প্রেমিকার অভিমান ভাঙানোর জন্য গ্যালিফ স্ট্রিট থেকে টিয়া, ময়না কিনে ভালবাসার মানুষটিকে উপহার দিয়েছেন প্রেমিক, এমন গল্পের উদাহরণও রয়েছে অনেক। কিন্তু মনের ইচ্ছা থাকলেও এখন ভালবাসার মানুষটিকে টিয়া উপহারের সাহস কেউই করেন না। পাছে হাজতবাসের ভয়। গ্যালিফ স্ট্রিট নিঃসংশয়ে বেঁচে থাকুক বাঙালির মধ্যে!
শুধু দরকার আমাদের মধ্যে সচেতনতার। আমরা যদি নিজেরা একটু সচেতন হতে পারি, তাহলে কিছুটা হলেও নিষিদ্ধ পোষ্য বিক্রয় বন্ধ হবে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না!

Comments are closed.