তৃণমূল-বিজেপির সঙ্গে লড়ব কী, টাকার অভাবে পার্টি চালানোই দায়! আলিমুদ্দিনকে জানাল ঝাড়গ্রাম সিপিএম।

‘তৃণমূল-বিজেপির বিরুদ্ধে রাজনৈতিক লড়াই করব কীভাবে? যে আর্থিক দুরবস্থার মধ্যে আছি, তাতে পার্টি অফিস চালানোই তো কঠিন হয়ে পড়ছে!’
পঞ্চায়েত ভোটের পর ঝাড়গ্রাম জেলা কমিটির মিটিংয়ে গিয়ে সেখানকার সিপিএম নেতৃত্বের এই প্রশ্নের মুখে পড়লেন দলের রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র এবং বিমান বসু। আর্থিক দুরবস্থা এক সময়ের মাওবাদী অধ্যুষিত এই জেলায় পঞ্চায়েত ভোটে খারাপ ফলাফলের একটা বড় কারণ বলে আলিমুদ্দিন স্ট্রিটকে জানিয়েছে ঝাড়গ্রাম জেলা সিপিএম।
পঞ্চায়েত ভোটে গোটা রাজ্যেই পর্যুদস্ত হয়েছে সিপিএম। তৃণমূল, বিজেপি তো বটেই, বহু জায়গায় নির্দলের থেকেও কম আসন জিতেছে বামেরা। গ্রাম বাংলার ভোটে কেন এই নজিরবিহীন বিপর্যয়, তার বিস্তারিত রিপোর্ট তৈরি করে আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে পাঠানোর জন্য সমস্ত জেলা কমিটিকে নির্দেশ দিয়েছে সিপিএম নেতৃত্ব। জুলাই মাসের সিপিএমের রাজ্য কমিটির মিটিংয়ে তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হওয়ার কথা। কিন্তু ভোটের ফল নিয়ে এক বছর আগে গঠিত ঝাড়গ্রাম জেলার প্রাথমিক মূল্যায়ন শুনে রীতিমতো জেরবার অবস্থা আলিমুদ্দিনের শীর্ষ নেতৃত্বের। সিপিএমের এক শীর্ষ নেতার বক্তব্য, ‘আমরা জানতে চেয়েছিলাম জঙ্গলমহলে তৃণমূলকে হারাতে গরিব, আদিবাসী মানুষ কেন বিজেপিকে বেছে নিল। আর ওরা বলল, যা আর্থিক অবস্থা জেলায় পার্টিই চালানো যাচ্ছে না’।
ঠিক কী অবস্থা ঝাড়গ্রাম জেলা পার্টির? কেন এই পিছিয়ে পড়া জেলায় আর্থিক দুরবস্থার কবলে সিপিএম? ঝাড়গ্রাম জেলা নেতৃত্ব ঠিক কী বললেন রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্রকে?
২০১৭ সালের জুন মাসে ঝাড়গ্রাম জেলা তৈরি হয়। সঙ্গে সঙ্গেই গঠিত হয় সিপিএমের জেলা কমিটি। ঝাড়গ্রামের ৮ টা ব্লক ছিল পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায়। ঝাড়গ্রামে পার্টির সমস্ত খরচ পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা পার্টিই করতো। তার মধ্যে একটা বড় খরচ ছিল নেতাইয়ের ঘটনায় অভিযুক্ত পরিবারগুলোর সংসার চালানো। ২০১১ সালের জানুয়ারি মাসে লালগড়ের নেতাইয়ে সিপিএম নেতা রথীন দণ্ডপাটের বাড়ি থেকে গুলি চালানোর ঘটনায় বহু গ্রামবাসীর মৃত্যু হয়। এই ঘটনায় একাধিক সিপিএম নেতা গ্রেফতার হন। এমন ২০ টি পরিবারকে সেই সময় থেকেই মাসে গড়ে ১৮০০-৩০০০ টাকা করে জেলা পার্টি দিয়ে আসছে সংসার চালানোর জন্য। নতুন জেলা হওয়ার পর এই খরচা এসে চাপে ঝাড়গ্রাম জেলা কমিটির ঘাড়ে। কারণ, নেতাই নতুন জেলায় পড়ছে। নেতাইয়ের ঘটনায় অভিযুক্ত পরিবারগুলোকে দেখভালের জন্য মাসে গড়ে ৬০-৬৫ হাজার টাকা খরচ করতে হয়। জেলা সিপিএমের এক নেতা জানান, ‘নতুন জেলা গঠনের সময় পশ্চিম মেদিনীপুর পার্টি থেকে কোনও টাকা দেওয়া হয়নি। ঝাড়গ্রামে পার্টি অফিসটা পর্যন্ত ঠিকঠাক অবস্থায় ছিল না। তা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে বসার উপযোগী করতে যা টাকার দরকার ছিল তাও ঝাড়গ্রাম জেলা কমিটির কাছে ছিল না তখন। কিছু মানুষের কাছ থেকে অনুদান নিয়ে পার্টি অফিস মেরামত করে বসার উপযোগী করা হয়েছিল।

ঝাড়গ্রাম জেলা সিপিএম পার্টি অফিস

সূত্রের খবর, জেলা ভাগের পর নেতাইয়ের অভিযুক্তদের সংসার চালাতে রাজ্য পার্টি প্রথমে ৫ লক্ষ টাকা দেয় ঝাড়গ্রাম জেলা পার্টিকে। কয়েক মাস আগে তা শেষ হয়ে গেল ফের ২ লক্ষ টাকা দেওয়া হয় আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের পক্ষ থেকে। কিন্তু গত দু’তিন মাস ধরে, বিশেষ করে পঞ্চায়েত ভোটের আগে জেলা পার্টির আর্থিক অবস্থা অত্যন্ত খারাপ হয়ে আসে। ঝাড়গ্রাম জেলা পার্টির নিজস্ব কোনও গাড়ি নেই। জেলা সম্পাদক থেকে শুরু করে সমস্ত নেতাকে এদিক ওদিক যাতায়াত করতে হয় বাসে চেপে। ঝাড়গ্রামের মতো প্রান্তিক জেলায় যেখানে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গার দূরত্ব অনেক, সেখানে বাসে যাতায়াত করতেই দিনের অর্ধেক সময় চলে যায়। কখনও ভোটের প্রচারে যাওয়ার সময় জেলা সম্পাদকের জন্য হয়তো গাড়ি ভাড়া করা হয়েছে, কিন্তু রোজ তাও করা যায়নি টাকার সমস্যায়। ঢাল নেই, তরোয়াল নেই, চরম আর্থিক দুরবস্থার মধ্যে প্রচার-কর্মসূচি চালাতে হয়েছে ঝাড়গ্রাম জেলার বিভিন্ন স্তরের নেতাকে। জেলার এক নেতার কথায়, ‘তৃণমূল তো বটেই বিজেপিও প্রচারে অনেক টাকা খরচ করেছে। সেখানে আমরা যেভাবে প্রচার করেছি, প্রচারে গেছি মানুষ হয়তো আমাদের ওপর ভরসা রাখতে পারেনি’।
কয়েক দিন আগে ঝাড়গ্রামের জেলা কমিটির মিটিং উপলক্ষ্যে সূর্যকান্ত মিশ্র এবং বিমান বসু সেই জেলায় যান। সূত্রের খবর, ঝাড়গ্রাম জেলা সিপিএম নেতারা দলের শীর্ষ নেতৃত্বকে জানিয়েছেন, জেলা পার্টির অ্যাকাউন্টে এখন মাত্র কয়েক হাজার টাকার মতো পড়ে আছে। অথচ শুধু পার্টি অফিসের ১০ জন সর্বক্ষণের কর্মীকে বেতন দিতে মাসে খরচ হয় প্রায় ৩০ হাজার টাকা। এর বাইরে অফিস মেইনটেনেন্সের জন্য মাসে খরচা হয় কম পক্ষে ১০-১২ হাজার টাকা। এর বাইরে প্রতি মাসে প্রায় ৬৫ হাজার টাকা খরচ হচ্ছে নেতাইয়ের ঘটনায় অভিযুক্ত পরিবারগুলোর সংসার চালানোর জন্য। এর বাইরে আছে বিভিন্ন রাজনৈতিক মামলা লড়ার খরচ। সব মিলে মাসে খরচা কম করে হলেও ১ লাখ ২৫ থেকে ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা। কিন্তু জেলার পার্টি সদস্যদের লেভি বাবদ আয় হয় মাসে গড়ে ৩২-৩৫ হাজার টাকা। কখনও কখনও তা ৩০ হাজারও হয়। এর বাইরে মানুষের কাছ থেকে সংগ্রহ হয় গড়ে ২০-২৫ হাজার টাকা। কিন্তু ভোটের পর এই গণ সংগ্রহের পরিমাণ আরও কমে গিয়েছে। সব মিলে চূড়ান্ত এক আর্থিক সমস্যার মুখে ঝাড়গ্রাম জেলা পার্টি। যে আর্থিক অবস্থার মুখোমুখি জেলা পার্টি দাঁড়িয়েছে তাতে আলিমুদ্দিন সাহায্য না করলে শীঘ্রই দলের স্বাভাবিক কাজকর্ম চালানোও কঠিন হয়ে পড়বে।

Leave A Reply

Your email address will not be published.