বছরের প্রথম ডার্বিতে কলকাতা রেসকোর্সে বাজিমাত মাথেরানের জকি আখাদে সান্দেশের, দ্বিতীয় রেস জিতলেন বেঙ্গালুরুর সুরজ

ঘড়িতে দুপুর ১২ টা বেজে গেছে। আশেপাশে থিক-থিক করছে লোক। পা ফেলার জায়গা নেই একদম। ভিড় ঠেলে এগিয়ে যেতেই সাউন্ড বক্সে একটা শব্দ বেজে উঠল। ব্যাস! অমনি হুড়োহুড়ি পড়ে গেল। কে আগে পৌঁছোতে পারে মাঠের কাছাকাছি, অনেকে এই আগে পৌঁছোনোর রিস্কটা না নিয়ে সোজা দাঁড়িয়ে পড়ল কোনও টেলিভিশন স্ক্রিনের সামনে। আর যারা কোনও কিছুই পেলেন না তারা কমেন্ট্রিকেই শ্রেয় বলে মেনে নিলেন।

ওদের চোখে-মুখে কেমন যেন একটা চাপা উত্তেজনা। কেউ বলছে, ‘চল, চল আরও জোরে ছোট, আবার কেউ বা বলছে, ‘ঔর জোরসে, আজ তুমকো জিতনা হি পড়েগা’। একদল ঘোড়া টগবগ করে রেসের মাঠে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। এরপর যখন ঘোড়া দৌড়নোর আওয়াজ কানে আসতে শুরু করল, ততক্ষণে অবশ্য চিৎকারটাও বেড়ে গেছে। যে যার মতো করে নিজের পছন্দের ঘোড়া আর জকিকে চিয়ার-আপ করছে। মাত্র দুই থেকে তিন মিনিট, দেখতে দেখতে শেষ হয়ে গেল প্রথম রেসটা। কেউ বা ‘হুররে’ বলে চেঁচিয়ে উঠল, আবার কেউ রাগে, হতাশায় মুখে দুটো কু’শব্দ বলতে বলতে মাঠ থেকে বেরিয়ে গেল। অনেকে আবার জেতাটাকে উপভোগ করার জন্য একে অন্যকে আলিঙ্গন করে রওনা দিলো বিয়ারে গলা ভেজানোর জন্য।

এটা কলকাতার রেসের মাঠের পরিচিত দৃশ্য। সপ্তাহে দু’তিন দিন রেস হয়। কিন্তু এতো লোকের সমাগম শুধু একদিনই ঘটে। সেটা প্রত্যেক নতুন বছরের প্রথম দিন, মানে ১ লা জানুয়ারি। এদিন কলকাতা রেসকোর্স চত্বর একটা ছোটখাটো উৎসবের চেহারা নেয়। রয়্যাল ক্যালকাটা টার্ফ ক্লাবের বেশিরভাগ সদস্যই পরিবার-পরিজনকে নিয়ে উপস্থিত হন রেসের মাঠে। তাই এই দিনের আমেজটা এক্কেবারে আলাদা। একটা অন্যরকম ফিলিংস। এই ফিলিংসা দেখতেই বছরের প্রথম দিন আমাদের রেসকোর্সে হাজির হওয়া!

কিন্তু, এই ১ লা জানুয়ারিই বা কেন? না, সেরকম কোনও আহামরি কারণ নেই, তবে যে কারণটা আছে তাও কম কিছু নয়। যত দূর জানা যায়, ১৯১২ সাল নাগাদ রানি মেরীকে সঙ্গে নিয়ে কলকাতা রেসের মাঠে এসেছিলেন ইংল্যন্ডের রাজা পঞ্চম জর্জ। সেইবারই তো ক্যালকাটা টার্ফ ক্লাব থেকে নাম হয়েছিল রয়্যাল ক্যালকাটা টার্ফ ক্লাব। রানি আর রাজার আগমনকে স্মরণীয় করে রাখতে ক্লাব কর্তৃপক্ষ ১ লা জানুয়ারি ঘোড়ার রেস করিয়েছিল। সেই ট্র্যাডিশন এখনও চলে আসছে। ‘আসল ব্যাপার হল, বছরের শুরুর দিনটা একটু অন্যরকমভাবে পালন করা তো আছেই, সেই সঙ্গে লেগাসিটাও মেইনটেন করার জন্যই ১ লা জানুয়ারি এখনও আমরা নিয়ম করে রেস চালাই,’ জানালেন ক্লাবের এক স্টূয়ার্ড।

এই বছরও সেই চিরাচরিত নিয়ম মেনে হল ঘোড়ার রেস। সারাদিনে হল গোটা নয়েক রেস। বছর শুরুর দিনের প্রথম রেসটাতেই বাজিমাত করলেন আখাদে সান্দেশ। ছিপছিপে লাজুক প্রকৃতির ছেলেটা জিতে নিলেন বছরের প্রথম রেস। সান্দেশের বয়স মেরে কেটে ২৭-২৮। কিন্তু যখন ঘোড়ার পিঠে বসে তখন একদম অন্য মানুষ। মহারাষ্ট্রের একটা ছোট্ট শহর মাথেরান, সেখানেই জন্ম সান্দেশের। সান্দেশর বাবা ছিলেন একজন ঘোড়সওয়ার। না, ঘোড়সওয়ার বলাটা ভুল হবে, আসলে ইনি ট্যুরিস্টদের ঘোড়ার পিঠে নিয়ে ঘোরাতেন। সেই সময় মুম্বইয়ের একজন নামকরা ঘোড়া ব্যবসায়ী ছিলেন ইকবাল নাথানি, যিনি অবসর সময়ে প্রায়ই ঘুরতে মাথেরান যেতেন। আর সান্দেশের বাবার ঘোড়া নিয়ে পাহাড়ি শহরে ঘুরে বেড়াতেন। তখন থেকেই আলাপ দুজনের। বাবার সঙ্গে মাথেরানে ঘোড়া নিয়ে ঘুরতো ছোট্ট সান্দেশও। ইকবাল নাথানি সেই সময় একদিন সান্দেশের বাবাকে আশ্বস্ত করেন, তাঁর ছেলে একটু বড় হলে তাকে মুম্বই নিয়ে যাবেন। যেমন কথা তেমন কাজ, সান্দেশ স্কুলের গণ্ডি পেরোলে তাকে মুম্বই পাঠিয়ে দিলেন তার বাবা। নাথানিও হিরে চিনতে ভুল করেননি। বুঝতে পেরেছিলেন, একটু ট্রেনিং দিতে পারলে এই ছেলে একদিন দেশের সেরা জকি হয়ে উঠবে। মুম্বইয়ে রেহানুলাহ খানের কাছে শুরু হল সান্দেশের ট্রেনিং। সালটা ২০০৯, প্রথমবারের মতো পুনেতে রেস করতে নামলেন সান্দেশ। না, প্রথমেই জেতার স্বাদ পায়নি সান্দেশ। প্রায় ৪৪ টি রেসের পর জয় এসেছিল। ওই শুরু, এখনও সান্দেশের ঘোড়া ছুটে যাচ্ছে উদ্দাম গতিতে।

সান্দেশের মতোই আরও এক জকি সুরজ নারেদু। সুরজ অবশ্য ১ লা জানুয়ারি দু’দুটো রেস জিতেছেন। দ্বিতীয় এবং নবম রেসের বিজয়ী সুরজ। সুরজ জন্মগ্রহণ করেন ১৯৮৫ সালে। বেঙ্গালুরুর বড়ি রাইডিং স্কুলের ছাত্র সুরজ। বাবা আর কাকার প্রবল আপত্তি ছিল এই রেস নিয়ে। কিন্তু সুরজও নাছোড়বান্দা। তাই সবার আপত্তি সত্ত্বেও একরকম জোর করেই জকি হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিল। আর আজ? হ্যাঁ, আজ তার সেই স্বপ্ন অনেকটাই সার্থক।
১ লা জানুয়ারি, এই একটা দিনে লাখ-লাখ টাকা ওড়ে এই রেসকোর্সে। কেউ হাসতে হাসতে বাড়ি ফেরেন, কেউ আবার সম্পূর্ণ নিঃস্ব হয়ে। কিন্তু এবছরের ১ লা জানুয়ারিটা যে অন্যরকম ছিল! আর এরকম হবে কেউই ঠাহর করতে পারেনি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বুকির কথায়, ‘যে ঘোড়াগুলো আজ ফেভারিট ছিল তারা কেউই জিতল না, তাই তো যাঁরা প্রতিদিন রেসের মাঠে আসেন তাঁরা খুব একটা সুবিধা করতে পারেননি। বরং সুবিধা করে গেলেন তাঁরা, যাঁরা হয়তো আজই এসেছিলেন, আর খেলার ছলেই ঘোড়ার ওপর বাজি ধরেছিলেন। আজ তো এমন লোকও আছেন যিনি ১০-১২ লাখ টাকা জিতেছেন।’

শেখ সামসুদ্দিনের বাড়ি পার্ক সার্কাস চত্বরে। রেসের মাঠে নিয়মিত আসেন। বললেন, ‘আজ আমি খেলতে আসিনি, দেখতে এসেছিলাম। ভেবেছিলাম ঘুরে ফিরে চলে যাবো কিন্তু ওই যে নেশাটা একটা মারাত্মক জিনিস, তাই খেলেই ফেললাম। বছরের প্রথম দিন ৪০ হাজার টাকা নিয়ে বাড়ি ফিরছি। সবই নসিব।’ তবে এরকম ব্যাপারটা যে সবার সঙ্গে হবে তার কোন মানে নেই কিন্তু। শুধু লাক ফেভার করলেই হবে না, তার সঙ্গে পুরো হিসেবটা জেনে-বুঝেই খেলতে হবে।

তবে যিনিই জিতুন আর যিনিই হারুন, নতুন বছরের প্রথম দিনটাতে কলকাতা রেসকোর্স যেন একটা কার্নিভাল। বিদেশি গান, একটা ব্রিটিশ উচ্চারণে কমেন্ট্রি, সঙ্গে বিয়ার। আর আপনার সামনে দিয়ে ঘোড়া নিয়ে ছুটছে মাথেরানের সান্দেশ, বেঙ্গালুরুর সুরাজরা। গতি আর পরতে-পরতে উত্তেজনা। তবে হ্যাঁ, বছরের প্রথম দিনের এই উত্তেজনা, আমেজটা শখ হিসেবে থাকাই ভালো। রেসের শখটা নেশায় পরিণত হলে বিপদ আছে! কথায় আছে, রেসের মাঠ যা দেয়, সেটা আবার উসুল করেও নেয়।

Comments are closed.