স্বামী বিবেকানন্দের শেষ হিমালয় যাত্রা মায়াবতী অদ্বৈত আশ্রমেঃ পর্ব# ২

আমরা পৌঁছালাম স্বামীজির সেই ব্যতিক্রমী অদ্বৈত আশ্রমে। এখানে কোনও পূজা, অর্চনা, আরতি, ধূপ, ধূনো, মূর্তি, কিছুই নেই। এখানে নির্জনে শুধু ধ্যান করা হয়। যিনি এক এবং অদ্বৈত, তাঁকে উপলব্ধি করার এমন সুন্দর জায়গা আর হয় না।
আশ্রম বাড়ি থেকে অতিথিশালায় যখন যাচ্ছি, তখন খুব বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিল। পৌঁছনোর আগেই অল্প অল্প বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। সারারাত খুব বৃষ্টি হল। রাত্রে কিছুক্ষণ বিদ্যুৎও ছিল না। সকালে বিদ্যুৎ এল। গীজারের গরম জলেই স্নান করতে পারলাম।
সকালে বাইরে বেরিয়ে দেখি আকাশ রোদে ঝলমল করছে। উত্তরদিকে উদ্ভাসিত হিমালয়ের অপূর্ব দৃশ্য। দিগন্তজুড়ে বরফের স্বর্ণ শিখর। যেন হিমালয় আমাদের স্বাগত জানাচ্ছে। ছাদে উঠে এই অপূর্ব দৃশ্য অনেকক্ষণ ধরে দেখলাম।
সাড়ে ৭ টায় আশ্রমে পৌঁছলে, সেখানে আরও বিস্মিত হয়ে দেখি, নীচের থেকে যা দেখেছি, এখানে তার দ্বিগুণ আকারে দিগন্তের এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্তে হিমালয়ের স্বর্ণ শিখর ঝলমল করছে। আশ্রমের এক কর্মকর্তা বললেন, শিখরগুলি নন্দাদেবী, ত্রিশূল, ধবলগিরি, গঙ্গোত্রী, যমুনোত্রী, কেদারনাথ আর বদ্রীনাথের শৃঙ্গ। স্বামীজি বললেন, আজ অনেকদিন পর এত নির্মেঘ আকাশ আর এই অপরূপ দৃশ্য দেখতে পাওয়া যাচ্ছে।
আশ্রমের বাগানের দেখাশোনা করেন একজন জাপানি সন্ন্যাসী। কিন্তু তাঁকে আমরা দেখতে পেলাম না। বাগানে অনেক ফুলের গাছ। গোলাপ, ক্যামেলিয়া, আরও কত। মাটিতে ঝরে পড়া একটি ক্যামেলিয়া কুড়ালাম। স্বামীজি সকালে জল খাবারের পর বললেন, আশ্রম থেকে দুই কিলোমিটার দূরে হাজার ফুট ওপরে আছে ধরমগড়। সেখানে স্বামী বিবেকানন্দ মায়াবতীতে এসে ধ্যান করেছিলেন। ধরমগড়ের রাস্তা বনের ভিতর দিয়ে। আরও বললেন, আমরা সেই স্থান দেখতে যেতে পারি, তবে অনেকখানি চড়াই পথ। যাঁদের হার্টের অসুখ, তাঁদের যেতে মানা করলেন। সতর্ক করে বললেন, এর আগে একটি দুর্ঘটনা হয়েছে। তাই হার্টের রোগীর না যাওয়াই ভাল। এও বললেন, গাইড সঙ্গে যাবে। কিছুদিন আগে এক মহিলা গাইড ছাড়া গিয়ে হারিয়ে যান। তাঁকে খুঁজে পেতে সারাদিন লেগেছিল। চলে গিয়েছিলেন অন্য এক গ্রামে।
কিছু সময় বাদে সবাই রওনা হলাম। সঙ্গে গাইড, আর সবার হাতে আশ্রম থেকে দেওয়া গাছের ডাল দিয়ে তৈরি লাঠি। চললাম গাইডকে অনুসরণ করে। প্রবুদ্ধ ভারত বিল্ডিং-এর পাশ দিয়ে, পেছনের দিকে সিঁড়ি উঠেছে। সেই সিঁড়ি বেয়ে উঠতে শুরু করলাম। খানিকটা যাবার পর দেখি এক জায়গায় কিছু পাথর সাজানো রয়েছে। গাইড বললেন, এখানে ছিলেন গ্রাম দেবতা মায়া দেবী। এঁর নামেই এই গ্রামের নাম আগে ছিল মায়াপীঠ। আশ্রম গড়ে ওঠার পর গ্রামবাসীরা দেবী মূর্তি তাদের গ্রামে নিয়ে যায়। আর এই গ্রামের নাম হয় মায়াবতী।
বনপথে চলছি। হাতে লাঠি, সামনে গাইড। আমরা পেছনে। একজনের পর একজন। যেন অভিযানে চলেছি। মনে একরাশ ফুর্তি।
পাহাড়ে রডেডেন্ড্রনের সমারোহ। লাল লাল থোকা থোকা ফুলে বনভূমি সেজে রয়েছে। বন দেবী যেন লাল বুটি দেওয়া সবুজ শাড়ি পরেছেন। গাড়োয়ালি সহযাত্রী ছেলে পারভীন বলল, এই ফুল হার্টের পক্ষে ভাল। সে ফুলের পাপড়ি ছিঁড়ে খেলো। তাই দেখে অনেকেই সেই ফুল খেলেন।
অবাক হলাম। হাসিও পেল। ভগবানের এই অপূর্ব সৃষ্টিকে মানুষ চিবিয়ে খাচ্ছে। পথ প্রকৃতই গভীর বনের মধ্যে দিয়ে। আলো আঁধারি পথ। স্যাঁতসেতে বনভূমি। গাছের ডালগুলি শেওলা জড়ানো।
পারভীন পাহাড়ি মেহেন্দি তুলে এনে সবাইকে তাক লাগাচ্ছে। খানিক হাঁটা, কিছু বিশ্রাম। তারই মধ্যে কথার স্রোতে বন মুখরিত।
এর পর গাইড বার করলেন দিক নির্দেশক। দেখালেন, রামগড় ডান দিকে। এবার কোনও রাস্তা নেই। বাঁ দিকে একটা রাস্তা নেমে গেছে। কোনও এক পাহাড়ি গ্রামের দিকে। কিছু পাহাড়ি মানুষ নেমে গেল ওই পথে। পাকদণ্ডী দিয়ে আরও খানিকটা ওঠার পর পাহাড়ের মাথায় কিছুটা সমতল জায়গা। সেখানে একটি লগ কেবিন। এই জায়গায় স্বামীজি ধ্যান করেছিলেন। জায়গাটা অপরূপ সুন্দর। এখান থেকে আকাশ পটে বহু দূর পর্যন্ত তরঙ্গায়িত তুষার শিখর শ্রেণী দেখা যাচ্ছে। চারিদিক নিস্তব্ধ, নিবিড় মহিমান্বিত, হিমালয়ের ধ্যান গম্ভীর প্রশান্ত মূর্তি। কোনও পাখিও ডাকছে না। গাছের পাতাও সন্তর্পণে ঝরে পড়ছে।
একটি বইয়ে এক অধ্যায়ে স্বামীজির শেষ হিমালয় যাত্রার বর্ণনা আছে। তাঁর শেষ হিমালয় যাত্রা হয় এই মায়াবতীতে। এই অধ্যায়ে তাঁর মায়াবতীতে অবস্থানের বিবরণ রয়েছে। স্বামীজি আন্তরিকভাবে চেয়েছিলেন মায়াবতীতে আশ্রম প্রতিষ্ঠা করতে। এখানে থাকতে চেয়েছিলেন। বহুবার সেই উল্লেখ পাওয়া যায়। ১৮৯৯ সালে একটি চিঠিতে লেখেন, ‘..আমি চির বিশ্রামের জন্য শীঘ্রই হিমালয়ে যাচ্ছি। আমার কাজ শেষ হয়েছে।’
তাঁর ইচ্ছা পূরণ হয়নি। মায়াবতী প্রতিষ্ঠার দুই বছরের মধ্যেই মারা যান ক্যাপ্টেন সেভিয়ার। এই মায়াবতীতেই। স্বামীজি তখন বিদেশে। ফিরে এসেই আসেন মিসেস সেভিয়ারের সঙ্গে দেখা করতে। ইচ্ছা এখানে নিভৃতে ধ্যান মগ্ন হয়ে থাকবেন। হল না। কাজ এলো। থাকলেন মাত্র ১৫ দিন। মিসেস সেভিয়ার মায়াবতীতেই আমৃত্যু থাকেন। তাঁদের বাংলোতে। একা। ক্যাপ্টেনের মতন তাঁরও শেষকৃত্য এখানেই হয়।
দুপুরে ফিরে এলাম আশ্রমে। বিকেল ৪ টায় চা খাইয়ে স্বামীজি বললেন, ঘুরে আসুন। মায়াবতী আশ্রমের প্রথম অধ্যক্ষ স্বরূপানন্দের ধ্যানস্থল দেখে আসুন। সবাই খুব খুশি। আবার চললাম গাইডের তত্ত্বাবধানে।
এবারেও প্রবুদ্ধ ভারত বিল্ডিং এর পাশের রাস্তা দিয়ে গাইড নিয়ে গেল পাহাড়ের ওপরে শুকিয়ে যাওয়া একটি হ্রদের কাছে। হ্রদটি বানিয়েছেন সেভিয়ার দম্পতি। সেখান থেকে একটি পরিস্কার পরিচ্ছন্ন গোশালা দেখিয়ে গাইড নিয়ে গেল পাহাড়ের আর একটি সমতল জায়গায় এক লগ কেবিনে। এটিই স্বরূপানন্দের ধ্যান কুটির। রাস্তায় এল গভীর বন। দেওদার আর ওক গাছের।
স্বরূপানন্দ ছিলেন অক্লান্ত কর্মী ও কঠোর সন্ন্যাসী। প্রবুদ্ধ ভারতের সম্পাদকও ছিলেন তিনি। একবার ধ্যান করার সময় কুটিরের সামনে এক বিশালকায় বাঘ এসে বসেছিল। অনেকক্ষণ তাঁর দেখা না পেয়ে আশ্রমের লোকেরা বেরোলেন খোঁজ করতে। তাঁরা গোশালা পর্যন্ত এলে নাকি বাঘ নিজের থেকেই চলে যায়। এর পরে মিসেস সেভিয়ারের পীড়াপীড়িতে স্বরূপানন্দ ধ্যান কুটির ত্যাগ করেন। পরে আশ্রমের কাছে আর একটি জায়গা বেছে সেখানে ধ্যান করতেন।
রাত ৮ টায় ডিনারের ঘন্টা পড়ল। খাবার পর সবাই সমবেত হলাম লাইব্রেরি ঘরে। আমরা বসলাম একদিকে। সন্ন্যাসীরা অন্যদিকে। একটি অল্প বয়সী সন্ন্যাসী ১৫ মিনিট একটি বই থেকে সারদা মায়ের জীবনের কিছু অংশ পড়ে শোনালেন। রাত্রে আমরা আস্তানায় ফেরার আগে স্বামীজি জানালেন, পরের দিন ১ লা এপ্রিল থেকে আশ্রমে সামার টাইম লাঘু হবে। প্রাতরাশের সময় ধার্য হয়েছে সকাল ৭ টা।
পরদিন সকালেই বেরতে হবে নৈনিতালের পথে। সুতরাং ৭ টার আগেই হাজির হলাম আশ্রম বাড়ির বাইরে। আজও আকাশজুড়ে তুষার মৌলি হিমালয় সবাইকে সাদর আহ্বান জানাচ্ছে। আশ্রম প্রাঙ্গণে একটি ওক গাছের নীচটা বাঁধানো। সেখানে নীরবে কিছুক্ষণ বসলাম। দূরে তুষারের দিকে তাকিয়ে বিদায় চাইলাম এই ভালোবাসা ভরা আশ্রমবাসীদের থেকে। প্রণাম করলাম ইষ্ট, হিমালয় আর আমার সৌভাগ্যকে।
মায়াবতী আশ্রমের স্বামীজির কাছে বিদায় জানিয়ে যখন বাসে উঠলাম, তখন সকাল সাড়ে ৮ টা। এবার ফেরার পথ। সবাই চুপচাপ। মনটা শান্ত, মিশ্র অনুভূতি। আনন্দ আর বেদনার মিশ্রণ। গন্তব্য নৈনিতালের পথ। দেবীধূরা হয়ে। এই পথে গেলে দূরত্ব কম হবে।
দেবীধূরা ছাড়িয়ে বাস দাঁড়ালো একটি গ্রামে। রাস্তার ধারে জলের কল। দুপুরে চড়ুই ভাতির আয়োজন হলো। টুটুল লেগে পড়ল তার সাগরেদদের নিয়ে। অফুরন্ত উৎসাহ। ডাল, ভাত, বাঁধাকপির তরকারি ও চাটনি দিয়ে খাওয়া হলো। আবার জিনিসপত্র গুছিয়ে যাত্রা শুরু।
বাসে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। উঠে দেখি বাস একটি পাহাড়ি নদীর ওপরের পুল পার হচ্ছে। দু’দিকে চাষের ক্ষেত। শুনলাম নৈনিতাল পৌঁছতে বেশি দেরি নেই। বিকাল ৫ টায় নৈনিতালে ঢোকার মুখে বাস দাঁড়িয়ে গেল। এই সময়ে বাস ঢোকার অনুমতি নেই। ভারতী আর টুটুল ট্যাক্সি করে গেল হোটেল ঠিক করতে। খানিক পরে হোটেলের একটা জীপ এল আমাদের নিতে। হোটেলটা ছিল তল্লিতালে, নৈনিতালে ঢোকার মুখেই।
পরদিন হরিদ্বার যাওয়া। সুতরাং সকাল থেকে প্রস্তুতি। এরই মধ্যে কিছুক্ষণের জন্য বের হয়ে খানিকক্ষণ নৌকা বিহার করে, হ্রদের ধারের দোকান থেকে এখানকার বিখ্যাত মোমবাতি কেনা হলো। বাস ছাড়ল বেলা ১২ টায়। এবার হরিদ্বারের পথ। সন্ধ্যায় পৌঁছলাম হরিদ্বার। থাকার ব্যবস্থা আমাদের নিজেদের আশ্রমে।

(শেষ)

Comments are closed.