ঐতিহাসিক শিকাগো ভাষণের ১২৫ বছরে ঘুরে দেখা স্বামী বিবেকানন্দের মায়াবতী অদ্বৈত আশ্রমঃ পর্ব# ১

বৈরাগী মন জীবনের রাঙা ধূলার পথে বের হয়ে যেতে সদাই উন্মুখ।
প্রাণের মধ্যে যে রূপ রসিকটি আছে, সে রূপের ক্ষুধা মেটাবার আশায় পথ চলার পদশব্দ শুনতে চায়।
সংসারের নিবিড়তায়, কর্তব্যের আহ্বানেও এই বৈরাগ্যের সুরটি বেজে চলেছে। প্রাত্যহিকতার দেওয়াল ভেঙে, অরণ্য, পর্বত, সীমাহীন সমতল, সমুদ্র সদাই আমাকে মুগ্ধ, বিস্মিত করে। বুকের মধ্যে আকাশের সব জল, যেন অন্তহীন জোয়ারে ভেসে যায়।
বন্ধু ভারতী যখন পথ চলার ডাক দিল, সঙ্গে সঙ্গে সেই ডাকে সাড়া দিয়ে ফেললাম। ও আগেও কয়েকটি যাত্রার ব্যবস্থা করেছিল, তখন আমার সুযোগ-সুবিধা হয়ে ওঠেনি। এবারের যাত্রায় নৈমিষ্যারণ্য হয়ে, টনকপুরের পথ দিয়ে স্বামী বিবেকানন্দের সৃষ্টি মায়াবতীর অদ্বৈত আশ্রমে যাওয়া।
সেখান থেকে ফিরতি পথে নৈনিতাল হয়ে হরিদ্বারে বিষ্ণুলক্ষী যজ্ঞ দেখা। আমি হরিদ্বার থেকেই ফরিদাবাদে ফিরে আসব। বাকি সহযাত্রীরা বেনারস হয়ে কলকাতায় ফিরে যাবেন ।
আমাদের যাত্রী দলটি ২৭ শে মার্চ, ২০০৩ সালে কলকাতা থেকে রওনা হয়ে ২৮ তারিখে সকাল সাড়ে দশটায় লক্ষ্ণৌ পৌঁছালো। আমি দিল্লি থেকে শতাব্দীতে লক্ষ্ণৌ পৌঁছলাম সেই দিনই দুপুর সাড়ে বারোটায়।
যাত্রার পরিচালিকা ভারতী। সহযোগী টুটুলের সহযোগিতায় আমাদের এই মায়াবতী আশ্রম, হরিদ্বার যাত্রা পরিচালনা করেন। যাত্রার জন্য একটি বাস ও একটি ট্যাক্সির ব্যবস্থা ছিল। হরিদ্বার থেকে গাড়ি দুটি লক্ষ্ণৌতে এসে অপেক্ষা করছিল। ট্রেন লক্ষ্ণৌ পৌঁছলে, টুটুলের তত্ত্বাবধানে অন্য সব যাত্রীদের নিয়ে বাস রওনা হয়ে গিয়েছিল নৈমিষ্যারণ্যের পথে। ভারতী আমার জন্য অপেক্ষা করছিল। শতাব্দী পৌঁছলে ভারতী, আমি ও অন্ন মা ট্যাক্সিতে রওনা হলাম।
আমাদের সব সুদ্ধ যাত্রী সংখ্যা ৩৩ জন, গাড়ির চালক ও পরিচালকদের নিয়ে। আমাদের ট্যাক্সি ড্রাইভার সর্দারজী, হরিদ্বার থেকে আসায় লক্ষ্ণৌ এর রাস্তা বিশেষ চেনেন না। স্থানীয় লোকেদের জিজ্ঞাসা করে, গাড়ি মামুদাবাদ হয়ে সীতাপুরের রাস্তায় চললো। ভারতী আগেই খবর জেনে এসেছিল, সীতাপুরের আগেই সিদৌলি থেকে বাঁয়ে বাঁক নিতে হবে। গাড়ি চলতে থাকলো নৈমিষ্যারণ্যের উদ্দেশ্যে।
নৈমিষ্যারণ্য সিদ্ধ তপভূমি। কথিত আছে, ব্যাসদেব চার বেদ, অষ্টাদশ পুরান এখান থেকে প্রচার করেছিলেন। এই বনভূমিতে বাস করতেন অষ্টআশি হাজার ঋষি। তাঁদের আরতির বেদধ্বনি এখানের অরণ্যে, ভূমিতে, ধেনুমতি নদীর জল স্রোতে ছড়িয়ে আছে। মহাভারতের যুগে পঞ্চপান্ডব এখানে এসেছিলেন তাঁদের বনবাস পর্বে। এখানকার একটি গুহায় বাস করেছিলেন। এখনও সেই গুহাকে পান্ডব গুহা বলা হয়।
সিদৌলিতে এসে বাঁয়ের রাস্তা নেওয়া হলো। এখানের স্থানীয় লোকেরা নৈমিষ্যারণ্যকে বলে নিমিষার। তাদের কাছে জেনে নিয়ে সোজা চলতে থাকলাম। দু’পাশে চাষের ক্ষেত, মুকুলের ভারে ভারাক্রান্ত আমের বাগান। আম্র মুকুলের সুবাসে বাতাস আমোদিত। রাস্তা জনহীন। অনেকক্ষণ পরে এলো একটি বসতি। গোটা কয়েক দোকান ঘর। সেখানে এক বৃদ্ধ গ্রামবাসী দাঁড়িয়ে ছিলেন। তাঁকে জিজ্ঞাসা করায় বললেন, সামনে কালীমাতা চক আসবে, সেখান থেকে বাঁয়ে যেতে হবে। বললেন, নিমিষার খুব সুন্দর আর শান্তির জায়গা।
গাড়ি চলেছে। হঠাৎ একপাল নীলগাই দৌড়ে রাস্তা পেরিয়ে অন্য দিকে চলে গেল। সঙ্গে একটা বাচ্চাও ছিল। আরও খানিক পরে, এক জায়গায় খুব ভিড়, হই-হল্লা চলছে, আগুনও জ্বলছে। সর্দারজী ড্রাইভার গাড়ি থামিয়ে দিলেন। দূর থেকে লোকেদের বেশভূষায় মনে হলো, সবাই মুসলিম। এরই মধ্যে এক ভদ্রলোক স্কুটারে একটি মহিলা ও বাচ্চাকে নিয়ে ভীড়ের মধ্যে দিয়ে চলে গেলেন। সেই দেখে সর্দারজীকেও যেতে বলা হলো , কিন্ত তিনি খুব আপত্তি করতে লাগলেন। এই সময় উল্টো দিক থেকে কয়েকটা পুলিশের গাড়ি আসতে দেখে আমাদের গাড়িও ভিড়টা পার হয়ে গেলো। জানা গেল, ইরাকের যুদ্ধের জন্য এরা আমেরিকার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাচ্ছে।
আমরা কালীমাতা চক থেকে বাঁয়ের রাস্তা নিলাম। অবশেষে পৌঁছে গেলাম নৈমিষ্যারণ্যের দূয়ারে। লক্ষ্ণৌ থেকে এই পর্যন্ত ৮০ কিলোমিটার। স্থানীয় মানুষদের কাছে জেনে নিয়ে এসে পৌঁছালাম আনন্দময়ী মায়ের আশ্রমে। এই আশ্রমেই আমরা থাকব। ভারতী চিঠি লিখে সেই ব্যবস্থা করেছে। আমাদের বাসও এসে পৌঁছে গেল। ওরা হয়ত ঘুরপথে এসেছে।
আশ্রম অধ্যক্ষ স্বামীজি আমাদের থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন। সকলে আপন আপন ঘরে চলে গেল ভারতীর নির্দেশ মতন। অবশেষে আমরা তিনজন, মীনাক্ষী, ভারতী আর আমি গেলাম মা যে বাড়িতে থাকতেন, তারই লাগোয়া দু’খানি ঘরে। ঘর দুটি খুবই জীর্ণ। ঘর দুটিতে তিনটি তক্তোপোষে বিছানা পাতা রয়েছে। স্বামীজি বললেন, এই ঘর দুটি শুদ্ধা ব্রহ্মচারিণীদের জন্য রাখা থাকে। তাঁরা এলে এখানে থাকেন। এই কথায় আমরা খুব উৎসাহিত হলাম। ভারতী বললো, তা হলে আমরা আনন্দময়ী মায়ের কোলেই থাকব।
রাত্রে বেশ মজার নাটক হলো। সারা আশ্রম যখন বিদ্যুতের আলোয় আলোকিত, আমাদের দুটি ঘর অন্ধকার। স্বামীজি দুটি লণ্ঠন পাঠালেন।
আমরা নিজেদের ভাগ্যকে দোষারোপ আর অন্যদের পাখার নীচে শোবার সৌভাগ্য নিয়ে আলোচনা করছি। এমন সময় টুটুলের মারফত স্বামীজি বলে পাঠালেন, আমাদের জন্য অন্য ঘরের ব্যবস্থা হয়েছে । আমরা যেন সেখানে চলে যাই। আমরা মায়ের কোল ছেড়ে যেতে রাজি হলাম। জিনিসপত্রও অন্য ঘরে চলে গেল।
এদিকে এর মধ্যে ভারতীর গোপালের শয়ন দেওয়া হয়ে গেছে। ভারতী বললো, গোপাল রেখে যাবে। কিন্তু গোপালের গহনা আছে শুনে স্বামীজি বললেন, গোপালকে খালি ঘরে রাখা যাবে না। অতএব আমাদের আবার মত পরিবর্তন। আমরা আগের ঘরেই থাকা ঠিক করলাম। স্বামীজির পরামর্শ মতন আমরা তিনজন থাকলাম ভেতর দিকের ঘরে। আর অন্য ঘরে থাকল ভারতীর রান্নার ছেলে পার্থ।
স্বামীজির নির্দেশ মতন পাহারাওয়ালা সারা রাত কানের কাছে ‘জাগতে রহো’ ডেকে আর টর্চ ফেলে রাত প্রায় ২ টো পর্যন্ত জাগিয়ে রাখলো। শেষ পর্যন্ত মায়ের কোলেই ঘুমালাম। পরে শুনেছি, এই সব পুরানো বাড়িতে সাপ থাকে। স্বামীজি হয়তো সেই ভয়ও পাচ্ছিলেন। আমাদের বলেননি। সকালে স্নানাদির পরে ডাক পড়ল খাবার জন্য। অনেকের ব্রত ছিল। তাঁরা খেলেন আলু, মরিচ আর দুধ। অন্যদের জন্য ব্যবস্থা ছিল ভাত, ডাল, তরকারি আর চাটনির।
বিকেল নামছে সন্ধ্যার কোলে। সবাই টর্চ হাতে আশ্রমের একটি ব্রহ্মচারী ছেলের সঙ্গে বের হলাম, বিখ্যাত চক্রতীর্থ দেখতে। এটি একটি গোলাকার বাঁধানো কুণ্ড। কথিত আছে, প্রজাপতি মনু নারায়ণকে বললেন, কলি যুগ আসছে, তখন আমরা ঋষিরা তপস্যা করব কোথায়? নারায়ণ হাতের চক্র ছেড়ে দিয়ে বললেন, এক নিমেষের মধ্যে এই চক্র পৃথিবীর মাটি স্পর্শ করে আমার হাতে ফিরে আসবে। সেই জায়গা হবে অনুকূল তপস্যার ক্ষেত্র। মনু দেখলেন, চক্র পৃথিবীর মাটি স্পর্শ করল এবং সেখানে সৃষ্টি হল একটি কুণ্ডের। প্রাচীনকাল থেকে এই কুণ্ডটি নৈমিষ্যারণ্যের চক্রতীর্থ। সবাই জল স্পর্শ করলাম।
কুণ্ডের পাশে ভূতনাথ শিবের মন্দির। সেখানে পুজো করলাম। কিছু দূরে ললিতাদেবীর মন্দির। সেখানে দর্শন সেরে গেলাম রাম-সীতার মন্দিরে। সব জায়গাগুলি ঘুরে যখন ফেরার পথ নিলাম তখন অন্ধকার হয়ে গেছে। নৈমিষ্যারণ্যে বিজলি বাতি আছে। তবে খুব কম সময়ের জন্য পাওয়া যায়। টর্চের আলোয় আশ্রমে ফিরলাম। স্বামীজি বললেন, বিজলি আসবে রাত ১০ টায়। জেনারেটর চালিয়ে আলোর ব্যবস্থা হলো।
আমাদের হাতে সময় কম, পরের দিন দুপুরে রওনা হব। অতএব ঠিক হল, পরদিন সকালেই আবার বের হয়ে আরও কিছু দ্রষ্টব্য দেখে নেব। পরের দিন সকালে যখন স্নানাদি করে তৈরি হচ্ছি , ঘরের থেকেই শুনতে পাচ্ছিলাম ময়ূরের কেকা রব। বের হয়ে দেখি বাড়ির ছাদের ওপর দুটি ময়ূর পেখম মেলে ঘুরে ঘুরে নাচছে। অপরূপ দৃশ্য। আকাশে মেঘ বা বৃষ্টি নেই, কিন্তু ময়ূর নেচে চলেছে। ফুলের গন্ধে আমোদিত বাতাস, ময়ূরের নাচ মধুকরের গুঞ্জন, সব মিলিয়ে স্নিগ্ধ শুদ্ধ তপোবনের মতই লাগছিল। আশ্রমের কাছেই হনুমান গড়ি। বিশাল মূর্তি। কথিত আছে, অহিরাবনকে বধ করে হনুমানজী এখানে বিশ্রাম নিয়েছিলেন। মন্দিরে পূজো দিয়ে হনুমান চালিসা পাঠ করা হলো।
এরপর গেলাম ধেনুমতি বা গোমতি নদীর ধারে। পূণ্য তোয়া ধেনুমতিতে প্রাচীনকালে ঋষি মুনিরা তর্পণ করতেন। শীর্ণ নদী বয়ে চলেছে। নদীর জলে অনেক লোক স্নান করছিলেন। আমরা নদীর জল স্পর্শ করে, নৌকাবিহার করলাম। এবার গন্তব্য ব্যাস গদ্দি। ব্যাস গদ্দিতে প্রথমে গেলাম মনু আর শতরূপার তপস্যা স্থলে। ভাগবতে আছে, রাজা মনু ও তাঁর স্ত্রী শতরূপা তপস্যা করেন স্বয়ং ভগবানকে পুত্র রূপে পাওয়ার জন্য। এঁরা পরের জন্মে দশরথ ও কৌশল্যা হয়ে রামকে পুত্র রূপে পান। ব্যাস গদ্দিতে ব্যাসদেব বাস করেছিলেন। ব্যাসদেব তাঁর শিষ্য সুমন্ত্র, পৈল, জৈমিনী ও বৈশম্পায়নকে চতুর্বেদের শিক্ষা দিয়েছিলেন। এখানে রয়েছে এক বিশাল বট গাছ। সেখানে নাকি জৈমিনী তপস্যা করেন। পাশেই যজ্ঞ কুণ্ড। বট গাছের গোড়া অসম্ভব চওড়া আর বাঁধানো। সময়ের অভাব। আর কিছু না দেখে ফিরলাম আশ্রমে। আশ্রমের যে ছেলেটি সঙ্গে ছিল, সে বলল, ধেনুমতিতে একবার বন্যা হয়। আশ্রমেও জল ঢোকে। তারপর মা আনন্দময়ীর অনুরোধে ইন্দিরা গান্ধীর প্রচেষ্টায় এখানে বাঁধ তৈরি হয়। নৈমিষ্যারণ্যে এখন অনেক বসতি। পিচের রাস্তা, বিজলির বাতি, কলের জল সবই এসে গেছে। আশ্রমে স্বামীজি দুপুরে পরম যত্নে আমাদের প্রসাদ খাওয়ালেন। থাকার ব্যবস্থাও ছিল সুচারু। এবার আমরা স্বামীজির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাসে উঠলাম। পাঁচজন বৃদ্ধা যাত্রীকে বসানো হলো ট্যাক্সিতে। গন্তব্য সীতাপুর হয়ে টনকপুরের পথ। সীতাপুরে কিছুক্ষণের জন্য থামা হল। টেলিফোন বুথ থেকে সবাই বাড়িতে ফোন করলো। এই সময় ঠিক করা হলো যে, সময়মতন টনকপুরে না পৌঁছতে পারলে, রাস্তায় সুবিধাজনক অন্য কোনও জায়গায় রাতটা থাকতে হবে। বিকেল ৫ টায় রাস্তার ধারে একটি ধাবায় থেমে সবাই চা খেলো। তারপর আবার পথ চলা শুরু। সন্ধ্যার আঁধার ঘনিয়ে এল। কিছুক্ষণের জন্য পথ বিভ্রাট। রাস্তা গুলিয়ে গেছে। পথচারীদের জিজ্ঞাসা করে করে বাস চলেছে গভীর বনভূমির মধ্যে দিয়ে। রাস্তার দুদিকে শাল গাছের গভীর বন। শব্দ শুধুমাত্র বাসের ইঞ্জিনের। গাছের থেকে ঝরে পড়া পাতা জড়ো করে রাস্তা পরিষ্কার রাখার জন্য আগুন জ্বালানো হয়েছে। আগুন মালার মতন বনভূমিকে ঘিরে আছে। রাতটি ছিল কৃষ্ণপক্ষের। বেশ গা ছম-ছম করা পরিবেশ। গভীর জঙ্গলে আগুনের মালা দেখতে দেখতে সবাই এক সঙ্গে গান করতে করতে পথ চলতে থাকলাম।
এর পর উত্তরাঞ্চলে ঢোকার চেক পোস্ট পার হয়ে শহরের আলো দেখা গেল। রাত ৯ টা নাগাদ বাস এসে থামল একটি লোকালয়ে। জায়গার নাম খাটিমা। শোনা গেল টনকপুর আরও ২২ কিলোমিটার দূরে। সেখানে পূর্ণাগিরি মেলার জন্য লোক সমাগম হয়েছে। এত রাত্রে টনকপুরে গিয়ে হোটেল পাওয়া দুষ্কর হতে পারে, এই ভেবে খাটিমাতেই রাত্রিবাস করার কথা ঠিক হলো। কাছেই একটা হোটেলে ঘরও পাওয়া গেল ৭ খানা। আমরা চার-পাঁচজন করে একটা ঘরে স্থান নিলাম। জিনিসও এসে গেল বাস থেকে। টুটুল তার লোকেদের নিয়ে রান্নার ব্যবস্থায় লেগে গেল। খিচুড়ি, বেগুন ভাজা দিয়ে রাতের খাবার পর্ব শেষ হলো। ক্লান্ত ছিলাম, কিন্তু মশার জন্য শোয়া যাচ্ছিল না। তিনখানা মশা তাড়াবার কয়েল জ্বালানো হলো। কয়েলের ধোঁয়ায় চোখ জ্বালা করছিল, কিন্তু মশা পালালো। এইভাবে বাকি রাত ঘুমিয়েই কাটালাম।
সকালে তৈরি হয়ে জলখাবার খেয়ে যখন বাসে উঠলাম, তখন ঝিরঝিরে বৃষ্টি হচ্ছে। এবার গন্তব্য, স্বামী বিবেকানন্দের অদ্বৈত আশ্রম মায়াবতী।

মায়াবতী সম্বন্ধে, স্বামীজি বলেছেন, ‘..এই পূণ্য ভূমির গিরিশিখরে, গহনগুহায়, দুরন্ত গতি স্রোতস্বতীর তীরে সেই অপূর্ব তত্ত্ব রাশি চিহ্নিত হয়েছিল।.. এই সেই ভূমি, অতি বাল্যকাল থেকেই আমি সেখানে বাস করবার কল্পনা করে এসেছি এবং এখানে বাস করার জন্য কতবারই না চেষ্টা করেছি।…আমার প্রাণের আকাঙ্ক্ষা, ঋষিদের এই প্রাচীন বাসভূমি, এই গিরি রাজের কোলে আমার শেষ দিনগুলি কাটাবো। বন্ধুগণ, সম্ভবত আগের মতন বিফল মনোরথ হব।..নির্জন নিস্তব্ধতার মধ্যে অজ্ঞাতভাবে থাকা হয়তো আমার ঘটবে না। তবু অকপটভাবে প্রার্থনা ও আশা করি জগতের অন্য কোথাও নয়, এখানেই আমার শেষ দিনগুলি কাটাবো।’
স্বামী বিবেকানন্দের এই আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ করবার জন্য এগিয়ে এসেছিলেন তাঁর ইংরেজ শিষ্য ক্যাপ্টেন সেভিয়ার ও তাঁর স্ত্রী।
ভারতবর্ষে এসে তাঁরা প্রথমে আলমোড়ায় বাস করতে লাগলেন। খোঁজ করতে থাকেন আশ্রম গড়ার উপযুক্ত স্থানের। সন্ধান পান আলমোড়া থেকে ৫৫ কিলোমিটার দূরে ৬৪০০ ফুট উঁচুতে গভীর বনের মধ্যে প্রায় ১০০ একরব্যাপী অঞ্চলে জেনারেল ম্যাগ্রেগর সাহেবের পুরনো চা বাগান ও একটি বাংলো আছে বিক্রির জন্য।
সেখানে উত্তর দিগন্ত জুড়ে প্রসারিত তুষার গিরি শ্রেণীর অপার সৌন্দর্য সেভিয়ার দম্পতিকে মুগ্ধ করে। তাঁরা জায়গাটি কিনে নেন।
এই অঞ্চলের নাম ছিল মায়াপীঠ। সেই স্থানে ১৮৯৯ সালে স্বামীজির আকাঙ্ক্ষিত আশ্রম স্থাপিত হয়। মায়াপীঠ থেকে আশ্রমের নাম হয় মায়াবতী।
সেই মায়াবতী আশ্রমে চলেছি আমরা। খাটিমা থেকে বাস ছাড়ল সকাল সাড়ে ৯ টায়। পথে পড়লো বনবাসা, তারপর টনকপুর। টনকপুর থেকে একটি রাস্তা ডাইনে চলে গেছে, শ্যামলাতালের দিকে। আমরা চললাম সোজা পথ ধরে। পথ ক্রমশঃ পাহাড়ে উঠতে লাগল। টনকপুর ছাড়বার পর পাহাড়ে ওঠার সময় শালগাছের গভীর বন। মাঝে-মাঝে রয়েছে বন বিভাগের কাঠের গোলা। অনেকটা দার্জিলিংয়ে যাবার পথে হিমালয়ের পাদদেশে শুকনার জঙ্গলের মতন।
পৌঁছলাম মায়াবতীর অদ্বৈত আশ্রমে। কী নয়ন মনোহর স্থান! অনেকখানি সমতল জায়গা। মাঝখানে ফুলের বাগান। বাগানের বামে ও দক্ষিণে দুটি দোতলা বাংলো বাড়ি। সামনা-সামনি মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। ডান-দিকেরটি আশ্রম। আর বাঁ-দিকেরটি প্রবুদ্ধ ভারত পত্রিকার দফতর। প্রথমে এখান থেকেই পত্রিকাটি প্রকাশিত হতো। ১৯২৪ সালে থেকে কলকাতায় প্রকাশনা শুরু হয়। তবে সম্পাদনার কাজ এখনও এখানেই হয়।
আশ্রম বাড়ির সামনের বারান্দায় আলো জ্বলছে। সেখানে বসবার দুটি বেঞ্চি রাখা রয়েছে। স্বামীজি বের হয়ে এসে ডাইনিং রুমে যেতে বললেন। সঙ্গে এও বললেন, সকলের একসঙ্গে বসবার জায়গা হবে না, কয়েকজন অপেক্ষা করুন। ছেলেরা রয়ে গেল। মেয়েরা ডাইনিং রুমে গেলাম। টেবিল, চেয়ারে খাবার ব্যবস্থা। টেবিলে সাজানো রয়েছে শাল পাতা আর জলের গ্লাস। আশ্রম কর্মীরা পরিবেশন করলেন। দু’রকমের তরকারি, ডাল, রুটি আর ভাত। সবাই অবাক হলাম, এই দুর্গম জায়গায় কর্তৃপক্ষ আমাদের জন্য পটলের তরকারি করিয়েছেন। বেসিনে সার সার কল লাগানো হাত ধোওয়ার জন্য। খাবার পর দিলেন সেদ্ধ আমলকির মুখ সুদ্ধি। স্বামীজি এও বললেন, সকালে সাড়ে ৭ টায় জল খাবারের পর এখানকার দ্রষ্টব্য স্থানগুলি দেখার ব্যবস্থা করে দেবেন।

(আগামীকাল দ্বিতীয় পর্বঃ মায়াবতী আশ্রমে থাকার অভিজ্ঞতা)

Comments are closed.