বিজেপির মূল টার্গেট বাংলা। রাজ্যের শহুরে, শিক্ষিত, মধ্যবিত্ত সমাজে বৈধতা পেতে প্রণব মুখোপাধ্যায়কে ব্যবহার করেছে আরএসএসঃ মহম্মদ সেলিম।

নাগপুরে আরএসএস দফতরে প্রণব মুখোপাধ্যায়ের যাওয়া এবং ভাষণ তোলপাড় ফেলেছে জাতীয় রাজনীতিতে। বিশেষ করে লোকসভা নির্বাচনের যখন এক বছরও বাকি নেই, তখন আরএসএস কেন প্রণব মুখোপাধ্যায়ের মতো প্রবীন কংগ্রেসি নেতাকে তাদের মঞ্চে ডাকল এবং দেশের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি সেখানে কী বললেন, কেন বললেন, তা জাতীয় রাজনীতিতে এখন চর্চার মূল বিষয়। প্রণব মুখোপাধ্যায়ের আরএসএস মঞ্চে যাওয়াকে কীভাবে দেখছে সিপিএম? সাংসদ এবং সিপিএম পলিটব্যুরো সদস্য মহম্মদ সেলিমের মুখোমুখি thebengalstory.com

 

সাংসদ এবং সিপিএম পলিটব্যুরো সদস্য মহম্মদ সেলিম

প্রশ্নঃ এত দিন অপেক্ষা ছিল, প্রণববাবু আরএসএস দফতরে কী বলেন তা শোনার। এখন তাঁর ভাষণ শোনার পর আপনার প্রতিক্রিয়া…

মহম্মদ সেলিমঃ প্রণব মুখোপাধ্যায় নাগপুরে যা বলেছেন তার মধ্যে নতুন কিছু নেই। দেশের এই বহুত্ববাদ, ধর্মনিরপেক্ষতার ঐতিহ্য, ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে এর আগে বহুবার তিনি সংসদে বলেছেন। নতুন যেটা তা হল, বৃহস্পতিবারের ভাষণে তিনি অনেকটাই সিলেকটিভ। হয়তো আরএসএসের মঞ্চ বলেই। তিনি স্বাধীনতা পূর্ব ভারতের রাজনৈতিক অবস্থা নিয়ে বলতে গিয়ে সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী, জওহরলাল নেহরু, বাল গঙ্গাধর তিলক কিংবা পরবর্তী কালে দেশ গঠনে সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের নাম নিলেন। সুভাষ চন্দ্র বসুর নাম কিন্তু বললেন না। স্বাধীনতা আন্দোলনে সুভাষ বসুর ভূমিকার কথা উল্লেখ করতেই পারতেন।
আসলে আহিংস আন্দোলনের পাশাপাশি স্বাধীনতার লড়াইয়ে সশস্ত্র আন্দোলনের একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। সেটাও একটা ধারা। সেই ধারাটা প্রণববাবু উল্লেখ করলেন না। তাতে বাংলার একটা গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল। হয়তো আরএসএস এই ধারাটা পছন্দ করে না বলেই তিনি এই প্রসঙ্গ তুললেন না।
আরও গুরুত্বপূর্ণ, বি আর আম্বেডকরের নাম এড়িয়ে গেলেন তিনি। যখন গোটা দেশে বিজেপির হাতে দলিতরা আক্রান্ত হচ্ছে, বিজেপি-আরএসএস আম্বেডকরের মূর্তি ভাঙছে, দলিতদের মধ্যে আন্দোলন দানা বাঁধছে, তখন প্রণব মুখোপাধ্যায় কেন, কাকে খুশি করতে আম্বেডকরের নাম উল্লেখ করলেন না, সেই প্রশ্ন কেউ করতেই পারেন। প্রণববাবু দেশের মিশ্র সংস্কৃতির কথা বললেন, অথচ মৌলানা কালাম আজাদের কথাও এড়িয়ে গেলেন।
আর এগুলোর থেকেও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়, দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, আন্দোলনে মহিলাদের ভূমিকার কথা শোনা গেল না প্রাক্তন রাষ্ট্রপতির মুখে। আরএসএস একটা পুরুষতান্ত্রিক সমাজের প্রতিনিধিত্ব করে। ওদের মঞ্চ থেকে শুরু করে কোথাও মহিলাদের দেখা যায় না। সেখানে দেশের ইতিহাসে মহিলাদের অবদানের কথা উল্লেখ করতেই পারতেন প্রণববাবু।

প্রশ্নঃ এ তো গেল, যা প্রণব মুখোপাধ্যায় বললেন না! আর যা বললেন, তা নিয়ে আপনার বা সিপিএমের ব্যাখ্যা কী?

মহম্মদ সেলিমঃ নরেন্দ্র মোদী বলেছিলেন, ‘কংগ্রেস মুক্ত ভারত’। এখন আরএসএস বলছে, ‘কংগ্রেস যুক্ত আরএসএস’। এটাই নাগপুরে প্রণব মুখোপাধ্যায়ের যাওয়া, সেখানে তাঁর ভাষণের একমাত্র ব্যাখ্যা। দিন-দিন যখন মোদী সরকারের গ্রহণযোগ্যতা কমছে, একের পর এক ভোটে হারতে শুরু করেছে বিজেপি, তখন কেন্দ্রীয় সরকারকে রক্ষা করতে আরএসএসকে এগিয়ে আসতেই হোত। আরএসএসকে সামনে বা মেইনস্ট্রিমে না আনলে বিজেপির বাঁচার জায়গা নেই। এটা তারই একটা ধাপ। আরএসএস সমাজের নানা স্তরে নিজের মতো সাংগঠিক কাজ করতই, কিন্তু লোকসভা ভোটের আগে তারা মেইনস্ট্রিম রাজনীতিতে চলে এল প্রণব মুখোপাধ্যায়ের মতো প্রবীন কংগ্রেসি নেতাকে তাদের মঞ্চে এনে। লোকসভা ভোটের আগে আরএসএসের দরকার ছিল জাতীয় রাজনীতির সেন্টার স্টেজে আসার। ঠিক সেই কাজটাই হয়েছে এই কর্মসূচিতে।
প্রণব মুখোপাধ্যায়কে মঞে রেখে আরএসএস নিজের ভাবধারা প্রচারের সুযোগ পেল দেশের মানুষের সামনে। জাতীয় সঙ্গীত গাইতে না পারার জন্য ট্রেনে-বাসে লোকজনকে মারধর করা হচ্ছে এখন দেশে। সেখানে আরএসএসের অনুষ্ঠানে জাতীয় সঙ্গীত বা বন্দেমাতরম কিন্তু হল না। হল ওদের নিজস্ব সঙ্গীত। অথচ, প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ছেড়ে দিন, সাধারণ রাজনৈতিক নেতা কোনও কর্মসূচিতে থাকলেও সেখানে শুরুতে বা শেষে জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া একটা রেওয়াজ।
এই অনুষ্ঠানে প্রণব মুখোপাধ্যায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বা ব্রিটিশ রাজত্বের কথা বললেন, কিন্তু উপনিবেষকতাবাদের কথা বললেন না। আরএসএস মনে করে, ব্রিটিশরা মুসলিমদের হাত থেকে দেশকে উদ্ধার করেছে। তাই হয়তো তাদের মঞ্চে ব্রিটিশ শাসনকালকে উপনিবেষকতাবাদ বলতে পারেননি তিনি।
তবে তিনি কী বললেন, বললেন না, তার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ তিনি আরএসএসের মঞ্চে গেলেন!

প্রশ্নঃ তার মানে আপনি বলছেন, লোকসভা ভোটের আগে আরএসএস প্রণববাবুকে ব্যবহার করল তাদের সংগঠনকে প্রচারের সামনের সারিতে নিয়ে আসতে?

মহম্মদ সেলিমঃ অবশ্যই। আসল কথা হচ্ছে, টার্গেট বেঙ্গল। বিজেপি-আরএসএসের কাছে এখন মূল টার্গেট বাংলা। ওরা বুঝে গেছে, শুধু অমিত শাহ, মোহন ভাগবত দিয়ে বাংলার শিক্ষিত, মধ্যবিত্ত সমাজের সমর্থন পাওয়া যাবে না। তাই রাজ্যের শিক্ষিত, মধ্যবিত্ত সমাজে গ্রহণযোগ্যতা আছে এমন কাউকে তুলে ধরো। এখনও রাজ্যের বহু শিক্ষিত, বুদ্ধিজীবী মানুষ আরএসএসকে এড়িয়ে চলেন। আজ তাঁরা ভাবতেই পারেন, প্রণব মুখোপাধ্যায় যদি আরএসএসের মঞ্চে যেতে পারেন, আমার যেতে অসুবিধে কী? দেখবেন, সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম আন্দোলনের শুরুতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন গোটা রাজ্যে ছুটে বেড়াচ্ছিলেন, সমস্ত মানুষের সমর্থন কিন্তু তিনি পাননি। যখন মহাশ্বেতা দেবী থেকে শুরু করে বুদ্ধিজীবীরা রাস্তায় নামলেন, আন্দোলন একটা সামাজিক স্বীকৃতি পেল। এটাও আরএসএসের এমনই একটা কৌশল।
আর বিজেপি-আরএসএস এটা বরাবরই করে থাকে। যখন তামিলনাডুতে পা রাখতে হবে তখন জনা কৃষ্ণমূর্তি, যখন অন্ধ্র প্রদেশ টার্গেট তখন বঙ্গারু লক্ষণ কিংবা ভেঙ্কাইয়া নাইডুকে সভাপতি করা হয়েছে। এখন হিন্দি, হিন্দু, হিন্দুস্থান লাইনে চলছে বিজেপি-আরএসএস কিন্তু বাংলার বাজার তা দিয়ে ধরা যাবে না। তার জন্য দরকার প্রণব মুখোপাধ্যায়ের মতো প্রবীন কংগ্রেসি নেতাকে, শহুরে, শিক্ষিত, মধ্যবিত্ত বাঙালি সমাজে যাঁর গ্রহণযোগ্যতা আছে।

Leave A Reply

Your email address will not be published.