‘আমি ভদ্রলোক নই, আমি কমিউনিষ্ট’, একমাত্র অশোক মিত্রই বলতে পারেন একথা।

সৈয়দ মুজতবা আলীর পর এত ভালো গদ্য লেখক বাংলা সাহিত্য আর পায়নি। অশোক মিত্র চলে গেলেন। পরিণত বয়সে মৃত্যু হয়েছে। কিন্তু বাঙালি সমাজে একট গভীর শুন্যতা তৈরি হলো। যা কাটানো বহুদিনের ব্যাপার। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ। কেন্দ্রীয় সরকারের দফতরে কর্মরত ছিলেন। ছোটবেলা থেকে মার্কসীয় তত্বে ও জনগনের শক্তিতে বিশ্বাস করেছেন। শেষদিন পর্যন্ত অটুট রেখেছেন সেই বিশ্বাস।
পশ্চিমবাংলার অর্থমন্ত্রী ছিলেন। সাংসদ ছিলেন। রাজ্য সরকারের বিভিন্ন পদে থেকেছেন। শেষ পর্যন্ত সাহিত্যে নিজেকে সমর্পণ করছেন। সমসাময়িক বিষয় নিয়ে রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক বিশ্লেষন এক কথায় অপূর্ব। কোনও কোনও সময় পৌনঃপুনিকতায় দুষ্ট বলে মনে হয়েছে-কিন্ত উতরে গেছে। এই পর্যায়ের লেখাতে তিনি অপ্রতিদ্বন্দী ছিলেন।
রাজনীতির মানুষ ছিলেন। সে রাজনীতির লক্ষ ছিল সাধারণ গরিব মানুষের ভালো করা। নিজে মন্ত্রী হয়েও কিন্তু সরকারের অন্য অনেক মন্ত্রী বা আমলার সঙ্গে তাঁর মেলেনি। শিক্ষায় মাতৃভাষার একান্ত প্রচারক ছিলেন। উৎসব ইত্যাদিতে টাকা না ব্যয় করে গরিব মানুষের শিক্ষার ব্যয় বহন, স্বাস্থ্য প্রদানের কথা ভাবতেন।
সরকারে থাকলেন না, বামপন্থী থাকলেন। বামফ্রন্টের শিল্পনীতির সব কিছু মেনে নিতে পারেননি।। বিশেষ করে জমি অধিগ্রহণের পদ্ধতি। জোর নয়, আলোচনার রাস্তায় সমাধান-এই মতে বিশ্বাস করতেন। সিঙ্গুর বা নন্দীগ্রাম সবে আলোচনায় আসছে। দেশ পত্রিকাতে লিখলেন ‘ডাকে না ফেলা চিঠি’। বামপন্থীদের কাছে তাঁর আবেদন, ‘যে কৃষককে আপনারা জমি দিয়েছেন, তাঁর কাছ থেকে জমি কাড়বেন না। ফল হবে সুদুরপ্রসারী।’ তাঁর কথা সত্য হয়েছে। তাঁকে সইতে হয়েছে ‘বইপড়া বামপন্থী’ এই উপহাস। ২০০১ সাল থেকে বামফ্রন্ট সরকারের শিল্পনীতিও তিনি মানতে পারেননি। তিনি মনে করতেন, বড় শিল্প একমাত্র সমাধান নয়। জোর দিতে হবে ক্ষুদ্র এবং কৃষি ভিত্তিক শিল্পে। এই ভাবনার জন্য সিপিএমের অনেক নেতাই তাঁকে পরে অপছন্দ করতেন, এড়িয়ে যেতেন। কিন্তু তাতে তাঁর কিছু এসে-যেত না।
নিজের বিশ্বাসে অটল থেকেছেন সবসময়। কোনও আপস করেননি। একসঙ্গে তখন সাংসদ ছিলাম। উনি উচ্চকক্ষে, আমি নিম্নকক্ষে। একদিন সংসদ ভবনের লবিতে মনমোহন সিংহের সঙ্গে ডঃ মিত্রের দেখা। মনমোহন সিংহ কারও সঙ্গে কথা বলছিলেন, ডঃ মিত্রকে দেখে এগিয়ে এলেন। জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কেমন আছেন অশোকদা? গৌরিদি কেমন…।’ কোনও কথার জবাব না দিয়ে অশোক মিত্র সপাটে উত্তর দিলেন, ‘তুমি মনমোহন, দেশটাকে আমেরিকার কাছে বিক্রি করে দিলে?’ তারপরে আরও কথা। মনমোহন অসম্ভব শ্রদ্ধা করতেন তাঁকে, অল্প কিছু বললেন। মুখে হালকা হাসি। অধিবেশন শুরু হল। সবাই ঘরে গেলেন, আমিও হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। অনেক পরে একদিন সংসদে স্ট্যান্ডিং কমিটির মিটিংয়ে গেছি। আগেই পৌঁছে বসে আছেন মনমোহন সিংহ। পাশে গিয়ে বসলাম। কয়েকদিন আগেই অশোক মিত্রর স্ত্রী গৌরিদি মারা গিয়েছেন। সংসদের একটা ছোট্ট প্যাড টেবিলে রাখা ছিল। পকেট থেকে পেন বের করে মনমোহন সিংহ লিখলেন, ‘অশোকদা, গৌরিদির খবর শুনেছি। টেক কেয়ার’। আমাকে বললেন, চিঠিটা অশোক মিত্রকে দিয়ে দিতে।
কাউকে পরোয়া করতেন না অশোক মিত্র। এই তো সেদিন আনন্দবাজারে লিখলেন, ‘এখন মনে হয়, ঘৃণার একটি মস্ত সামাজিক সার্থকতা আছে। হামাগুড়ি দিয়ে হলেও ভোট পরিচালকের সামনে উপস্থিত হয়ে পরিচয় পত্র দেখিয়ে পর্দা ঘেরা যন্ত্রে মহিলাটির বিরুদ্ধে আমার অধিকার প্রয়োগ করব।’ (১২ এপ্রিল, ২০১৬)। প্রসঙ্গত সেই কেন্দ্রের প্রার্থী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও ভবানীপুর বিধানসভা কেন্দ্রের মধ্যে ডঃ মিত্রের বাড়ি।
যে কথা বলছিলাম, ‘দায়বদ্ধতা’ তাঁর কাছে কেবল মাত্র একটা নতুন শব্দ ছিল না, বিষয়টি তিনি জীবন দিয়ে উপলবদ্ধি করেছিলেন। রাজ্যসভার সদস্য থাকাকালীন তিনি বাণিজ্য দফতরের স্ট্যান্ডিং কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন। প্রতিবেদনে প্রায় নব্বই ভাগ নিজে লিখেছিলেন। মাননীয় উপরাষ্ট্রপতি বলতে বাধ্য হয়েছিলেন, ডঃ মিত্রের রিপোর্টটি সমস্ত কমিটির কাছে আদর্শ হয়ে থাকবে।
তাঁর স্মৃতিচারণা পুরনো কথা জানতে সাহায্য করেছে। পুরনো ঢাকার স্মৃতি তাঁকে সারা জীবন তাড়া করে বেড়িয়েছে। তিনি না লিখলে জানতেই পারতাম না, মোতাহার হোসেনের কন্যা সনজীদা খাতুন অথবা মমতাজ সংঘমিতার দিল্লির মেডিকেল কলেজে ভর্তিতে তাঁর সাহায্য, যাঁকে তিনি কোনও দিন দেখেনওনি। অথবা ইন্দিরা গান্ধী ও বিজয়ালক্ষী পন্ডিতের সাংসারিক ঝামেলায় তাঁর ভূমিকা আর বিজয়ালক্ষী পন্ডিতের প্রেম কাহিনী। অসম্ভব স্মৃতিধর ছিলেন। অর্থনীতিতে কী হবে জানি না। তবে বাংলা সাহিত্য তাকে বহুদিন মনে রাখবে।
দু’তিনবার তাঁর সোনালী অ্যাপার্টমেন্টে যাওয়ার সুযোগ হয়েছে। নিজে চা করে প্লেটসহ কাপ হাতে তুলে দিয়েছেন। আগে আমার বা আমাদের কথা শুনেছেন, তারপর তাঁর কথা বলেছেন। আসার সময় নিজে দরজা খুলে, লিফট ডেকে তাতে চড়িয়ে তারপর ছেড়েছেন। আপাদমস্তক সাদা ধুতি, পাঞ্জাবিতে মোড়া বাঙালি ভদ্রলোক ছাড়া আর কী বলা যায়!
সে কারণে তিনিই কেবল বলতে পারেন, ‘আমি ভদ্রলোক নই, আমি কমিউনিস্ট’।

Leave A Reply

Your email address will not be published.