অতীতে কংগ্রেসকে সরাতে সিপিএম বিজেপিকে সমর্থন করতে পেরেছিল, কিন্তু আজ বিজেপিকে হারাতে মমতার পাশে দাঁড়াতে পারল না

গত শনিবার কলকাতার ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে যে সমাবেশ হয়ে গেল তাকে বলা যেতে পারে স্বাধীনতা পরবর্তী দেশের বৃহত্তম বিরোধী সমাবেশ। জয়প্রকাশ নারায়ণ, জ্যোতি বসুর ডাকেও এমনটা সম্ভব হয়নি। একটি স্লোগানের নীচে এতগুলো বিরোধী দল এক মঞ্চে অতীতে কখনও আসেনি। সেদিক থেকে ব্রিগেডের এই সভা বাড়তি গুরুত্ব পেতে বাধ্য। এই ব্রিগেড থেকে অন্ধ্রে এবং দিল্লিতে আরও দু’টি বিরোধী জমায়েতের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। অর্থাৎ, বলটা গড়াতে শুরু করেছে। গোল পোস্ট অবশ্য এখনও কিছুটা দূরেই। তবে গোলকিপার যে কিছুটা বিপর্যস্ত, সন্দেহ নেই।
ভারতে বিরোধী শক্তির জোট বাঁধার যে ইতিহাস, তাতে বামপন্থীদের পছন্দ না হলেও এটা সত্যি যে, ভি পি সিংহ, জ্যোতি বসুদের পতাকাই আজ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে। ১৯৮৭ সালের এপ্রিলে সুইডিশ রেডিও ফাঁস করে বোফর্স কাণ্ড। তোলপাড় হয়ে যায় গোটা দেশ। এই ঘটনার চার মাস পর রাজীব গান্ধীর মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন ভি পি সিংহ। ছেড়ে দেন সাংসদ পদও। বোফর্সে নাম জড়ায় এলাহাবাদের সাংসদ রাজীব গান্ধীর বন্ধু অমিতাভ বচ্চনের। সাংসদ পদ থেকে ইস্তফা দেন অমিতাভ। ১৯৮৮-র জুনে সেই এলাহাবাদ উপনির্বাচনে প্রার্থী হয়ে ভি পি সিংহ বিপুল ভোটে জয়ী হলেন। কলকাতার শহিদ মিনারে সম্বর্ধনা দেওয়া হল ভি পিকে। সঙ্গে অটল বিহারী বাজপেয়ী, জ্যোতি বসু। সেই ছবি এখনও মনে রেখেছে কলকাতা। সেদিন সেই মঞ্চ থেকেই শুরু হয়েছিল ক্ষমতাসীন কংগ্রেস সরকারের পতনের কাউন্ট ডাউন।
ভি পি সিংহের নেতৃত্বে অরুণ নেহরু, আরিফ মহম্মদ খান, অশোক সেনরা তৈরি করেন জনমোর্চা। পরে যার নাম হয় জনতা দল। ভ্রষ্টাচার বিরোধী আন্দোলনের জেরে ১৯৮৯-এর লোকসভা ভোটে বিজেপি এবং বামপন্থীদের সমর্থনে ক্ষমতাশীন কংগ্রেসকে পরাজিত করে দিল্লিতে তৈরি হল জনতা দলের সরকার।
এর পর প্রায় তিন দশক কেটে গিয়েছে। ফের কলকাতা দেখছে বিরোধী শক্তির সমাবেশ। জ্যোতি বসু, অটল বিহারী বাজপেয়ী, ভি পি সিংহের মতো বিরোধী নেতারা আজ প্রয়াত। কিন্তু তাঁদের সেই বিরোধী শক্তির পতাকা আজ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে। এর মধ্যে গঙ্গা দিয়ে বহু জল বয়ে গিয়েছে।
সেদিনের কংগ্রেসের অবস্থানে আজ মোদীর নেতৃত্বে বিজেপি। আজ কংগ্রেস বিরোধী শক্তির সঙ্গী। শুধু তাই নয়, তিন দশক আগের কলকাতার সেই বিরোধী সমাবেশের থেকে এবারের বিরোধী সমাবেশে গুরুত্ব কিছুটা বেশিও। সেবারে ছিল বোফর্স নিয়ে ভ্রষ্টাচার মূল ইস্যু। এবারে রাফাল, সঙ্গে আরও বড় ইস্যু গণতন্ত্র বাঁচাও। তিন দশক আগের মঞ্চে যত জন বিরোধী নেতা ছিলেন, এবারের মঞ্চ দেখা গেল তার থেকে অনেক বেশি সংখ্যক দলের বিরোধী নেতাকে।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ১৯৯২ সাল থেকে অনেকগুলো জনসভা করেছেন ব্রিগেডে। সেসবই ছিল রাজ্য-রাজনীতির বিষয়। কিন্তু শনিবারের ব্রিগেডের জনসভার রাজনৈতিক গুরুত্ব একেবারেই ভিন্ন। মমতা নাম দিয়েছেন, ‘ইউনাইটেড ইন্ডিয়া’। বাস্তবিকই তাই।
বিহারে একটা পরীক্ষা হয়েছিল বিরোধী শক্তির। ২০১৫ সালে। সব ভোট-সমীক্ষাকে হাস্যকর করে তুলে বিরোধী জোটের শক্তির কাছে বিজেপিকে বড় হার স্বীকার করতে হয়েছিল বিহার বিধানসভার ভোটে। কিন্তু নীতীশ কুমার জোট ত্যাগ করায় সেই সুদিন বেশি দিন স্থায়ী হয়নি। এর পর ২০১৯-এর লোকসভা ভোটকে সামনে রেখে এবছর বেশ কয়েকটা চেষ্টা হয়েছে বিরোধী জোট গড়ার। কখনও ডাক দিয়েছেন সোনিয়া গান্ধী, কখনও ডাক দিয়েছেন লালুপ্রসাদ। কিন্তু কোনও ক্ষেত্রেই সেই প্রচেষ্টা সম্পূর্ণ হয়নি। গত ডিসেম্বরে সোনিয়ার সভা এড়িয়ে গিয়েছিলেন মায়াবতী-অখিলেশরা। মায়াবতীর দল যোগ দেয়নি লালুর পাটনা র‍্যালিতেও। সোনিয়ার ডাকে অবশ্য গিয়েছিলেন সীতারাম ইয়েচুরি।
অতীতে সিপিএম বিজেপিকে সমর্থন করতে পেরেছিল কংগ্রেসকে সরাতে, কিন্তু বিজেপিকে সরানোর এই উদ্যোগে মমতার পাশে দাঁড়াতে পারল না। সিপিএম সোনিয়ার ডাকে সাড়া দিতে পারল, কিন্তু মমতার বিরোধী সমাবেশ শুধু এড়িয়ে গেল না, বিজেপি-তৃণমূল এক, প্রায় এই ধরনের কথা লেখা হল গণশক্তিতে। যদিও সিপিএমের ত্রিপুরা পার্টির মুখপত্রে প্রায় যথাযথভাবে ব্রিগেডের এই বিরোধী সমাবেশের রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। ক্ষমতাচ্যুত হয়ে রাজ্য সিপিএম যে আচরণ করছে তাতে রাজনৈতিক দক্ষতার চেয়ে অভিমানের প্রকাশই যেন বেশি মনে হয়। তৃণমূল কংগ্রেস এখন এই রাজ্যে শাসক দল। শাসক দলের বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ থাকবে না, এমন হতে পারে না। কিন্তু যে উদ্দেশ্য নিয়ে কলকাতায় এত বড় বিরোধী জমায়েত হয়ে গেল, তার যে সব দাবি, সিপিএম কি তার পক্ষে? না বিপক্ষে? এই সহজ উত্তরটা কি বিমান বসুরা দেবেন? এত বড় সর্বভারতীয় বিরোধী সমাবেশ থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে রেখে সিপিএম নিজেদের ক্রমেই আরও অপ্রাসঙ্গিক করে তুলছে। যে ২৩টি দল ব্রিগেডের সভায় এসেছিল, ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে তাদের মোট প্রাপ্ত ভোট, যারা আসেনি সেই বিজেপি, টিআরএস, বিজেডি, অকালি ইত্যাদি দলের প্রাপ্ত ভোটের চেয়ে অনেকটাই বেশি। সিপিএম কি দেশের বেশির ভাগ মানুষের সঙ্গে থাকতে চায়, না চায় না? সামনে সিপিএমের ব্রিগেড। সেখানে ভালো জমায়েত করতে চাইবে সিপিএম, সেটা দোষের নয়। কিন্তু তাদের সর্বভারতীয় রাজনীতির ক্ষেত্রে যে ভূমিকা, তাতে তাঁরা আগে ঠিক করুন দলটার নাম কমিউনিস্ট পার্টি অফ ইন্ডিয়া না কমিউনিস্ট পার্টি অফ বেঙ্গল রাখবেন!
ব্রিগেডের এই সভাকে স্বাগত জানিয়েছেন অমর্ত্য সেনও। কারণ লড়াইটা ‘ফ্যাসিস্ট’ শক্তির বিরুদ্ধে। এর উপর ভারতের সংবিধানের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে। এটা অনেকেই বুঝছেন, শুধু সূর্য মিশ্র, বিমান বসুরা মূল বিষয় নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে বাইনোকুলার হাতে মাঠে নেমে পড়েছেন, ব্রিগেডের লোক মাপতে। এই হাস্যকর উদ্যোগ শুধু সিপিএমকে মানুষের থেকে বিচ্ছিন্ন করবে না, বামপন্থা সম্পর্কে ভুল বার্তা দেবে মানুষকে।

(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)

Comments are closed.