আরোয়াল-কলিঙ্গনগর-নন্দীগ্রাম-তুতিকোরিন, ভারতে প্রকৃতই এখন ‘ডায়ার মুহূর্ত’ চলছে।

কিছুদিন আগে বিখ্যাত সমাজতাত্ত্বিক পার্থ চট্টোপাধ্যায় এক নিবন্ধে লিখছিলেন, ভারতের এখন ‘ডায়ার মুহূর্ত’ চলছে। তুতিকোরিন গণহত্যার পর কথাটা মনে পড়ে গেল। জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের পর জেনারেল ডায়ার গণহত্যাকে সমর্থন করে বলেছিলেন, এটা জরুরি ছিল। এমন কিছু করা দরকার ছিল যাতে সারা পঞ্জাবের মানুষকে সমঝে দেওয়া যায়, বৃটিশ শাসনের বিরোধিতা করলে কী হতে পারে। তুতিকোরিনের গণহত্যার পরেও প্রায় একই কথা বলেছেন তামিলনাড়ুরর মন্ত্রীরা। বলেছেন, এই গুলি চালনা অবশ্যম্ভাবী ছিল। পুরো ঘটনাবলী খেয়াল করলে দেখতে পাবেন, এটা ছিল পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড।
বেদান্তের ওই কারখানার বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের শান্তিপূর্ণ আন্দোলন ক্রমশ যে গভীরতায় বিস্তার লাভ করছিল তাতে কারখানা সম্প্রসারণ তো দূরের কথা, আন্দোলনকারীদের দাবি মেনে কারখানা সম্পুর্ণ বন্ধ করে দিতে হতো। দ্বিতীয় পথ ছিল, রক্তের বন্যায় ডুবিয়ে আন্দোলন স্তব্ধ করা। তামিলনাড়ুর দুর্বল সরকার এই দ্বিতীয় পথটাই বেছে নিলেন। কারণ, বেদান্তের মত প্রভাবশালী আন্তর্জাতিক কোম্পানির চাপ সহ্য করা দুর্বল তামিলনাড়ু সরকারের পক্ষে সম্ভব ছিল না। তাহলে সরকারে টিকে থাকাই তাদের পক্ষে কঠিন হতো। তাই অনিবার্যতার যুক্তিতে রক্তের বন্যায় ডুবিয়ে দিল তুতিকোরিনের মাটি। একই ছবি আপনারা দেখতে পাবেন যে কোনও গণহত্যার ক্ষেত্রেই।
নন্দীগ্রাম থেকে কলিঙ্গনগর, আদিলাবাদ থেকে আরোয়াল। সমস্ত গণহত্যার পরেই প্রায় একই যুক্তি শোনা যায়। ভারতজুড়ে প্রায় সমস্ত সংসদীয় দলের শাসনকালেই কোনও না কোনও রাজ্যে গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে। সবারই হাত শ্রমজীবী মানুষের রক্তে রাঙানো। নন্দীগ্রামে লালঝান্ডা হাতে সিপিএম  পরিচালিত বামফ্রন্ট সরকারও একই উন্নয়ন, শিল্পায়নের যুক্তিতে একলপ্তে ১৪ জন মানুষকে হত্যা করেছে ২০০৭ সালের ১৪ মার্চ। সেটাও ছিল মহাকরণ ও আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের কেন্দ্রীয়ভাবে পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। সিঙ্গুরের পর নন্দীগ্রামেও ব্যর্থ হলে দেশি বিদেশি পুঁজিপতিরা ক্ষমতায় থাকতে দেবে না, এটা বুঝেছিল সিপিএম। তাই শেষ চেষ্টা ছিল গুলি চালিয়ে গণহত্যা করে হলেও শিল্পপতিদের বার্তা দেওয়া- আমরাও পারি, আমরা তোমাদেরই লোক। তোমাদের উন্নয়নের পক্ষে যতদূর যেতে হয় যাবো।
টাটা গোষ্ঠীর ইস্পাত কারখানার জন্য জবরদস্তি জমি নিতে গিয়ে কলিঙ্গনগরে ২০০৬ সালে গুলি চালিয়ে ১৩ জন প্রতিবাদকারীকে হত্যা করেছিল ওড়িশার বিজু জনতা  দল সরকার। আরেয়ালে কংগ্রেসের বিন্দ্যেশ্বরী দুবে সরকার জমি বিবাদকে কেন্দ্র করে নিম্নবর্ণের মানুষের জমায়েতে গুলি চালিয়ে  অন্তত ২৫-৩০ জনকে হত্যা করেছিল ১৯৮৬ সালে। তার কয়েক দিন আগেই মুখ্যমন্ত্রী এক জনসভায় বলেছিলেন, নকশালিদের উপযুক্ত শিক্ষা দেওয়া হবে। আরোয়াল হত্যাকান্ড ছিল ওই শিক্ষাদানেরই অঙ্গ। জালিয়ানাবাগ থেকে তুতিকোরিন প্রতিটি  গণহত্যাকাণ্ডই আসলে শাসকের ক্ষমতা হারানোর ভয়ের বহিঃপ্রকাশ। জনতাকে ‘শিক্ষা’ দিয়ে আন্দোলন ধবংস করে বার্তা দেওয়া-শাসনে থাকো। হয় আমার নিয়ন্ত্রণে থাকো, না হয় মরো। এ’ব্যাপারে সব শাসক দলেরই এক রা। সিপিএম তুতিকোরিন নিয়ে এখন অনেক বড় বড় কথা বলছে, তাদের মুখপত্রে কান্না আর প্রতিবাদের ঝড় বইছে। নন্দীগ্রামের সময় তারা ছিল ঠিক উলটো অবস্থানে। নির্লজ্জভাবে গণহত্যার সমর্থনে রাস্তায় নেমেছিল। পরে নিজেরা গুন্ডা- ক্যাডার দিয়ে বাহিনী বানিয়ে অনেক আন্দোলনকারীকে হত্যাও করেছিল নন্দীগ্রামে। কংগ্রেস দলের সভাপতি রাহুল গান্ধী তুতিকোরিনকে ‘রাষ্ট্রীয় গণহত্যা’ বলে নিন্দায় সোচ্চার হয়েছেন। অথচ এদেশে এখন পর্যন্ত পরিকল্পিত গণহত্যায় কংগেসের রের্কড কেউ ভাঙতে পারেনি। পশ্চিম বাংলার তৃনমূল সরকারও ভাঙড়ে জমি রক্ষা কমিটির আন্দোলন ভাঙতে গিয়ে জাত চিনিয়েছে। পুলিশের গুলিতে ইতিমধ্যেই অন্তত ২ জন মারা গেছেন।
যতই আইনের শাসনের কথা বলা হোক না কেন, ক্ষমতার দম্ভে বা ক্ষমতায় থাকার লোভে কেউই আইন-কানুনের বিন্দুমাত্র তোয়াক্কা করেনি, করেনা। জেনারেল ডায়ারের মতই, সমবেত জনতাকে ছত্রভঙ্গ করার জন্য পুলিশের ম্যানুয়ালে যাই নিদান দেওয়া থাকুক না কেন, কেউ মানেনি, মানেও না সেসব। মাইকে হুঁশিয়ারি, কাঁদানে গ্যাস, জল কামান, লাঠি, কোমরের নীচে পা লক্ষ্য করে গুলি- কোনও নির্দেশই কোনও ক্ষেত্রে মানা হয়নি। হত্যার জন্যই নির্বিচারে গুলি চলেছিল আরোয়াল, কলিঙ্গনগর থেকে নন্দীগ্রাম হয়ে তুতিকোরিন। যেমন নির্বিচারে গুলি চালিয়েছিলেন জেনারেল ডায়ার-জালিয়ানওয়ালাবাগে। সেই একই ঔপনিবেশিক দৃষ্টিভঙ্গী, একই ঔপনিবেশিক শাসন আইন, একই ঔপনিবেশিক পুলিশ-সেনা আইন ও কাঠামো। সমাজতাত্ত্বিক পার্থবাবু গভীর সত্যকেই তুলে ধরেছিলেন। ভারতে এখন প্রকৃতই ‘ ডায়ার মুহূর্ত ‘ চলছে। গণহত্যা ঘটিয়ে বলা যায়, দরকার ছিল।

(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)

Leave A Reply

Your email address will not be published.