পুরুলিয়ায় বিজেপির উত্থানে প্রধান ভূমিকা নিয়েছে প্রাক্তন সিপিএম নেতার নেতৃত্বে বজরং দল, রিপোর্ট গোয়েন্দাদের।

পুরুলিয়ার বলরামপুরে পরপর দুই বিজেপি কর্মীর অস্বাভাবিক মৃত্যুকে কেন্দ্র করে উত্তপ্ত রাজ্য রাজনীতি। যে উত্তাপের আঁচ পৌঁছেছে দিল্লিতেও। বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত শাহ পর্যন্ত এই দুই অস্বাভাবিক মৃত্য নিয়ে ট্যুইটে তৃণমূল কংগ্রেসকে অভিযুক্ত করে গোটা ঘটনায় নতুন মাত্রা যোগ করেছেন। এমাসের শেষেই অমিত শাহের রাজ্য সফর। তিনি পুরুলিয়াতেও যেতে পারেন বলেন খবর।
কিন্তু পঞ্চায়েত ভোটে পুরুলিয়ায় হঠাৎ বিজেপির এই শক্তি সঞ্চয়, দুই কর্মীর রহস্য মৃত্যু এবং তাকে কেন্দ্র করে বনধ ডাকা, পুরো ঘটনার ময়নাতদন্তে উঠে আসছে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। বিভিন্ন সূত্র মারফত সরকারের কাছে যে তথ্য পৌঁছেছে, পুরুলিয়ায় বিজেপির এই উত্থানের নেপথ্যে একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে বজরং দল। বিশেষ করে ২০১৭ এবং ২০১৮, পরপর দু’বছর রাম নবমীকে কেন্দ্র করে বজরং দলের কার্যকলাপ বিজেপির শক্তি বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ অণুঘটকের কাজ করেছে এই জেলায়। এবছর ২৫ মার্চ রাম নবমীর দিন পুরুলিয়ার বিভিন্ন জায়গায় রাম নবমীর মিছিলকে কেন্দ্র করে তীব্র সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। আরশাতে রাম নবমীর মিছিল চলাকালীন দুই গোষ্ঠীর মধ্যে সংঘর্ষে এক ব্যক্তির মৃত্যুও হয়। সেদিনই পুরুলিয়া শহরে রাম নবমীর মিছিলে লোক সমাগম, লোকের মুড এবং চেহারা দেখে চমকে উঠেছিলেন অনেক পুরনো স্থানীয় মানুষই। গত তিন-চারদিন ধরে পুরুলিয়ার পরিস্থিতি খতিয়ে দেখে রাজ্য গোয়েন্দা দফতরেরও রিপোর্ট, রাম নবমীর মিছিল থেকেই রাজনৈতিক মেরুকরণের কাজটা শুরু হয়েছে ঝাড়খন্ড লাগোয়া এই জেলায়।
সূত্রের খবর, গত দু’বছর ধরে পুরুলিয়া জেলায় বজরং দলকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন জেলার প্রাক্তন সিপিএম নেতা গৌরব সিংহ। কে এই গৌরব সিংহ, যাঁর নেতৃত্বে বজরং দল পুরুলিয়ায় দাপিয়ে বেড়াচ্ছে তা নিয়েও গত কয়েক দিন ধরে চর্চা শুরু হয়েছে রাজ্য পুলিশ এবং প্রশাসনের অন্দরে। প্রশাসন সূত্রে জানা যাচ্ছে, পুরুলিয়া শহরের ১০ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা গৌরব ২০০৭ সালে জগন্নাথ কিশোর কলেজে ভর্তি হন। কলেজে থাকতে থাকতেই সিপিএমের ছাত্র সংগঠন এসএফআইয়ে যোগ দেন তিনি। এসএফআইয়ে দ্রুত উত্থান হয় গৌরবের। তিন বছর কলেজে প্রত্যক্ষ রাজনীতি করার পর ২০১০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সংগঠনের বলরামপুর কনফারেন্সে এসএফআইয়ের জেলা সম্পাদক হন গৌরব। দু’বছর এসএফআইয়ের পুরুলিয়া জেলার সম্পাদক ছিলেন তিনি। এরপর ২০১২ সালে তিনি জেলা এসএফআইয়ের সভাপতি নির্বাচিত হন। জেলাজুড়েই ছাত্র সংগঠনে কাজে গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় ছিলেন তিনি। এরই মাঝে সিপিএমের সদস্যপদও পান তিনি। ২০১৪ সালে কলেজ নির্বাচনে প্রার্থী দেওয়াকে কেন্দ্র করে জেলার পার্টি নেতাদের সঙ্গে এসএফআই সভাপতি গৌরবের সংঘাতের সূত্রপাত। সূত্রের খবর, কিছু কলেজের নির্বাচনে প্রার্থী না দেওয়ার পক্ষপাতী ছিলেন তিনি। সংঘাত এমন জায়গায় পৌঁছোয়, এরপর গৌরব সিংহকে দল থেকে বহিষ্কার করে জেলা সিপিএম।
২০১৬ সালের পর গৌরব সিংহ সরাসরি বজরং দল করতে শুরু করেন। ২০১৭ সালে পুরুলিয়া শহরে বিরাট রাম নবমীর মিছিলের নেতৃত্ব দেন তিনি। সিপিএমের উদীয়মান নেতা, সেখান থেকে বজরং দলে গিয়ে পুরনো পরিচিত প্রচুর কম-বয়সী ছেলেকে নিজের দিকে টানেন তিনি। এবছর ২৫ মার্চ পুরুলিয়ায় রাম নবমীর মিছিলও বেরোয় তাঁরই নেতৃত্বে। প্রাক্তন এসএফআই নেতা এবং সিপিএম সদস্য গৌরবের বজরং দলের নেতা হিসেবে এই উত্থানে প্রথমে তেমন গুরুত্ব দেয়নি প্রশাসনও। কিন্তু পঞ্চায়েত ভোটের পর নড়েচড়ে বসে প্রশাসন। নিজের ফেসবুক পেজে বিতর্কিত এবং উত্তেজনামূলক মন্তব্য পোস্ট করার অভিযোগে গত ২১ মে পুলিশ গৌরব সিংহকে গ্রেফতার করতে পুরুলিয়া পুলিশ। সম্প্রতি ভিন্ন একটি মামলায় তাঁকে মুর্শিদাবাদে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। তাঁর গ্রেফতারের পরই বজরং দল এবং বিজেপির সদস্যরা ফেসবুক পেজে শাসক দল বিরোধী প্রচারে ঝড় তোলেন।

পুরুলিয়ায় বজরং দলের বাড়বাড়ন্ত ইতিমধ্যেই চিন্তায় ফেলেছে প্রশাসনকে। ৩ মে পুরুলিয়ায় বিজেপির পক্ষ থেকে যে বনধ ডাকা হয়েছিল, সেদিন উত্তেজনা ছড়ানোর অভিযোগে মানবাজার থেকে ১১ জন বজরং দলের সদস্যকে গ্রেফতার করে পুলিশ। যদিও পরে তাঁদের ছেড়ে দেওয়া হয়। গোয়েন্দাদের খবর, গৌরব সিংহের মতোই এসএফআই এবং সিপিএমের একাধিক কম-বয়সী নেতার হাত ধরে পুরুলিয়ার বিভিন্ন জায়গায় শক্তি বৃদ্ধি করছে বজরং দল এবং বিজেপি।

Leave A Reply

Your email address will not be published.