ঘুষকাণ্ডে অভিযুক্ত রাকেশ আস্থানাকে সাসপেন্ডের সুপারিশ করল সিবিআই, সোমবার পর্যন্ত তাঁকে গ্রেফতার করা যাবে না, বলল আদালত

খোদ প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপেও বরফ গলল না। বরং দেশের প্রধান গোয়েন্দা সংস্থা সিবিআই প্রধান এবং সংস্থার স্পেশাল ডিরেক্টরের দ্বৈরথ নতুন মাত্রা পেল মঙ্গলবার। ঘুষ নেওয়ার অভিযোগে আগেই সিবিআই-এর স্পেশাল ডিরেক্টর রাকেশ আস্থানার বিরুদ্ধে মামলা শুরু করেছিল সিবিআই। এবার তাঁকে সাসপেন্ড করার সুপারিশ করা হল সিবিআই-এর পক্ষ থেকে।
এর ফলে সিবিআই প্রধান আলোক ভার্মা বনাম কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পদাধিকারী স্পেশাল ডিরেক্টর রাকেশ আস্থানার দ্বৈরথ নতুন মাত্রা নিলো। এর আগে দুর্নীতির অভিযোগে সিবিআই-এর তরফে রাকেশ আস্থানার বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করা হয়েছিল। সূত্রের খবর, সোমবারই কেন্দ্রের কাছে আস্থানাকে সাসপেন্ডের সুপারিশ করেছেন খোদ সিবিআই প্রধান অলোক ভার্মা। অন্যদিকে, তাঁর বিরুদ্ধে হওয়া এফআইআরের বিরুদ্ধে মঙ্গলবার দিল্লি হাইকোর্টে আবেদন করেছেন রাকেশ আস্থানা। তাঁর আইনজীবী আদালতে জানান, ‘আস্থানা গ্রেফতারির আশঙ্কা করছেন।’ যার পরিপ্রেক্ষিতে এদিন দিল্লি হাইকোর্ট জানিয়েছে, আগামী সোমবার পর্যন্ত আস্থানাকে গ্রেফতার করা যাবে না। মামলার পরবর্তী শুনানি সেদিনই ধার্য হয়েছে।
ওয়াকিবহাল মহলের মতে, বিষয়টি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এমন বেনজির ঘটনা সিবিআই-এর ইতিহাসে কখনই ঘটেনি। দেশের প্রধান গোয়েন্দা সংস্থার একেবারে শীর্ষ পদে এই নজিরবিহীন সংঘাতের জেরে রবিবারই বিবাদমান দুই সিবিআই কর্তাকে তলব করেছিলেন খোদ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। এরপরেই মোদীর সঙ্গে দেখা করেন সিবিআই প্রধান অলোক ভার্মা। এই বৈঠকের পর সিবিআই-এর পক্ষ থেকে কেন্দ্রের কাছে আস্থানাকে সাসপেন্ড করার সুপারিশ বিষয়টিকে অন্য মাত্রা দিলো।
এই ঘটনার গুরুত্ব আরও বেড়েছে, কারণ, গুজরাত ক্যাডারের আইপিএস অফিসার রাকেশ আস্থানা নরেন্দ্র মোদীর পছন্দের লোক বলেই পরিচিত। অন্যদিকে, মোদী ক্ষমতায় আসার পরই সিবিআই-এর মাথায় বসেন অলোক ভার্মা। তারপর রাকেশ আস্থানাকে গুজরাত থেকে দিল্লিতে সিবিআই দফতরে নিয়ে এসে এই মোদী জমানাতেই অস্থায়ী ডিরেক্টরের পদে বসানো হয়। পরে তাঁর পদোন্নোতি হওয়ায় তাঁকে সিবিআই-এর স্পেশাল ডিরেক্টর করা হয়। অলোক ভার্মার কার্যকালের মেয়াদ শেষ হচ্ছে চলতি বছরের ডিসেম্বর মাসে। তাঁর মেয়াদ শেষ হওয়ার পর রাকেশ আস্থানাই সিবিআই-এর মাথায় বসবেন এটা প্রায় নিশ্চিত ছিল বলেই সূত্রের খবর। কিন্তু তার আগেই ঘুষকাণ্ডে আস্থানার বিরুদ্ধে এফআইআর, তাঁর ঘনিষ্ঠ ডিএসপি’কে গ্রেফতার এবং তাঁকে সাসপেন্ড করার সুপারিশ করে কেন্দ্রের ওপর যে চাপ অলোক ভার্মা তৈরি করেছেন, তা রাজনৈতিকভাবেও অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।
আস্থানা বরাবরই মোদী এবং বিজেপি সভাপতি অমিত শাহের পছন্দের লোক বলে পরিচিত। ২০০২ সালে সবরমতী ট্রেন অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার তদন্তে যে বিশেষ তদন্তকারী দল গঠন করা হয় গুজরাত সরকারের তরফে, তার মাথায় ছিলেন এই রাকেশ আস্থানা। কিন্তু তিনি সিবিআইতে যোগ দেওয়ার পরই বহু কোটি টাকার হাওয়ালা অর্থ তছরূপ মামলায় জড়িয়ে যায় আস্থানার নাম। এই ঘটনার মূল অভিযুক্ত মইন কুরেশি নামের এক মাংস রফতানিকারী ব্যবসায়ী ও তাঁর সহযোগী হায়দরাবাদের ব্যবসায়ী জনৈক সতীশ সানা। এই ঘটনার তদন্ত চালাচ্ছিল সিবিআই ও ইডি। সূত্রের খবর, সতীশ সানা তদন্তকারীদের জানান, চার্জশিটে যাতে তাঁর নাম না থাকে তার জন্য তিনি ২ কোটি টাকা ঘুষ দেন আস্থানকে। আস্থানার আর এক সহযোগী সিবিআই অফিসার দেবেন্দ্র কুমারকেও তিনি ৩ কোটি টাকা ঘুষ দিয়েছেন বলে দাবি করেন সতীশ সানা। এই অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে দেবেন্দ্রকে ইতিমধ্যেই গ্রেফতার করেছে সিবিআই। পাশাপাশি, সিবিআই নিজেরই সংস্থার স্পেশাল ডিরেক্টর আস্থানার বিরুদ্ধে ১৫ অক্টোবর এফআইআরও করেছে। তাঁর বিরুদ্ধে এই ঘুষকাণ্ড ছাড়াও একাধিক অভিযোগ রয়েছে বলে জানিয়েছে সিবিআই।
পিছিয়ে নেই আস্থানাও। পালটা হিসেবে তিনিও সরাসরি অভিযোগ এনেছেন সিবিআই প্রধান অলোক ভার্মার বিরুদ্ধে। কেন্দ্রের ক্যাবিনেট সেক্রেটারিকে চিঠি লিখে আস্থানা বলেছেন, তাঁকে চক্রান্ত করে ফাঁসাতে চাইছেন ভার্মা ও তাঁর সহযোগীরা। সিবিআই প্রধানের বিরুদ্ধে পালটা ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ এনেছেন আস্থানা।
সিবিআই-এর অন্দরে এই নজিরবিহীন অন্তর্কলহ নিয়ে ইতিমধ্যেই ময়দানে নেমেছে বিরোধীরা। রাহুল গান্ধীর অভিযোগ, সিবিআইকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করছে মোদী সরকার। মুখে গুড গভর্নেন্সের কথা বললেও খোদ প্রধানমন্ত্রী ঘনিষ্ঠ সিবিআই শীর্ষ কর্তা বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠছে। পাশাপাশি, স্পেশাল ডিরেক্টর পদমর্যাদার অফিসার, যিনি সিবিআই প্রধান হতে পারেন তাঁর বিরুদ্ধেই ঘুষের অভিযোগ ওঠায় ইতিমধ্যেই রীতিমতো চাপে কেন্দ্র। প্রশ্ন উঠছে, যাঁর বিরুদ্ধে এত বড় দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে, তাঁকে কি আদৌ সিবিআই প্রধান করা সম্ভব মোদী সরকারের পক্ষে?

Comments are closed.