‘ধর্মনিরপেক্ষতার আসল চেহারা বেরিয়ে পড়েছে’, সাবরিমালা ইস্যুতে কংগ্রেসের সমালোচনা কারাট ঘনিষ্ঠ সিপিএম নেতার, চাপে আলিমুদ্দিন

সাবরিমালা মন্দিরে সব বয়সী মহিলার প্রবেশাধিকার নিয়ে যে ঐতিহাসিক রায় সুপ্রিম কোর্ট দিয়েছে, তা আরও একবার এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার সন্ধিক্ষণে এনে ফেলল সিপিএমকে। বলা যেতে পারে, এ কে গোপালন ভবনকে দাঁড় করিয়ে দিল এক ঐতিহাসিক মুহূর্তে। কংগ্রেসকে কি আদৌ ধর্মনিরপেক্ষ বলা যায়, সিপিএমের অন্দরে এই মৌলিক প্রশ্ন এবার জোরালোভাবে তুলে ধরলেন দলের প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ কারাট ঘনিষ্ঠ পলিটব্যুরো সদস্য এস রামচন্দ্রণ পিল্লাই।
কয়েকদিন আগেই দলের কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে ২০১৯ লোকসভা ভোটের কৌশলগত অবস্থান চূড়ান্ত করেছে সিপিএম। কংগ্রেসের সঙ্গে সমঝোতার রাস্তা খোলা রেখে সিপিএম স্লোগান দিয়েছে, বিজেপি হঠাও, নিজেদের ও বামপন্থীদের শক্তিবৃদ্ধি করো এবং বিকল্প ধর্মনিরপেক্ষ সরকার গঠন করো। এই তিনটি স্লোগানের মধ্যে দিয়ে সিপিএম সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি এবং দলের কংগ্রেসপন্থীদের রাজনৈতিক লাইনই দলে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। কারণ, ২০১৪ লোকসভা ভোটের পর থেকে প্রকাশ কারাট বারবারই বলে এসেছেন, বিজেপি এবং কংগ্রেস দু’দলই অর্থনৈতিক নীতির ক্ষেত্রে সমান বিপজ্জনক এবং দু’দলের বিরুদ্ধেই একযোগে লড়াই দরকার। কারাট এবং কংগ্রেস সম্পর্কে কট্টরপন্থীদের বিরুদ্ধে ইয়েচুরি এবং বাংলার সিপিএম নেতাদের মূল বক্তব্যই ছিল, সাম্প্রদায়িকতাই এই মুহূর্তে দেশের মূল বিপদ এবং ধর্মনিরপেক্ষতার প্রশ্নে, কংগ্রেসের সঙ্গে জোট বা সমঝোতার দরজা খোলা রাখা উচিত। ২০১৫ সালে ইয়েচুরি দলের সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পর তাঁর এই তত্ত্বই দলে ধীরে ধীরে প্রতিষ্ঠিত হয়, যার ফলে যেমন একদিকে ২০১৬ বিধানসভা নির্বাচনে বাংলায় আলিমুদ্দিন স্ট্রিট কংগ্রেসের সঙ্গে আসন সমঝোতা করে, অন্যদিকে তেমনই আসন্ন লোকসভার কৌশলগত লাইনেও কংগ্রেস সম্পর্কে নরম অবস্থান নেওয়া হয়।
কিন্তু গোটা পরিস্থিতি নতুন মোড় নিল সেপ্টেম্বরের শেষে কেরলের সাবরিমালা মন্দির নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পর। এর প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে প্রথমে তা পুরোপুরি বোঝা না গেলেও, সম্প্রতি এই মন্দির পাঁচদিন খোলা থাকার পর সিপিএম এখন বুঝতে পারছে, কী দ্রুত পরিস্থিতির বদল হচ্ছে। সুপ্রিম কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে একদিকে যখন মন্দির কর্তৃপক্ষ, কেরলের বিভিন্ন ধর্মীয় সংগঠন রাস্তায় নেমে পড়েছে এবং সরাসরি তাদের মদত দিচ্ছে আরএসএস, বিজেপি তখন কেরলে পিনারাই বিজয়নের নেতৃত্বাধীন সিপিএম সরকার দৃঢ় অবস্থান নিয়েছে সুপ্রিম কোর্টের রায় কার্যকর করতে। মহিলাদের মন্দিরে বাধা দেওয়ার জন্য বেশ কিছু লোককে গ্রেফতার করতেও পিছপা হয়নি কেরলের সিপিএম সরকার। কিন্তু কেরলে মূল বিরোধী দল কংগ্রেসের ভূমিকা নিয়ে এবার সরব হলেন সিপিএমের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নেতা এস আর পিল্লাই।
সিপিএমের মুখপত্র ‘পিপলস ডেমোক্রেসি’র ২১ অক্টোবর সংখ্যায় ‘সাবরিমালা টেম্পল ইস্যুঃ দ্য বিজেপিস প্লয় অ্যান্ড দ্য কংগ্রেস ফলি’ শীর্ষক এক লেখায় এস আর পিল্লাই ধর্মনিরপেক্ষতার প্রশ্ন তুলে কংগ্রেসের তীব্র সমালোচনা করেছেন। এস আর পিল্লাই লিখেছেন, ‘সিপিএম মহিলা এবং পুরুষদের সমান অধিকারে বিশ্বাস করে। কিন্তু সমস্ত বয়সী মহিলার এই মন্দিরে প্রবেশে বাধা দিয়ে আরএসএস, বিজেপি কেরলের সমাজকে পুরনো, অন্ধকার এবং কুসংস্কারাচ্ছন্ন দিনে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চাইছে। এবং কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউডিএফ এই কাজে বিজেপিকে সমর্থন করছে।’

শুধু কেরল কংগ্রেসের সমালোচনা করেই থামেননি এস আর পিল্লাই। এরপরই তিনি লিখেছেন, ‘সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পর অল ইন্ডিয়া কংগ্রেস কমিটি সাবরিমালা মন্দিরে সমস্ত মহিলার প্রবেশের বিষয়টিকে স্বাগত জানিয়েছিল। কেরল কংগ্রেসও প্রথমে স্বাগত জানায় এই রায়কে। কিন্তু রায়কে নিয়ে ভক্ত এবং পূজারিদের একাংশের মধ্যে বিভ্রান্তির বিষয়টি বুঝতে পেরে তারা আরএসএস এবং বিজেপির সঙ্গে মিলে রায়ের বিরোধিতা শুরু করে, মানুষকে এই রায়ের বিরুদ্ধে জোটবদ্ধ করতে শুরু করে। এর ফলে ধর্মনিরপেক্ষতার প্রশ্নে কংগ্রেসের আসল চেহারা আবার মানুষের সামনে উন্মোচিত হয়ে পড়ল। এই নীতি কেরলে কংগ্রেসের আরও পতন ডেকে আনবে এবং তাদের একটা বড় অংশকে বিজেপি গিলে খেয়ে নেবে, যা ইতিমধ্যেই অনেক রাজ্যে হয়েছে।’
সাবরিমালা মন্দিরে সমস্ত মহিলার প্রবেশের ইস্যুতে একদিকে সিপিএম পরিচালিত কেরল সরকারের দৃঢ়, প্রগতিশীল মনোভাব এবং অন্যদিকে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের বিরোধিতায় বিজেপি এবং কংগ্রেসের রাস্তায় নামা সেই রাজ্যে এক অভাবনীয় রাজনৈতিক পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে লোকসভা ভোটের আগে এই ইস্যুকে কড়া হাতে মোকাবিলা করতে বদ্ধপরিকর পিনারাই বিজয়ন সরকার। কীভাবে হবে এর মোকাবিলা, নিজের লেখায় তারও একটা দিশা দিয়েছেন এস আর পিল্লাই। তিনি লিখেছেন, ‘সাবরিমালা মন্দির নিয়ে দলের অবস্থান স্পষ্ট, পুরনো দিনে ফিরে যাওয়ার প্রশ্ন নেই। সুপ্রিম কোর্টের রায় মানতে কেরল সরকার সাংবিধানিকভাবে বাধ্য। তার জন্য রাজ্যজুড়ে ব্যাপক প্রচার অভিযানে নামার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে পার্টির পক্ষ থেকে। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে দলের সমস্ত কমিটিকে প্রচার-কর্মসূচির ব্যাপারে ওয়াকিবহাল করা হবে। নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে কেরলের প্রত্যেকটি জেলায় জনসভা হবে। মুখ্যমন্ত্রী বিজয়নসহ দলের সমস্ত শীর্ষ নেতা এই জনসভায় অংশ নেবেন। রাজ্যের ১৪০ টি বিধানসভাতেই প্রচার অভিযান চলবে।’
কেরল তো বটেই আগামী দিনে গোটা দেশেই দলের সামনে সাবরিমালা ইস্যু অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হতে চলেছে বলে বুঝতে পারছেন সিপিএম নেতৃত্ব। কিন্তু এই ইস্যুতে কংগ্রেসের যা অবস্থান, তাতে তাদের সম্পর্কে ভবিষ্যতে কী সিদ্ধান্ত হবে, তা নিয়ে সিপিএমের অন্দরে আরও একটা বিতর্কের দরজা খুলে গেল বলেই মনে করছেন দলের নেতৃত্বের একাংশ।

Comments are closed.