অর্থনৈতিক দৈন্য প্রকট হচ্ছে ব্রিটেনসহ গোটা ইউরোপে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী পরিস্থিতির থেকেই খারাপ দিন সামনেঃ সোশ্যালিস্ট অ্যাপিল

এই মুহূর্তে বিশ্বের অর্থনীতি কোন জায়গায় দাঁড়িয়ে? অর্থনৈতিক দুর্যোগের আশঙ্কা কতটা সত্যি? আমেরিকা ও চিনই কি বিশ্ব অর্থনীতিকে চালনা করবে? ২০১৯ সালে বিশ্ব অর্থনীতিতে ভারতের অবস্থান কোথায়? এসবেরই মূল্যায়ন করলেন ব্রিটিশ রাজনীতিবিদ ও লেখক অ্যালান উডস। মার্ক্সবাদী সংগঠন ‘সোশ্যালিস্ট অ্যাপিল’এর মুখপত্রে প্রকাশিত হল বিশিষ্ট রাজনীতিবিদের মূল্যায়ন।
অ্যালান উডস লিখেছেন, ২০১৯ সালে ঢুকে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে আমরা ঢুকে পড়লাম এক চূড়ান্ত বাঁকে-পুঁজিবাদ এক নয়া শিখরে পৌঁছেছে, যার ভয়াবহতা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ের থেকেও ভয়ঙ্কর। ২০০৮ সালে আর্থিক পতনের পর ১০ বছর অতিক্রান্ত, এই ১০ বছরে বিশ্বের প্রথম সারির দেশগুলির আর্থিক দুর্যোগ কি কাটিয়ে ওঠা গিয়েছে? দুর্ভাগ্যক্রমে উত্তর হল ‘না’। সমৃদ্ধশালী দেশগুলির দৈন্য আরও প্রকট হয়েছে। মানুষের মধ্যে প্রতিষ্ঠান বিরোধী বিশ্বাস তৈরি হচ্ছে, হতাশা প্রকট হচ্ছে যুব সম্প্রদায়ের মধ্যে।
এক দশক আগে এক গণনা করে বোঝা গিয়েছিল, সরকার অর্থনৈতিক সুস্থিতি ফেরাতে গিয়ে সামাজিক ও রাজনৈতিক ভারসাম্যকে বিঘ্নিত করবে। হলও তাই। অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা করতে গিয়ে ইউরোপ মহাদেশের মধ্যে রাজনৈতিকভাবে সবচেয়ে স্থিতিশীল ব্রিটেনের আজ ভয়ানক অবস্থা। ব্রেক্সিট সমস্যায় একেবারে বিধ্বস্ত তারা। আর এই ব্রেক্সিট জট কাটার আপাতত কোনও আশার আলো দেখা যাচ্ছে না। ১৯৫৬ সালের সুইস সংকটের চেয়েও মারাত্মক ব্রেক্সিট সঙ্কট। তবে ইউরোপের সঙ্কট এখানেই শেষ নয়, বরং বলা ভালো, মাত্র শুরু। যে জার্মানি ও ফ্রান্সকে ইউরোপ মহাদেশের ভাগ্য নির্ধারণকারী দুই দেশ মনে করা হোত, দুর্ভাগ্যক্রমে দুই দেশ আজ অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক সঙ্কটে জখম হয়েছে। ইউরোপের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধিতে বিশেষ সাহায্যকারী দেশ, জার্মানির অবস্থা আজ তথৈবচ। দেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক দল, ক্রিশ্চান ডেমোক্রাটস ও সোশ্যাল ডেমোক্রাটসের দীর্ঘ অধিকারের লড়াই ব্যাহত করেছে দেশের অর্থনীতিকে। ক্রিশ্চান ডেমোক্রাটস দল থেকে নেত্রী অ্যাঞ্জেলা মর্কেলের পদত্যাগ সেই রাজনৈতিক দৈন্যের দিকে আঙুল তুলছে। একই অবস্থা দেখা যাচ্ছে ফ্রান্সের। এলিট শ্রেণীর প্রতিভূ, প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাকরেঁর বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভ আজ সর্বজনবিদিত। দেশের হাঁড়ির হাল ফেরাতে তেমন কোনও উদ্যোগ চোখে পড়ছে না। উল্টোদিকে পেট্রোপণ্যসহ নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের আকাশ ছোঁয়া দাম, মানুষের হাতে টাকা কমে আসা জন্ম দিয়েছে ‘ইয়েলো ভেস্ট’ আন্দোলনের। যে সব রাজনৈতিক সমঝদাররা প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট ওলাদঁ-এর চেয়ে মাকরঁকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে বেশি নম্বর দিয়েছিলেন, তাঁরা আজ একযোগে স্বীকার করছেন নিজেদের অপরিপক্কতা।
১৯২০ সালে ট্রটস্কি ভবিষ্যদ্বানী করেছিলেন, বিশ্ব ইতিহাসের কেন্দ্র ভূমধ্যসাগর থেকে আটলান্টিকের দিকে প্রবাহিত হচ্ছে, তা শীঘ্রই আটলান্টিক থেকে ভূমধ্যসাগরের দিকে বইবে। চরম সত্যে উপনীত হয়েছে তাঁর এই ভবিষ্যৎ চর্চা। আমেরিকা বা চিনের থেকে প্রযুক্তির ব্যবহারে ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছে ইউরোপের দেশগুলি। ব্রিটেন বা ফ্রান্সকে পেছনে ফেলে ২০১৯ সালেই ভারত জায়গা করে নেবে বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম অর্থনৈতিক দেশ হিসেবে। বিশ্ব অর্থনীতি আর ইউরোপ দ্বারা নির্ধারিত হবে না।
বিশ্ব অর্থনীতি এখন বহুলাংশে চিনের ওপর নির্ভরশীল। তবে সেখানেও রয়েছে সমস্যা। যেহেতু চিনের অর্থনীতি দাঁড়িয়ে রয়েছে মূলত রফতানির ওপর, ইউরোপ ও আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে চাহিদা কমে আসার ফল ভুগতে হবে তাদের। অন্যদিকে আমেরিকা ও চিনের মধ্যে বাণিজ্য যুদ্ধের নেতিবাচক  প্রভাব পড়বে বিশ্ব অর্থনীতিতে। পাশাপাশি, সুযোগ্য রাজনৈতিক নেতৃত্বের অভাবে প্রথম সারির দেশগুলির রাজনৈতিক স্থিরতা নষ্টের প্রভাব পড়ছে বিশ্ব অর্থনীতিতে। ইরান, ইরাক, টিউনিশিয়া, স্পেন, পাকিস্তান, রাশিয়া, টোগো, হাঙ্গেরি এবং অবশ্যই ফ্রান্সের গণ আন্দোলন অর্থনীতিকে খোঁড়া করে দিচ্ছে। সব মিলিয়ে অর্থনৈতিক দৈন্য প্রকট হচ্ছে বিশ্বজুড়ে।

Comments are closed.