অধীর অপসারণে বেকায়দায় আলিমুদ্দিন। সোমেন মিত্রকে এনে মমতাকে বার্তা দিল্লি কংগ্রেসের?

মাত্র কয়েক বছর আগেই যিনি ছিলেন তৃণমূল কংগ্রেসের সাংসদ, তাঁকে সেনাপতি করে কি আদৌ বাংলায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করা সম্ভব? শুক্রবার সোমেন মিত্রর প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি হওয়ার খবর চাউর হতেই এই প্রশ্ন বিব্রত করতে শুরু করেছে রাজ্যের সিপিএমপন্থী কংগ্রেস নেতাদের। শুধু তাই নয়, সর্বভারতীয় কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধীর এই চালে এখন রীতিমতো বেকায়দায় ৩১ নম্বর আলিমুদ্দিন স্ট্রিটও। এখনও রাজ্য সিপিএম নেতৃত্বের একটা বড় অংশই দলের কেন্দ্রীয় কমিটির লাইনকে অবজ্ঞা করে বাংলায় কংগ্রেসের সঙ্গে জোট বা আসন সমঝোতার পক্ষপাতী। তীব্র মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিরোধী ভাবমূর্তি গড়া তোলা অধীর চৌধুরী কংগ্রেসের রাজ্য সভাপতি থাকলে সূর্যকান্ত মিশ্রদের পক্ষে ব্যাপারটা যত সহজ হোত, সোমেন মিত্রর জমানায় পরিস্থিতি ততটা অনুকুল নাও থাকতে পারে বলে মনে করছেন সিপিএম নেতারা। বরং গত কয়েক সপ্তাহ ধরে কংগ্রেস হাইকমান্ডের মতিগতি দেখে রাজ্যের জোটপন্থী সিপিএম নেতারা খানিকটা চাপে পড়ে গিয়েছেন। কোনও কোনও সিপিএম নেতা তো ২০১৬ সালের বিধানসভা ভোটের উদাহারণ টেনে ব্যক্তিগত পরিসরে বলতে শুরু করেছেন, কংগ্রেসের ব্যাপারে এখনই সতর্ক না হলে ২০১৯ লোকসভা ভোটের আগে আম, ছালা দুইই যাবে।
পঞ্চায়েত ভোটের সময় থেকেই বাংলার রাজনীতি কার্যত শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস এবং বিজেপির দ্বৈরথে পরিণত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি অমিত শাহর পরপর রাজ্য সফর এবং অসমের নাগরিকপঞ্জি ইস্যুতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কেন্দ্র বিরোধী চড়া সুর তাতে আরও গতি এনেছে। তৃণমূল-বিজেপি টানটান লড়াইয়ের আবহে বাংলার রাজনীতিতে প্রভাবে, প্রচারে অনেকটাই অপ্রাসঙ্গিক হওয়ার মুখে ৩৪ বছর নিরবিচ্ছিন্ন সরকার চালানো সিপিএম কিংবা জাতীয় দল কংগ্রেস। মাঝে মাঝেই বিধানসভায় বিরোধী দলনেতা আবদুল মান্নানের ঘরে বসে বাম পরিষদীয় নেতা সুজন চক্রবর্তী নানান রাজনৈতিক ব্যাপারে আলোচনা করেন এবং ‘তৃণমূল-বিজেপি দুইই এক’ এই তত্ত্ব আওড়ান বটে, কিন্তু তা যে স্লোগান হিসেবে এখনও বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষকে বিশেষ প্রভাবিত করেনি, তা বিভিন্ন নির্বাচনের ফল থেকেই স্পষ্ট। এই অবস্থায় প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি বদল, হঠাৎই বাংলার রাজনৈতিক পরিবেশে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। রাজনীতির কারবারিরা আলোচনা শুরু করেছেন, তবে কি অধীরকে অপসারিত করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সদর্থক বার্তা দিলেন দিল্লির কংগ্রেস নেতারা। বিশেষ করে যেখানে গত দু’বছরে বাংলার কংগ্রেস নেতাদের তীব্র আক্রমণ করলেও, হাইকমান্ডের সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখেই চলেছেন তৃণমূল নেত্রী। সে প্রদীপ ভট্টাচার্য বা অভিষেক মনু সিংভির রাজ্যসভার প্রার্থীপদকে সমর্থন করাই হোক বা দিল্লিতে গেলেই সোনিয়া, রাহুলের সঙ্গে দেখা করা হোক। ২০১৬ পরবর্তী বাংলায় রাজ্যসভা নির্বাচনে দু’দুবার কংগ্রেস এবং বামেরা মিলে প্রার্থী দেওয়ার পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। অধীরের নেতৃত্বে রাজ্য কংগ্রেস সে ব্যাপারে অনেকটাই এগিয়ে গেলেও, দু’বারই তৃণমূল নেত্রী প্রদীপ ভট্টাচার্য এবং অভিষেক মনু সিংভিকে সমর্থন করে সিপিএমের সঙ্গে কংগ্রেসের সম্পর্কে কিছুটা হলেও জটিলতা তৈরি করতে পেরেছেন।
এরপরও রাজ্যে অধীরের নেতৃত্বে মমতা বিরোধী কয়েকজন কংগ্রেস নেতা সিপিএমের সঙ্গে ২০১৬ সালের জোটের পুনরাবৃত্তি ২০১৯ এ করতে বদ্ধপরিকর ছিলেন। সিপিএমের সঙ্গে জোট করে রাজ্যে তৃণমূল-বিজেপির বিরুদ্ধে লড়লে রাজ্যে কংগ্রেসের ফলাফল ২০১৪ সালের তুলনায় ভালো হবে বলে তাঁরা দিল্লিতে দরবারও শুরু করেছেন। অন্যদিকে, সিপিএমও কংগ্রেসের জন্য দরজা খুলেই রেখেছে একপ্রকার। অগাস্ট মাসেই আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে রাজ্য কমিটির বিশেষ মিটিং হয় আগামী লোকসভা ভোটে দলের কৌশলগত লাইন ঠিক করতে। সেখানে ২০১৬ সালের বিধানসভা ভোটের পূর্ববর্তী পরিস্থিতির মতোই দুই ২৪ পরগনা, কলকাতা, দার্জিলিং, নদীয়া, দুই মেদিনীপুর, হুগলিসহ বহু জেলার নেতাই কংগ্রেসের সঙ্গে জোটের পক্ষেই সওয়াল করেন। তাঁদের বক্তব্য, ২০১৬ সালে জোট হয়েছিল বলেই রাজ্যে বিজেপির ভোট কমানো গিয়েছিল। বিজেপির ভোট কমাতে গেলে এবারও জোট চাই, নয়তো রাজ্যে বিজেপিকে ঠেকানো যাবে না। কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করে রাজ্যে বিজেপির বাড়বাড়ন্ত আটকানোর নিদান যে সিপিএম নেতারা দিচ্ছেন, তাঁরা কিন্তু এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারছেন না, লাগাতার তাঁদের ভোট কেন বিজেপিতে চলে যাচ্ছে? আর এই জায়গাতেই সিপিএম-বিজেপিকে এক ব্যাকেটে ফেলে বিঁধছেন তৃণমূল নেত্রী।
আসলে কংগ্রেস হাইকমান্ডও বুঝতে পারছে, ২০১৯ সালে বিজেপির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে বড় শক্তি হতে চলেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। অভিষেক মনু সিংভি, আহমেদ প্যাটেল, গুলাম নবি আজাদসহ কংগ্রেসের বহু শীর্ষ নেতাই এই অবস্থায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে একটা ‘ওয়ার্কিং রিলেশন’ রেখেই চলতে চান। যাতে রাজ্যে সরাসরি তৃণমূল এর সঙ্গে আসন সমঝোতা না হলেও, রাজ্য নেতাদের কোনও আচরণে তৃণমূল নেত্রী যেন ক্ষুব্ধ না হন। এই অবস্থায় দীর্ঘদিন সক্রিয় রাজনীতি থেকে সরে থাকা আমহার্স্ট স্ট্রিটের সোমেন মিত্র লোকসভা ভোটের আগে কী ভূমিকা নেন সেদিকেই তাকিয়ে বাংলার রাজনৈতিক মহল। যে সোমেন মিত্র ২০০৮ সালের ২৪ শে অগাস্ট থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে সিঙ্গুরে দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ের ধারে বাঁশের মঞ্চে টানা দু’সপ্তাহ দিন-রাত কাটিয়েছেন, যিনি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছবি নিয়ে ২০০৯ সালের লোকসভা ভোটে ডায়মন্ডহারবার কেন্দ্রে প্রচার করে সাংসদ হয়েছেন, তাঁকে রাজ্য সভাপতি করে কী বার্তা কংগ্রেস হাইকমান্ড দিলো তা কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই স্পষ্ট হবে।

Comments are closed.