পঞ্চায়েত ভোটে গণতন্ত্রের অনুশীলন এবং সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের স্মৃতিশক্তি

এই লেখা মূলত স্মৃতিচারণা। তাও আবার ১৪ বছরের পুরনো ঘটনার।
দুনিয়ার যখন ঘাড় ঘুরিয়ে একদিন আগের ঘটনাতেও তাকানোর সময় নেই, তখন হঠাৎ এত বছরের পুরনো ঘটনার চর্চা করার দরকার কেন পড়ল, তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠাও সঙ্গত। কিন্তু এত বছরের পুরনো ঘটনা টেনে আনতে হচ্ছে একটাই কারণে। মানুষের স্মৃতিশক্তি দুর্বল, আর মুশকিল হচ্ছে রাজনৈতিক নেতাদের স্মৃতিশক্তি আরও দুর্বল। কিন্তু রাজনৈতিক লোকেদের স্মৃতিশক্তি দুর্বল হলেও সমাজের তাতে কিছু এসে যায় না, এসে যায় তখনই যখন, কেউ হঠাৎ করে কিছু কিছু কথা ভুলে যান। যাকে অনেক সময় আমরা বলি, ‘সিলেকটিভ মেমরি’।
এই লম্বা ভূমিকার কারণ, দীর্ঘদিনের সাংসদ, দেশের প্রাক্তন স্পিকার সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় আচমকাই পশ্চিমবঙ্গের গণতন্ত্র নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েছেন। দুদিন সাংবাদিক বৈঠক করেছেন এই অসুস্থ শরীরে। সোমনাথবাবু চিন্তিত, কারণ পঞ্চায়েত ভোটকে কেন্দ্র করে রাজ্যে গণতন্ত্র ‘আক্রান্ত’। তিনি বলেছেন, মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার খর্ব হচ্ছে। এই নির্বাচন বেআইনি।
সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের সাংবাদিক সম্মেলন দেখতে দেখতে মনে পড়ে যাচ্ছিল ২০০৪ সালের লোকসভা ভোটের কথা। কেন ২০০৪? কারণ, সেটাই সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের শেষ নির্বাচনে লড়াই। বোলপুর লোকসভা থেকে জিতে সাংসদ এবং প্রথম ইউপিএ সরকারের প্রথম স্পিকার সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়। ২০০৪ সালের লোকসভা ভোটে আরামবাগে সিপিএমের অনিল বসু কিংবা পশ্চিম মেদিনীপুরে দীপক সরকাররা কোন গণতন্ত্রের অনুশীলন করেছিলেন তা সেখানকার মানুষ এখনও মনে রেখেছেন। কিন্তু সেই ভোটের পর অনিল বসু, দীপক সরকাররা তো বিষ পান করে ভিলেন হয়েছেন, আর দক্ষিণ কলকাতার বাসিন্দা, ব্যারিস্টার সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় স্পিকার হয়েছেন।
এত বছর বাদে আমরা একটু খতিয়ে দেখব, সেই ২০০৪ সালে কেমন ভোট হয়েছিল বোলপুর লোকসভা আসনে। আমরা খতিয়ে দেখব, গোটা রাজ্যে সারা জীবনে (মানে ১৯৮০ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত দোর্দণ্ডপ্রতাপ বাম আমলে যত লোকসভা, বিধানসভা ভোট হয়েছে) বামেরা যেখানে গড়ে ৪৮-৪৯ , সর্বোচ্চ ৫১-৫২ শতাংশ ভোট পেত, সেখানে ২০০৪ সালে সোমনাথবাবু কোন ম্যাজিকে বোলপুরে ৬৫ শতাংশেরও বেশি ভোট পেয়েছিলেন! সেই বছর বোলপুর লোকসভায় মোট ভোট পড়েছিল ৭ লক্ষ ৭০ হাজার ৫৯টি। সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় পেয়েছিলেন ৫ লক্ষ ৪ হাজার, ৮৩৬ ভোট (৬৫.৫৫ শতাংশ)। তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থী নির্মল মাজি পেয়েছিলেন ১ লক্ষ ৯৪ হাজার ৫৩১ ভোট (২৫.২৬ শতাংশ)। জামানত জব্দ হয়েছিল কংগ্রেসের।
সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের এই ৬৫ শতাংশেরও বেশি ভোট পাওয়ার রহস্যভেদ করতে হলে আমাদের একবার চোখ রাখতে হবে সেই ভোটের বুথ ভিত্তিক রেজাল্টের দিকে।
ধরা যাক, বোলপুর লোকসভা কেন্দ্রের বোলপুর বিধানসভা আসন। সোমনাথবাবু এখানকার গণ্যমান্য ব্যক্তি। এই বিধানসভার ৪২ নম্বর বুথে তিনি পেলেন ৩৫৭ ভোট, নির্মল মাজি পেলেন ১৩ ভোট। ১১২ নম্বর বুথে সোমনাথবাবু ৪৮৪ ভোট, নির্মল মাজি ১৮ ভোট। ১৩৬ নম্বর বুথে সোমনাথবাবু ৬৩৯ ভোট, নির্মল মাজি ১৫ ভোট।
গণতন্ত্রের এমন মণিমুক্তো ছড়ানো নমুনা বোলপুর লোকসভার আরও অনেক বিধানসভাতেই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল ২০০৪ সালে। লাভপুর বিধানসভার ৫৪ নম্বর বুথে সিপিএম ২৯৩ ভোট, তৃণমূল ৬ ভোট। ৫৯ নম্বর বুথে সিপিএম ৭২৭ ভোট, তৃণমূল ৭ ভোট। ১২৮ নম্বর বুথে সিপিএম ৬৮১ ভোট, তৃণমূল ৫ ভোট।
দুবরাজপুর বিধানসভার ৬৬ নম্বর বুথে সিপিএম ৪৯২ ভোট, তৃণমূল ৬ ভোট। ১১৩ নম্বর বুথে সিপিএম ৪৬৭ ভোট, তৃণমূল ১২ ভোট। ১৩১ নম্বর বুথে সিপিএম ৪০৪ ভোট, তৃণমূল ৬ ভোট।
মঙ্গলকোট বিধানসভার ৪৮ নম্বর বুথে সোমনাথবাবু ৪৬২ ভোট, তৃণমূল ৮ ভোট। ৫২ নম্বর বুথে সোমনাথবাবু ৫৮১ ভোট, তৃণমূল ২ ভোট। ৬৬ নম্বর বুথে সোমনাথবাবু ৭০০ ভোট, তৃণমূল ৫ ভোট। ১০৯ নম্বর বুথে সোমনাথবাবু ৮৩৩ ভোট, তৃণমূল ৭ ভোট।
নানুর বিধানসভার ১৩৫ নম্বর বুথে সিপিএম ১২১৭ ভোট, তৃণমূল ৫ ভোট। একমাত্র নানুর বিধানসভাতেই কিছু বুথে সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় তৃণমূলের থেকে কম ভোট পেয়েছিলেন। তাও কয়েক বছর আগের নানুরে সূচপুরে গণহত্যা এবং তার পরবর্তী পরিস্থিতিতে কিছু এলাকায় চূড়ান্ত মেরুকরণ হওয়ার জন্য।
২০০৪ সালের লোকসভা ভোটে বোলপুর কেন্দ্রের আরও বহু বুথের হিসেব দেওয়া যায়, যা হঠাৎ মনে পড়ে গেলে সোমনাথবাবু হয়তো বুঝতে পারবেন, কোন আইনি গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে লড়াই জিতে তিনি সাংসদ হয়েছিলেন এবং স্পিকার হয়েছিলেন!
কিন্তু তাঁর স্মৃতিশক্তি দুর্বল। অত পুরনো কথা তাঁর মনে নেই। ১৪ বছর তো কম সময় নয়। রামচন্দ্রই বনবাস থেকে ফিরে কত কী ভুলে গেছিলেন! তাছাড়া ‘সিলেকটিভ মেমরি’রও একটা ব্যাপার আছে। সব কথা মনে রাখার দরকারই কী?

Leave A Reply

Your email address will not be published.