একদিন খবর এল ছোট আঙারিয়ার একটি বাড়িতে ১০ কেজির বেশি মাংস কেনা হয়েছে, তাতেই প্রথম সন্দেহ জাগে।

আগেই বলেছি, ২০০০ সালের ২৫ জুন সন্ত্রাসমুক্ত হয়েছিল গড়বেতা। এরপর ওই বছরেরই অক্টোবর মাসের ২৮ তারিখ, গড়বেতা থানা এলাকার লাগোয়া কেশপুরের মানুষ সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে সেখানকার আমনপুর, খেতুয়া এলাকাগুলি সন্ত্রাসমুক্ত করে। তার দু’তিন দিনের মধ্যে নেড়াদেউলসহ কেশপুরের বিস্তীর্ণ এলাকার মানুষের প্রতিরোধের সামনে দুষ্কৃতী বাহিনী পিছু হঠে। এরপরেও তৃণমূলের পক্ষ থেকে তাদের আধিপত্য পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে কেশপুরে কেন্দ্রীয় একটি জমায়েতের ডাক দেওয়া হয়েছিল।
কিন্তু তখনও অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার পিংলা থেকে দাঁতন, মোহনপুর হয়ে পটাশপুর, খেজুরি-এই সব এলাকা সন্ত্রাস কবলিত ছিল। পিংলার এক তৃণমূল নেতাকে সে সময় ‘এযুগের মাস্টারদা’ আখ্যা দেওয়া হয়েছিল। এই সন্ত্রাস সৃষ্টির যারা কারিগর তাদের ক্ষুদিরাম, প্রফুল্ল চাকির সঙ্গে তুলনা করতেও অনেকের কোনও দ্বিধা হয়নি। যাঁরা এসব কথা বলে পরোক্ষে ক্ষুদিরাম, সূর্য সেন, প্রফুল্ল চাকিদের অশ্রদ্ধার জায়গায় পৌঁছে দিয়েছিলেন, তাতে মেদিনীপুরের সচেতন মানুষের মাথা নীচু হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু মানুষের সম্মিলীত প্রতিরোধই শেষ কথা বলে। সে সময় বিশেষ করে, গড়বেতার একেবারে লাগোয়া হুগলি ও বাঁকুড়া জেলার বিভিন্ন অংশ সন্ত্রাস কবলিত ছিল। হুগলির গোঘাট, খানাকুল, আরামবাগ, পুরশুড়া-এই চারটি থানা এলাকা এবং বাঁকুড়ার  জয়রামবাটি, কোতলপুর, বিষ্ণুপুরেও, গড়বেতা-কেশপুরের মতো ভয়ঙ্কর সন্ত্রাস সৃষ্টি করেছিল বিরোধীরা। তৎকালীন হুগলি জেলার নেতা এবং দলের রাজ্য কমিটির সদস্য অনিল বসুর নেতৃত্বে কমরেড অভয় ঘোষ, বিনয় দত্ত, মুজাম্মেল হোসেন প্রমুখ এবং বাঁকুড়ায় কমরেড অমিয় পাত্র, ষড়াণন পাণ্ডেসহ অন্য নেতাদের নেতৃত্বে সন্ত্রাস কবলিত এলাকার মানুষ ঘুরে দাঁড়ান। মানুষকে সংগঠিত করে প্রতিরোধ সংগ্রাম গড়ে তোলার ক্ষেত্রে এই সকল নেতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। মেদিনীপুরের তৎকালীন জেলা সম্পাদক কমরেড দীপক সরকারসহ সন্ত্রাস কবলিত এলাকার সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্যরা সকলেই এই কাজে যুক্ত হন। এই প্রতিরোধ সংগ্রামের কাজে তিন জেলার মধ্যে সমন্বয় সাধনের জন্য একটি কমিটিও গঠন করা হয়েছিল। এই সমন্বয় কমিটির সভা থেকে পারস্পরিক আলোচনার মাধ্যমে যাতে তিন জেলায় একইভাবে প্রতিরোধের সংগ্রাম পরিচালিত হয়, সেই পদক্ষেপ নেওয়া হয়। এই পথেই হুগলি, বাঁকুড়া এবং মেদিনীপুরের প্রায় সমস্ত এলাকাই ২০০০ সালের মধ্যে সন্ত্রাসমুক্ত হয়।
প্রথম অবস্থায় নেতৃত্বের একটি বড় অংশের মধ্যে সন্ত্রাসের গভীরতা অনুধাবনের ক্ষেত্রে চিন্তা-ভাবনার প্রভেদ ছিল। পুলিশের ভূমিকাও যে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পরোক্ষ, কোথাও-কোথাও প্রত্যক্ষভাবে বিরোধীদের সাহায্য করেছিল, আলোচনার মাধ্যমে তাও বেরিয়ে আসে। জেলায় অবস্থানকারী পার্টির রাজ্য কমিটির সদস্যদের মারফত রাজ্য নেতৃত্বকে তা অবগতও করানো হয়। তৎকালীন মেদিনীপুরের ক্ষেত্রে এমন পরিস্থিতি তৈরি হয় যে, জেলা কমিটির পক্ষ থেকে দলের শীর্ষ নেতৃত্বের কাছেও দরবার করতে হয়। আমাদের এই পদক্ষেপ রাজ্যের তৎকালীন পুলিশমন্ত্রী ভালোভাবে গ্রহণ করতে পেরেছিলেন বলে মনে হয় না। একথা কেন লিখলাম, তা এর আগের অংশে উল্লেখ করেছি। ফলে আশা করি, পাঠকদের বুঝে নিতে অসুবিধা হবে না আমি কী বলতে চেয়েছি।
সে সময়, জেলা পার্টির সংগঠন যাঁরা পরিচালনা করেন তাঁদের বক্তব্যের চেয়েও জেলার সর্বোচ্চ পুলিশ আধিকারিকদের বক্তব্যকেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। যা অতীতে ছিল না। এবং এই ধারা পরবর্তী ক্ষেত্রে পুলিশ-প্রশাসন পরিচালনার ক্ষেত্রে প্রতি পদে প্রত্যক্ষ করতে কোনও অসুবিধা হয়নি। আমার লেখার পরবর্তী অংশে সে সব কথা আসবে। এক্ষেত্রে আবারও উল্লেখ করতে চাই, আমার দেখা ঘটনা ও তার থেকে লব্ধ অভিজ্ঞতায় যা বুঝেছি, সে কথাই লেখায় উল্লেখ থাকবে। এখানে সত্যের কোনও অপলাপ হবে না। তাতে কেউ খুশি হতে পারেন, কেউ এই লেখা নিয়ে সমালোচনা করতে পারেন। এই লেখাকে অন্য কোনও উদ্দেশ্য নিয়ে বলে বিশ্লেষণও করতে পারেন, তাতে আমার কিছু করার নেই।
এর মধ্যেই ২০০১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের দামামা বেজে ওঠে। বিধানসভার ফাইনালের আগে ২০০০ সালের কলকাতা কর্পোরেশনের নির্বাচনকে সেমি-ফাইনাল আখ্যা দেওয়া হয়। ছোট লালবাড়ি (কলকাতা কর্পোরেশনের সদর দফতর) দখলের পরে বড় লালবাড়ি (মহাকরণ) দখল হবে, এরূপ আত্মপ্রত্যয় আকাশে-বাতাসে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ২০০০ সালে সন্ত্রাসমুক্তির সাথে সাথে সেই ঘোষণাও ম্রিয়মাণ হয়ে পড়ে। সন্ত্রাসের কারণে যে বামপন্থীদের আত্মবিশ্বাসের চিড় ধরেছিল তা থেকে বেরিয়ে বাম কর্মীরা নতুন আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান হন। বামপন্থীদের ডাকা কর্মসূচিগুলিতে তার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। কিন্তু এর পরেও বাম বিরোধীরা চুপ করে বসে থাকেননি। ২০০১ সালের একেবারে গোড়াতেই তৃণমূল কংগ্রেস ও বিজেপির যৌথ পরিকল্পনায় ও তৎকালীণ জনযুদ্ধের (মাওবাদীদের একটি গোষ্ঠী) সহযোগিতায় গড়বেতার মাটি পুনর্দখল করার জন্য চূড়ান্ত পরিকল্পনার রূপরেখা তৈরি হয়। এবার সেই ঘটনাতেই আসব।

এই ঘটনা ছোট আঙারিয়া’র ঘটনা নামে বহুল চর্চিত। কিন্তু ছোট আঙারিয়ার সিবিআই মামলা আদালতের বিচারাধীন। তাই সব কথা বলা বা লেখা সম্ভবপর নয়। কিন্তু সাধারণভাবে যে কথা বলার ক্ষেত্রে আইনগতভাবে কোনও অসুবিধা থাকার কথা নয়, সেই সব কিছু কথা যা এই লেখার মধ্যে উল্লেখ না করলে বামপন্থার আন্দোলনের ইতিহাসে অসম্পূর্ণতা থেকে যাবে, তা উল্লেখ করছি। ছোট আঙারিয়া, গড়বেতা সীমানা লাগোয়া বাঁকুড়া জেলার প্রত্যন্ত একটি সংখ্যালঘু অধ্যুষিত ছোট গ্রাম। গড়বেতা সন্ত্রাসমুক্ত হওয়ার পরেই হুগলি-বাঁকুড়ার প্রত্যন্ত সীমানাবর্তী গ্রামগুলোতে যাতে বিরোধীরা নতুন করে সন্ত্রাস ছড়াতে না পারে, তার জন্য আমাদের পার্টির তরফে নজরদারির পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। অচেনা কোনও মানুষ গ্রামে জমায়েত করছে কিনা, আসলে তাঁরা কোন উদ্দেশ্য নিয়ে গ্রামে আসছে, তা বোঝার চেষ্টা করা, এবিষয়ে নিয়মিত পার্টি-কেন্দ্রের সঙ্গে খবর আদান-প্রদান করার একটা মেকানিজম বা রূপরেখা তৈরি হয়। এর সঙ্গে এলাকার মা-বোনেদের যুক্ত করা হয়। বিশেষ করে জেলার সীমানা লাগোয়া হাট ও বাজারগুলিতে এই নজরদারির সক্রিয়তা অনেকটাই বেশি ছিল।
একদিন খবর আসে, ছোট আঙারিয়ার একটি বাড়িতে, পরিবারের সদস্যদের জন্য প্রায় ১০ কেজির বেশি মাংস কেনা হয়েছে। যখন মাংস কিনতে আসা ওই বাড়ির এক সদস্যকে জিজ্ঞাসা করা হয়, বাড়িতে কোনও অনুষ্ঠান আছে কিনা, এত মাংস কী হবে, তখন কোনও সদুত্তর মেলেনি। খবরটা পার্টির কেন্দ্রে আসে। পাশের গ্রামের আত্মীয়তার সুবাদে ওই গ্রামে যাতায়াত আছে এমন এক মহিলা কর্মীকে এই বিষয়ে খবর নেওয়ার জন্য বলা হয়। বিকালবেলা সেই মহিলা কর্মী মারফত খবর আসে, ওই বাড়িটিতে সদস্য সংখ্যা চার-পাঁচ জন। অথচ অনেক বেশি পরিমাণে ভাত, মাংস রান্না করা হচ্ছে। পাশের বাড়ির লোকজনও এবিষয়ে আলোকপাত করতে পারেনি। এলাকার স্থানীয় পার্টি নেতৃত্বের মধ্যে সন্দেহ দানা বাঁধে, এর মধ্যে নিশ্চই কোনও রহস্য আছে। যার ফলে ওই পরিবারের উপর নজরদারির বাড়ানোর পরিকল্পনা করেন এলাকার পার্টি নেতৃত্ব। সন্ধ্যের অন্ধকার নামার পর ওই বাড়ি থেকে বহিরাগত ৩-৪ জনকে বের হয়ে পাশের খালের দিকে যেতে দেখা যায়। কিছুক্ষণ পর আবার অন্ধকারের মধ্যে তারা ওই বাড়িতেই ফিরে আসে। তারা ফিরে আসার পর একইভাবে আরও কয়েকজনকে বেরিয়ে ওই খালের দিকে যেতে দেখা যায়। তারাও অনুরূপভাবে কিছুক্ষণ পর ফিরে আসে। এতে নজরদারি করা কর্মীদের মধ্যে দৃঢ় ধারণা হয়, ওই বাড়িতে বেশ কিছু লোক আত্মগোপণ করে আছে এবং সেই কারণেই এত রান্নার আয়োজন। সুতরাং সন্দেহ একেবারে অমূলক ছিল না। তা আর বুঝতে বাকি রইল না।
তারপর ৪ জানুয়ারি ২০০১ এর ঘটনা ‘ছোট আঙারিয়ার’ ঘটনা বলে সংবাদমাধ্যমে বহুল প্রচারিত। এই নিয়ে বহু চর্চাও আছে। বিষয়টি আদালতের বিচারাধীন হওয়ায় আর লেখা বোধ করি সমীচিন হবে না।
গড়বেতার ঘটনা প্রসঙ্গে আমি পাঠকদের কাছে নিজের একটি মত বলিষ্ঠভাবে তুলে ধরতে চাই। এখনও যখন দেখি, কিছু বুদ্ধিজীবী হিসাবে নিজেদের জাহির করা মানুষ, ছোট আঙআরিয়ার ঘটনা নিয়ে বলতে গিয়ে গড়বেতার দুই সিপিএম নেতা তপন ঘোষ ও সুকুর আলিকে এখনও বিষোদগার করেন। ঘটনার এত বছর পরেও যেভাবে তাঁরা সেই ঘটনাকে ব্যাখ্যা করেন, সেই সমলোচকদের প্রতি যদি একটি বাক্য ব্যবহার করতে পারতাম তাহলে যথার্থভাবেই বলতাম, ‘হে ঈশ্বর এরা কী বলছে, তা এরা নিজেরাও জানে না। এদের ক্ষমা করো।’ কিন্তু আমি তো ঈশ্বরবাদে বিশ্বাসী নই, তাই বলতে হয় দীর্ঘদিন কারাবাসে থাকার পর এই দু’জনসহ মোট সাত জন (বাকিরা হলেন-বাবল শেখ সরদার, সালামাত শেখ, শিরাজুল খাঁ, বিলায়েত মল্লিক ও মজিবুর মল্লিক) ২০০৯ সালের বিচার শেষে বেকসুর খালাস পায়। সিবিআই এই মামলা নিয়ে কম তৎপরতা দেখায়নি। প্রথমে এই মামলা রাজ্য ছেড়ে অন্য রাজ্যে স্থানান্তরের জন্য সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত আইনি লড়াইকে টেনে নিয়ে যাওয়া হয়। সুপ্রিম কোর্টে সিবিআই-এর করা সেই আপিল বাতিল হয়ে যায়। মেদিনীপুর আদালতেই এর বিচার ধার্য হয়। আদালতে মামলা চলাকালীন সিবিআই তপন-সুকুরসহ অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কোনও প্রমাণই দাখিল করতে পারেনি। পরোক্ষভাবে সংবাদমাধ্যমকে ব্যবহার করে সিপিএমকে কলুষিত করার চেষ্টা করা হয়েছিল। তপন-সুকুররা বেকসুর খালাস পাওয়ার পর, আজ অনেক বছর অতিক্রান্ত। ওই আদালতের রায় যে সঠিক না, এই মর্মে সেই রায়ের বিরুদ্ধে কেউই উচ্চ আদালতে যাননি। অথচ এত বছর পরেও বাম বিরোধী তথাকথিত বুদ্ধিজীবী আলোচকরা যখনই সংবাদমাধ্যমে আলোচনায় গড়বেতা বা মেদিনীপুর সিপিএম প্রসঙ্গ ওঠে, শুরুতেই তাঁরা এই দুই নেতার নাম ধরে (সঙ্গে আমার নামও কখনও-কখনও যুক্ত হয়) যে ভাষা ব্যবহার করেন, তখন শুনে অবাক হয়ে যাই। তখন মনে হয় তপন ঘোষ একজন উচ্চ-মাধ্যমিক স্তরের স্কুলের বিজ্ঞান শিক্ষক। তাঁর পরিবারের উপর এত আক্রমণের পরেও তাঁর দুই ছেলে আজ চিকিৎসক। সুকুর আলি গড়বেতাবাসীর কাছে একজন সজ্জন মানুষ বলে পরিচিত। তাঁর ছেলে শিক্ষক। গোটা গড়বেতা, মেদিনীপুরের বামপন্থী লড়াই সংগ্রামের মানুষের কাছে এরা অত্যন্ত আপন লোক বলেই পরিচিত।
এরপরেও গড়বেতার মাটিতে বেশ কিছু সিপিএম নেতা-কর্মীর খুনের ঘটনা ঘটে। ২০০১ সালের ২৩ জানুয়ারি খুন হন সিপিএম কর্মী রমজান মল্লিক। ওই বছরেরই ৮ এপ্রিল খুন করা হয় গড়বেতা শহর লাগোয়া কাষ্ঠোগড়া এলাকার পার্টির শাখা সম্পাদক তপন ঘোষকে। জনযুদ্ধকে ব্যবহার করে গড়বেতার পাশাপাশি ২০০১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের আগে সন্ত্রাস সৃষ্টি করে ফায়দা তোলার জন্য মেদিনীপুর-বাঁকুড়া-হুগলি জেলায় বহু বাম নেতা-কর্মীকে খুন করা হয়। যার মধ্যে ২০০১ এর ১০ এপ্রিল বাঁকুড়ার সারেঙ্গার কাডোয়া গ্রামে পার্টির নির্বাচনী সভায় যাওয়ার সময় খুন হন সারেঙ্গা পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি শিবরাম সৎপতি। বিধানসভা ভোটের পরও অব্যাহত থাকে খুনের রাজনীতি। ওই বছরেরই ১ নভেম্বর মেদিনীপুরের গোপীবল্লভপুরে সিপিআইএমের অমরদা আঞ্চলিক কমিটির সম্পাদক শশাঙ্ক নাগ খুন হন। তাঁকে হাতিবাড়ির রাস্তার উপর ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে খুন করা হয়েছিল। ২০০১ সালের ২৮ নভেম্বর  ঝাড়গ্রাম মহকুমার বেলপাহাড়িতে জনযুদ্ধ গোষ্ঠী এবং এমসিসির লোকেরা খুন করে বেলপাহাড়ি লোকাল কমিটির সম্পাদক সুধীর সিংহ সরদারকে। ১৯৯৮ সাল থেকে ২০০১ পর্যন্ত যাঁরা খুন হন তাঁদের একজনও কালোবাজারি, জোতদার-জমিদার, অসাধু ব্যবসায়ী ছিলেন না। ছিলেন গরিব ক্ষেতমজুর পরিবারের সাধারণ কৃষক, শিক্ষক।
তিনটি জেলাকে নিয়ে বিরোধীরা যে পরিকল্পনা তৈরি করেছিল তা ব্যর্থ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নির্বাচনী সংগ্রামে সারা রাজ্যেই সিপিএম কর্মীদের নতুন মাত্রা সংযোজন করে, যা আমি উপলব্ধি করতে পেরেছিলাম নির্বাচনের কয়েক মাস আগে থেকেই। পার্টির নির্বাচনী কাজে সভা-সমাবেশে আমার মতো একজন সাধারণ কর্মীর যোগদানের যে সুযোগ ঘটেছিল তা এক কথায় অপ্রত্যাশিত। কাকদ্বীপ থেকে কোচবিহার, পুরুলিয়া থেকে কলকাতাসহ সব জেলাতেই পার্টির প্রচুর কর্মসূচিতে আমাকে অংশ নিতে হয়েছিল। এক-এক দিন সকাল থেকে বিকাল, রাত্রি পর্যন্ত চার-পাঁচটি করে সভাতেও আমাকে অংশগ্রহণ করতে হয়। এক কথায় পার্টির প্রচার সভাতে অংশগ্রহণ করাই আমার মুখ্য কাজ হয়ে দাঁড়ায় সে সময়। নির্বাচন পর্যন্ত প্রশাসনিক কাজসহ অন্য কাজ করার আর কোনও সুযোগ ছিল না। এমনকী আমার নির্বাচনী বিধানসভা এলাকাতেও ভোটের আগে মাত্র দু’দিন উপস্থিত থাকার সুযোগ পাই। রাজ্যব্যাপী এই সভা সমাবেশের মধ্যে দিয়ে, মানুষ যে পার্টিকে লড়াইয়ের ময়দানেই আশা করে, আমার মতো সাধারণ কর্মীর তা বুঝতে কোনও অসুবিধা হয়নি।
এর মধ্যেই উল্লেখযোগ্য দু’টি ঘটনা, যা লেখার মধ্যে সংযোজিত হওয়া একান্তভাবে প্রয়োজন। তা হল-শারীরিক কারণে কমরেড কমরেড জ্যোতি বসু পার্টির কাছে মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি চান। সেই আবেদনের ভিত্তিতে পার্টির মধ্যে আলোচনার পর জ্যোতিবাবু অবসর নেন। উনি অবসর নেওয়ার পর, ২০০০ সালের ৬ নভেম্বর বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। নিয়ম অনুযায়ী, মুখ্যমন্ত্রী সরকারিভাবে দায়িত্ব গ্রহণ করলে, তাঁর শপথের সময় মন্ত্রিসভার অন্য সদস্যদেরও নতুন করে শপথ নিতে হয়। ৬ নভেম্বর ২০০০, রাজভবনের হল ঘরে সব মন্ত্রী একসঙ্গে শপথবাক্য পাঠ করি। অতীতে মন্ত্রিসভার সদস্য হিসাবে পৃথকভাবে রাজ্যপালের সামনে শপথ বাক্য পাঠ করতে হত। কিন্তু এবার তা হয়নি। একসাথে সকলের সঙ্গে শপথবাক্য পাঠ আমার কাছে অভিনব লেগেছিল। মন্ত্রিসভার সদস্য হিসাবে সমস্ত মন্ত্রীর দফতর একই থাকে। যেহেতু সামনেই বিধানসভা নির্বাচন ছিল, তাই সেই সময় মন্ত্রিসভায় রদবদল ঠিক হবে না, এই ভাবনা থেকেই সব মন্ত্রী নিজের পদে থেকে যান।
সরকারের অভ্যন্তরে এই ঘটনার পাশাপাশি, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাও ঘটে ২০০১ এর একেবারে গোড়ার দিকে। সে সময় আত্মপ্রকাশ করে নতুন একটি রাজনৈতিক দল পিডিএস। সিপিএম নেতা ও সাংসদ সৈফুদ্দিন চৌধুরির নেতৃত্বে দক্ষিণ ২৪ পরগণার সেই সময়কার জেলা সম্পাদক সমীর পুততুণ্ডসহ বিভিন্ন জেলার নেতৃত্ব স্থানীয় কয়েকজন সিপিএম ছেড়ে বেরিয়ে এসে এই নতুন দল তৈরি করেন। যদিও চর্চায় এসেছিল, প্রয়াত কমরেড সুভাষ চক্রবর্তীর সম্পূর্ণ পরিকল্পনা ও সহযোগিতায় পিডিএস-এর জন্ম হয়। এই দল গঠনের পর তাঁর এই দলে যোগদানের সিদ্ধান্তও নাকি পাকা ছিল।
এই সব আমি উল্লেখ করলাম এই কারণেই যে, এই নতুন দল আত্মপ্রকাশের কয়েকদিন পরেই হঠাৎ সুভাষদা (প্রয়াত সুভাষ চক্রবর্তী) মহাকরণে আমাকে ফোন করে তাঁর ঘরে ডাকলেন। বললেন, ‘জরুরি কথা আছে তুমি একবার এসো।’ আমি কিছুক্ষণ পরেই সুভাষদার ঘরে হাজির হলাম। ঘরে যে অ্যান্টি চেম্বার ছিল, উনি আমাকে নিয়ে সেখানে ঢুকলেন। অ্যান্টি চেম্বারে ঢোকার সময় তাঁর আপ্ত সহায়ক কমরেড নিখিলকে ডেকে বললেন, ‘আমি না বলা পর্যন্ত, কাউকে আমার চেম্বারে আসা পারমিশন দেবে না, আমি সুশান্তর সঙ্গে কিছু গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় ব্যস্ত থাকব’।

(চলবে)

Leave A Reply

Your email address will not be published.