নাচনি থেকে ‘ওটি টেকনিশিয়ান’, জীবনের পথে উত্তরণ রূপান্তরকামী জিয়ার

দেশের মধ্যে প্রথম রূপান্তরকামী বা ট্রান্সজেন্ডার অপারেশন থিয়েটার টেকনিশিয়ান জিয়া। এই মুহুর্তে কলকাতার মেডিকা সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালে কর্মরত রয়েছেন তিনি। তবে জিয়ার এই উঠে আসাটা কিন্তু একবারেই সহজ ছিল না। ছোটবেলা থেকেই সে ছিল পরিবার পরিজন থেকে শুরু করে পাড়া-প্রতিবেশী, সকলের কাছেই উপহাসের পাত্র। ছোট্ট ছেলেটির মধ্যে মেয়েলি সত্তা ছিল অনেক বেশি। তাই সমবয়সী ছেলেরা যখন কাদামাঠে ফুটবল নিয়ে দাপিয়ে বেড়াত বা গুলি, ডাংগুলি খেলে বেড়াত, সে তখন ঘরের এক কোণে পুতুল বা রান্নাবাটি খেলায় ব্যস্ত থাকত। বাড়ির বড়রা পরিবারের ছোট্ট ছেলেটির এই পরিণতি মেনে নিতে পারেননি।
মালদহ জেলার বাসিন্দা জিয়া বলে চলেন সেই ভয়াবহ জীবনের কাহিনী। পারিবারিক চাপেই নাচনি জীবন বেছে নিতে বাধ্য হয়েছিলন তিনি। সেই সময় পরিবারে এই ধরনের সন্তানদের সাধারণত বিহারে বিভিন্ন বিয়ের বাড়িতে নাচ-গান করে মনোরঞ্জন করার জন্য পাঠিয়ে দেওয়া হত। মূলত ‘লগন নাচ’ বলেই পরিচিত ছিল এই মনোরঞ্জন। প্রচুর টাকা পাওয়া যেত। শারীরিক সম্পর্কে বাধ্য করা হত এই নাচনিদের। বন্দুকের নলের সামনেও তাদের নাচতে বাধ্য করা হত। ‘কিন্তু এই অসম্মানের জীবন আর সহ্য হচ্ছিল না। যে করেই হোক পালাতে হবে এমনটাই মনে হত’, বলে চলেন জিয়া।

বাড়ি থেকে পালিয়ে চলে আসেন কলকাতায়। এরপর নিজের অসম্পূর্ণ লেখাপড়া শেষ করেন তিনি। পরিচয় হয় ‘প্রান্তকথা’ নামে এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কর্ণধার বাপ্পাদিত্য মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে। বাপ্পাদিত্যবাবু জানালেন, জিয়ার জীবনে কিছু করে দেখানোর আগ্রহ তাঁদের মুগ্ধ করেছিল। তাই স্নাতক স্তরের পড়া সম্পূর্ণ হওয়ার পর বিভিন্ন সমমনোভাবাপন্ন সংগঠনের সহযোগিতায় তাঁর জন্য পাঁশকুড়ায় প্যারা মেডিক্যাল প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। জিয়ার মত ট্রান্সজেন্ডারদের নিয়ে কাজ করে ‘সাতরঙ্গী’ নামে একটি সংস্থা। সেই সংস্থার পক্ষে কৌশিক হোড় জানালেন, জিয়ার মত রূপান্তরকামীদের যাতে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয় তাই তাঁরাই মেডিকা সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালে তাঁর প্রশিক্ষণের জন্য আবেদন করেন। সফলভাবে সেই পর্ব শেষ করে আপাতত সেখানেই কর্মরত জিয়া।
মেডিকা সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালের চেয়ারম্যান ডঃ অলোক রায় জানালেন, জন্ম পরিচয় নিয়ে কেউ পৃথিবীতে আসে না। তাই জিয়ার মতো রূপান্তরকামী যাঁরা রয়েছেন, তাঁদের পাশে থাকার প্রচেষ্টা সব সময় তাঁরা জারি রাখবেন। পূর্ব ভারতে তো বটেই, সারা দেশে স্বাস্থ্য পরিষেবায় এই প্রথম কোনও ট্রান্সজেন্ডারকে নিয়োগ করা হয়েছে। তবে এই প্রশিক্ষণ পর্ব ছিল যথেষ্টই কঠিন। মোট ১০ টি অপারেশন থিয়েটার নিয়ে একটি ওটি কমপ্লেক্স আছে এই বেসরকারি হাসপাতালটিতে। প্রশিক্ষণ পর্বে তার প্রতিটি ধাপ পেরোতে হয়েছে জিয়াকে। চিকিৎসক থেকে শুরু করে সকলেই বাড়িয়ে দিয়েছেন সহযোগিতার হাত। আপাতত নিজের পায়ের তলায় মাটি খুঁজে পাওয়ার পর জিয়া নিজের জেলা মালদহতে গড়ে তুলেছেন গৌড় বাংলা সংহতি সমিতি। নাচনি জীবনের অন্ধকার থেকে আলোয় ফেরার দিশা দেখাচ্ছেন আরও অনেককে।

Leave A Reply

Your email address will not be published.