কলকাতার জোড়াসাঁকো থানার কেসে ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ মাওবাদী নেতা বাসব রাজুকেই শেষ পর্যন্ত সংগঠন মাথায় বসালো সিপিআই (মাওয়িস্ট)। দলের সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে অসুস্থতার কারণে গণপতি সরে যাওয়ার পর যিনি এই দায়িত্বে এলেন, সেই গগন্না, ওরফে প্রকাশ, ওরফে কৃষ্ণা, ওরফে নামবালা কেশব রাও, ওরফে বাসব রাজুকে নিয়ে আরও চিন্তা বাড়ল দেশের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর। মাওবাদী মিলিটারি কমিশনের মাথা এবং তাদের টেকনিকাল টিমের অন্যতম প্রধান ৬৩ বছর বয়সী বাসব রাজু দায়িত্ব নেওয়ার পর সংগঠনের আরও ভয়ঙ্কর চেহারা নিতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন গোয়েন্দা সংস্থার অনেকেই।
কে এই বাসব রাজু?
১৯৫৫ সালের ১০ ই জুলাই অবিভক্ত অন্ধ্র প্রদেশের শ্রীকাকুলামে জন্ম বাসব রাজুর। ওয়ারাঙ্গাল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ (বর্তমানে ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজি) থেকে বি’টেক পাশ করেন তিনি। রাজ্যস্তরের ভলিবল খেলোয়াড় ছিলেন বাসব রাজু। ছাত্রাবস্থা থেকে ছিল বাম রাজনীতিতে আগ্রহ। ১৯৮০ সালে এবিভিপি সদস্যদের সঙ্গে গণ্ডগোলে জড়িয়ে একবার জেলও খাটেন। তবে ওই একবারই।
জোড়াসাঁকো থানা কেস নম্বর ১৩৮/২০১২
২০১২ সালের ২৯ শে ফেব্রুয়ারি কলকাতা পুলিশের স্পেশাল টাস্ক ফোর্স (এসটিএফ) সাডানালা রামকৃষ্ণ, দীপক কুমার, সুকুমার মন্ডল, শম্ভুচরণ পাল এবং বাপি মুদি নামে পাঁচ মাওবাদীকে গ্রেফতার করে। এঁদের মধ্যে সাডানালা রামকৃষ্ণ ছিলেন মাওবাদীদের সেন্ট্রাল টেকনিকাল কমিটির প্রধান। কলকাতা পুলিশের এসটিএফ তাঁদের গ্রেফতার করার পর মাওবাদীদের কার্যকলাপ এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা জানতে পেরে চমকে উঠেছিলেন বিভিন্ন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার আধিকারিকরা। কারণ, সেন্ট্রাল মিলিটারি কমিশনের প্রধান বাসব রাজুর নির্দেশ ও পরিকল্পনায় মারাত্মক অস্ত্র-শস্ত্র তৈরির প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন সাডানালা রামকৃষ্ণ এবং তাঁর সঙ্গীরা। কলকাতা শহরতলিতে তাঁরা তৈরি করে ফেলেছিলেন রকেট লঞ্চার, গ্রেনেডসহ ভয়ঙ্ক অস্ত্র তৈরির কারখানা। মামলার গুরুত্ব বুঝে ঠিক এক মাস বাদে ২৯ শে মার্চ ২০১২ কেন্দ্রীয় সরকার এই মামলার তদন্তভার ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সির (এনআইএ) হাতে তুলে নেয়। কলকাতায় এসে এপ্রিলের গোড়ায় এই কেস নেয় এনআইএ।
কলকাতা পুলিশ এবং এনআইএ’র তদন্তে উঠে আসে বিস্ফোরক সব তথ্য। গোয়েন্দারা জানতে পারেন, কলকাতা এবং মুম্বই থেকে অস্ত্র, অস্ত্র তৈরির সরঞ্জাম বিভিন্ন পরিবহণ সংস্থার ট্রাকে পাচার হচ্ছিল ছত্তিশগড়ের রায়পুরে। ধৃতদের জেরা করে জানা যায়, অস্ত্র তৈরি, তা এক জায়গা থেকে অন্যত্র নিয়ে যাওয়া এমনকী গ্রেনেড, রকেট লঞ্চারের মতো অস্ত্র তৈরিতে সিদ্ধহস্থ বাসব রাজু। তিনিই পুরো কর্মকাণ্ডের দায়িত্বে ছিলেন। জোড়াসাঁকো থানার এই মামলায় বাসব রাজুকে ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ আখ্যা দিয়ে এনআইএ তাঁকে ধরে দেওয়ার জন্য ১০ লক্ষ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে। তবে দেশের একাধিক মাও অধ্যুষিত রাজ্য এবং কেন্দ্রের সব এজেন্সির ঘোষণা যুক্ত করলে এখন বাসব রাজুকে ধরে দেওয়ার মূল্য প্রায় ৩ কোটি টাকা।
মাওবাদী সংগঠনের কঠিন সময়ে এই বাসব রাজুর কাঁধেই সংগঠনের দায়িত্ব তুলে দিল দল। ছত্তিশগড় ও অন্ধ্র-ওড়িশা সীমানা এলাকায় মূলত তাঁর জন্য ফের সক্রিয় হয় মাওবাদী কার্যকলাপ।
সংগঠনে সাধারণ সম্পাদকের ঠিক পরেই তাঁর স্থান হলেও, গণপতির ভগ্নস্বাস্থ্যের কারণে বেশ কিছুদিন ধরে বাসব রাজুই দলের শীর্ষপদ সামলাচ্ছিলেন। তবে ১০ নভেম্বর থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে শীর্ষপদে এলেন তিনি। মাওবাদী সেন্ট্রাল মিলিটারি কমিশনের কমান্ডার-ইন-চিফ ছিলেন বাসব রাজু। গত প্রায় এক দশকে দেশের যাবতীয় মাওবাদী অপারেশন তাঁরই মস্তিষ্কপ্রসূত। মাওবাদী মুখপত্র ‘আওয়াম-ই-জং’এর সম্পাদকীয় বিভাগও তিনি সামলান।
একাধিক কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার আধিকারিকদের মতে, বাসব রাজুর সাংগঠনিক ক্ষমতা তো আছেই, সেই সঙ্গে টেকনিকাল বিষয়েও চৌখস তিনি। তাই তাঁর নেতৃত্বে আরও সক্রিয় হয়ে উঠতে পারে মাওবাদীরা।
Comments are closed.