নিউজিল্যান্ড সন্ত্রাসের পিছনে শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদের মতাদর্শ, অতি ডানপন্থী ফ্যাসিস্টরাই এই মুহূর্তে গোটা দুনিয়ার পক্ষে বিপজ্জনকঃ সোশ্যালিস্ট আপিল
গত শুক্রবার নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চ মসজিদে বন্দুকধারীর হামলায় নিহত হন ৫০ জন মানুষ। আহত হন অনেকে। উগ্র কট্টরপন্থী জাতীয়তাবাদী মনোভাবের বিরুদ্ধে বিশ্বের সব দেশকে রুখে দাঁড়ানোর ডাক দিয়েছেন নিউজিল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী জাসিন্ডা আর্ডেন। কিন্তু এই সন্ত্রাসবাদী হামলার জন্য দায়ী আসলে কে? কাদের মদতেই বা এমন ঘটনা ঘটছে বিশ্বজুড়ে। এই সন্ত্রাসবাদের মতো গভীর সমস্যা কীভাবে মিটবে?
মার্কসবাদী পত্রিকা সোশ্যালিস্ট অ্যাপিলে গত ১৯ শে মার্চ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এই নিয়েই প্রতিবেদন লিখলেন ফ্রেড ওয়েস্টন। ‘Christchurch massacre:far-right terrorism and the barbarism of capitalism’ শীর্ষক প্রতিবেদনে ফ্রেড ওয়েস্টন লিখেছেন, বিশ্বজুড়ে তীব্র অর্থনৈতিক সংকট আর রাজনৈতিক উত্তেজনার মধ্যে নিউজিল্যান্ডে এমন একটি হামলা নাড়িয়ে দিয়েছে সারা পৃথিবীর মানুষকে। কিন্তু আমাদের নিজেদেরই প্রশ্ন করা উচিত কেন এমন বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটছে। কীভাবেই বা এই বর্বরতা শেষ হবে?
২৮ বছরের অস্ট্রেলিয়ান যুবক ব্রেন্টন টারান্ট এই হামলার দায়ে ধরা পড়েছে নিউজিল্যান্ড পুলিশের হাতে। হামলার আগে সোশ্যাল মিডিয়ায় ৭৩ পাতার ইশতেহার আপলোড করে ব্রেন্টন। সে দাবি করে, শ্বেতাঙ্গদের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবিত বলেই এমন একটি হিংসার আশ্রয় নিতে চলেছে সে। তার লক্ষ্য অন্য দেশ থেকে আসা কৃষ্ণাঙ্গ, বিশেষ করে মুসলিমদেরকে ভয় পাওয়ানো।
লেখক ফ্রেড ওয়েস্টনের মতে, পুরো সন্ত্রাসবাদী হামলার পেছনে রয়েছে শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদের মতাদর্শ। ছোট অথচ ক্রমশ বেড়ে চলা এই অতি ডানপন্থী ফ্যাসিস্টরাই এই মুহূর্তে গোটা দুনিয়ার পক্ষে বিপজ্জনক।
ক্রাইস্টচার্চ মসজিদ হামলায় অভিযুক্ত ব্রেন্টন টারান্ট জানিয়েছে, আমেরিকার অতি ডানপন্থী নেত্রী ক্যান্ডেস ওনস তার অনুপ্রেরণা। ব্রিটিশ প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমর্থনকারী ক্যান্ডেস ওনস কিছুদিন আগেই আশঙ্কা প্রকাশ করেছিলেন, ২০৫০ সালের মধ্যে গোটা ইউরোপটাই মুসলিম প্রধান মহাদেশে পরিণত হবে। আইন করে আমেরিকায় মুসলিমদের প্রবেশ ঠেকানো উচিত বলে সওয়াল করেছিলেন আমেরিকার এই অতি ডানপন্থী নেত্রী। হিটলারের সমর্থনকারী এই নেত্রীই তার অনুপ্রেরণা বলে উল্লেখ করেছে ব্রেন্টন টারান্ট। ডোনাল্ড ট্রাম্পেরও দারুণ ভক্ত টারান্ট তাঁকে নতুন শ্বেতাঙ্গদের প্রতীক বলে উল্লেখ করেছে। ট্রাম্পের মুসলিম বিদ্বেষ এবং অনুপ্রবেশ বিরোধী অবস্থানের জন্য আমেরিকার প্রেসিডেন্ট তাকে মুগ্ধ করে বলে জানিয়েছে গ্রেফতার হওয়া টারান্ট।
ফ্রেড ওয়েস্টন তাঁর প্রতিবেদনে লিখেছেন, ট্রাম্প অভিযোগ করছেন নিউজিল্যান্ডের হামলার জন্য অনেকে তাঁকে আক্রমণ করছেন। লেখক ওয়েস্টনের মতে, প্রত্যক্ষভাবে না হলেও পরোক্ষেভাবে মার্কিন প্রেসিডেন্টই এই সন্ত্রাসবাদী হামলার জন্য দায়ী। কারণ, ট্রাম্পের শরণার্থী প্রবেশ বিরোধী বক্তব্য, আমেরিকার সীমানায় পাঁচিল তুলে দেওয়ার ঘোষণা বা মুসলিম বিরোধী এবং মুসলিম প্রধান দেশগুলির প্রতি বিদ্বেষ এক শ্রেণির মানুষের মনে ‘ইসলামোফোবিয়া’র জন্ম দিয়েছে। আর তারই ফল এমন বর্বরোচিত ঘটনা বলে দাবি সোশ্যালিস্ট অ্যাপিলের প্রতিবেদনে।
কিন্তু সব সন্ত্রাসবাদী ঘটনার মূলেই রয়েছে ইসলাম, এই ভাবনা কতটা সত্য?
ফ্রেড ওয়েস্টন লিখেছেন, ২০১৭ সালে আমেরিকার ৬৫ টি সন্ত্রাসবাদী হামলার মধ্যে ৩৬ টি আক্রমণের দায় দক্ষিণপন্থী সংগঠনের। ১০ টি ঘটনার মূলে রয়েছে বামপন্থী এবং ৭ টি সন্ত্রাসবাদী হামলার দায় ইসলামিক সন্ত্রাসবাদীদের। কিন্তু সেই সত্যি আড়াল করে পূর্বের দেশগুলি মিডিয়ার সাহায্য নিয়ে কেবল মুসলিমদেরই সব সন্ত্রাসবাদী হামলায় মূলে থাকার অভিযোগ আনছে। ওয়েস্টন লিখেছেন, এই ঘটনাগুলির মূলে আসলে পুঁজিবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী ষড়যন্ত্র কাজ করছে। শুধু আমেরিকা বা অস্ট্রেলিয়া নয়, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেই ধর্ম, চামড়ার রঙ আর সামাজিক অবস্থানে যারা পিছিয়ে, তাদেরকেই নিশানা করছে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি।
সোশ্যালিস্ট অ্যাপিলের লেখকের মতে, পুঁজিবাদীরা নিজেদের স্বার্থরক্ষার জন্য সব সময়ই চায়, খেটে খাওয়া মানুষ যাতে ঐক্যবদ্ধ হতে না পারে। তাই কখনও ধর্মের ধুয়ো তুলে, কখনও নাগরিক স্বার্থের নামে নিচুতলার মানুষের মধ্যে ভাগ করে রাখে। খাবার,বাড়ি, শিক্ষা বা কর্মসংস্থানের সুবিধা সবার জন্য সব দেশেই যথেষ্ট রয়েছে বলে লিখেছেন ফ্রেড ওয়েস্টন। কিন্তু সমস্যা হল, এই সুবিধাগুলি কেবল মুষ্টিমেয় শ্রেণিই ভোগ করে আসছে। নিজেদের ক্ষুদ্র স্বার্থেই পুঁজিবাদীরা এই সভ্যতাকে ধ্বংসের মুখে নিয়ে যাচ্ছে বলে তাঁর প্রতিবেদনে লিখেছেন ফ্রেড ওয়েস্টন। তাঁর মতে, এই সমস্যাগুলি দূর হবে, যখন শ্রমিকদের উৎপাদিত সম্পদের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা থাকবে তাদেরই হাতে। তাঁর কথায়, দারিদ্র্য ও মৌলিক প্রয়োজন মিটলেই জাতিগত ও ধর্মীয় বিবাদ-সঙ্ঘর্ষ মিটে যাবে।
Comments are closed.