সিপিএম এক পা আগে, এক পা পিছে। এবং সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের মৃত্যু

এ যেন শেয়ার বাজারের ওঠা-নামাকেও হার মানায়। এই উঠছে, তো এই নামছে।
৯ ই অগাস্ট ছিল রাজ্যজুড়ে সিপিএমের জেলভরো কর্মসূচি। ঝাড়গ্রাম বাদ দিলে বাকি গোটা রাজ্যে সেদিন আইন অমান্য করে জেলভরো কর্মসূচি নিয়েছিল কৃষক সভা এবং শ্রমিক ফ্রন্ট। সেই কর্মসূচিতে কলকাতা, দুই ২৪ পরগনা, হাওড়া, হুগলিসহ গোটা দক্ষিণবঙ্গ এবং উত্তরবঙ্গেরও জলপাইগুড়ি, শিলিগুড়ি, আলিপুরদুয়ার, কোচবিহারে যথেষ্টই সাড়া মেলে। সেদিন দুপুরের পর থেকে সোশ্যাল মিডিয়ায় শুধু একটাই ছবি আলোড়ন ফেলে গোটা রাজ্যে। চারদিকে লাল পতাকার ছড়াছড়ি। পুলিশের ব্যারিকেড ভাঙা। রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র থেকে শুরু করে বিমান বসুসহ সমস্ত শীর্ষ নেতা রাস্তায়। এক বয়স্ক ব্যক্তি পুলিশের ব্যারিকেডের ওপর দাঁড়িয়ে, মুষ্টিবদ্ধ হাতে লাল পতাকা। এই ছবি তো রীতিমতো ভাইরাল হয়ে যায় সোশ্যাল মিডিয়ায়। বামেদের সরিয়ে রাজ্যে বিরোধী পরিসরটা ক্রমেই দখল করে নিচ্ছে বিজেপি, এই যখন পরিস্থিতি রাজ্যজুড়ে, তখন ৯ ই অগাস্টের জেলভরো কর্মসূচির একের পর এক ছবি বিশেষ আশার সঞ্চার করেছিল রাজ্যের লক্ষ-লক্ষ সিপিএম, বাম এবং বৃহত্তর বাম পরিবারের সদস্যের মধ্যে। আবার কি আন্দোলন, কর্মসূচির হাত ধরে ঘুরে দাঁড়াবে সিপিএম? আবার কি রাস্তায় রাস্তায় দেখা যাবে বাম নেতাদের?মানুষের মৌলিক দাবি-দাওয়া নিয়ে কি গ্রামের বুথে-বুথে শাসক দলের ব্যারিকেড ভাঙতে পারবে সিপিএম? লোকসভা ভোটের যখন আর এক বছরও বাকি নেই, তখন ৯ ই অগাস্টের জেলভরো কর্মসূচি দেখে এই প্রশ্নই উঁকি দিতে শুরু করেছিল রাজ্যের সিপিএম কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে।

কিন্তু এই উর্দ্ধমুখী গ্রাফ, সোশ্যাল মিডিয়ার প্রচারে ইতিবাচক চেহারা দেখে যাঁরা একটু বুকে বল, মনে ভরসা পেয়েছিলেন ৯ তারিখ রাতে, ২৪ ঘন্টাও কাটল না আচমকা বজ্রপাতের মতো তাঁরা শুনলেন, ১৭ মাস বাদে ভাঙড় সমস্যার সমাধান হয়ে গিয়েছে। সরকারের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের নেতা অলীক চক্রবর্তী এবং আরও কয়েকজন চুক্তি করে ফেলেছেন। পাওয়ার গ্রিডের নাম বদলে সেখানে কাজ শুরু হবে, বদলে সেখানকার বাসিন্দাদের বিরাট ক্ষতিপূরণ দেবে রাজ্য সরকার।
২০১৭ সালের ১৭ ই জানুয়ারি ভাঙড়ে আন্দোলন শুরু হয়েছিল। পাওয়ার গ্রিড বিরোধী নাছোড়বান্দা আন্দোলন। প্রথম দিনই পুলিশের জিপ পোড়ানো, পুলিশের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের দফায় দফায় সংঘর্ষ। গুলি, মৃত্যু। এক্কেবারে ১০ বছর আগের নন্দীগ্রামের মতো চিত্রনাট্য। জমি নিয়ে গণ্ডগোল, সংঘর্ষ, মানুষ সরকারের ওপর ক্ষুব্ধ, এলাকায় পুলিশ ঢুকতে পারছে না। ঢুকতে পারছেন না তৃণমূল নেতারাও। গত প্রায় দেড় বছর ধরেই কাজ বন্ধ ভাঙড়ে। মেডিকেল কলেজ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার বিরোধী আন্দোলনের মতো এই ভাঙড়েও দীর্ঘ দিন ধরেই নকশালপন্থীদের সহায়ক শক্তি সিপিএম। সেই সিপিএম হঠাৎ ১০ ই অগাস্ট, ২০১৮ তে দেখল, ভাঙড় সমস্যা মিটে গেছে। অলীক চক্রবর্তীদের সঙ্গে সরকারের মিটিং হচ্ছে। কয়েক দিন আগেও অলীক চক্রবর্তীর গ্রেফতারিকে ‘সরকারি দমন নীতি’ বলে বিবৃতি দিয়েছেন আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের নেতারা। এমনকী এত গুরুতর সব মামলা থাকা সত্ত্বেও কীভাবে অলীক চক্রবর্তী বলা-কওয়া নেই হঠাৎ জামিন পেয়ে গেলেন তাও ভাবেননি ৩৪ বছর টানা সরকার চালানো সিপিএম নেতারা। খোঁজই রাখেননি, ঠিক কত দিন ধরে অলীক চক্রবর্তী এবং তাঁর সঙ্গীদের সঙ্গে কথা চালাচ্ছেন সরকারি প্রতিনিধিরা। যখন জানলেন, তখন বহু দেরি হয়ে গিয়েছে। ১১ ই অগাস্ট ভাঙড় নিয়ে খবরে সিপিএমের মুখপত্র গণশক্তি লিখল, ‘যদিও গ্রামবাসীদের একাংশের মধ্যে প্রশ্ন, প্রকল্প কিছুটা এদিক ওদিক করে নাম বদলালেই যদি সব সমাধান হয়ে যায়, তাহলে এই আন্দোলনের মানে কী ছিল? তাহলে এত ক্ষয়ক্ষতি, তিনজন গ্রামবাসীর মৃত্যুর কী প্রাসঙ্গিকতা থাকল?’

২০০১ সাল থেকে রাজ্যে শিল্পায়নের স্লোগান তোলা সিপিএম কি চাইছিল, ভাঙড় সমস্যার সমাধান না হোক? নাকি চাইছিল, তিনজনের মৃত্যুর প্রাসঙ্গিকতা রক্ষা করতে সরকার এই প্রকল্প বাতিল বলে ঘোষণা করুক? আসলে নকশালপন্থীদের ঘাড়ে সওয়ার হয়ে ভাঙড়ে গিয়ে মিটিং করতে করতে সিপিএম নেতারা ভুলেই গেছিলেন, সেখানে তাঁদের সাংগঠনিক শক্তি আসলে নেই বললেও কম বলা হয়। তাই তাঁরা জানতেনও না, কী হচ্ছে ভাঙড়ে। জেলা কেন্দ্রে এবং কলকাতায় শুধু জেল ভরলেই যে হবে না, বুথে বুথে সংগঠন থাকতে হবে বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করতে গেলে তারই এই শিক্ষার নাম ৯ ই অগাস্ট জেলভরো কর্মসূচির পরদিন ভাঙড় চুক্তি!
৯ ই অগাস্ট জেলভরো কর্মসূচি করে সিপিএমের দর শেয়ার বাজারে যতটুকু উঠেছিল, আবার একই জায়গায় ফিরে এল পরদিন ভাঙড়ে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে সরকারের চুক্তিতে। কিন্তু তখনও পর্যন্ত এটা বোঝার উপায় ছিল না, গোটা সপ্তাহটা কেমন যাবে। এবং তা বুঝতে লাগল না আর ৪৮ ঘন্টাও। ১৩ তারিখ সকালে মারা গেলেন সিপিএমের প্রাক্তন সাংসদ, লোকসভার প্রাক্তন স্পিকার এবং ২০০৮ সালে দল থেকে বহিষ্কৃত সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়। সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়কে ‘কমরেড’ বলা হবে কিনা সেই বিভ্রান্তি দিয়ে দিন শুরু হল আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের।
তারপর থেকে একের পর এক এমন ঘটনার সাক্ষী থাকতে হল বিমান বসু, সূর্যকান্ত মিশ্র, মহম্মদ সেলিমদের, যা দুর্ভাগ্যজনক এবং দুঃখজনকও বটে। যা নিশ্চিতভাবেই সিপিএম শীর্ষ নেতাদের প্রাপ্য ছিল না। বিশেষ করে প্রাপ্য ছিল না বাংলার নেতাদের।
গত তিন বছরে, বিশেষ করে ২০১৫ সালের মাঝামাঝি থেকে আলিমুদ্দিন স্ট্রিট বারবারই চেষ্টা করেছিল সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়কে পার্টির সদস্য পদ ফিরিয়ে দিতে। এর জন্য বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য পার্টির এক শীর্ষ নেতা। শুধু এটুকুই বলা যায়, সোমনাথবাবুও প্রায় রাজি হয়ে গিয়েছিলেন। পার্টি গঠনতন্ত্রের একটা টেকনিকাল কারণে তা আটকে যাচ্ছিল বারবার। শেষ পর্যন্ত তাঁর সদস্য পদ ফিরিয়ে দিতে ব্যতিক্রমী কিছু সিদ্ধান্ত নিতেও তৈরি হয়ে গিয়েছিল মুজফফর আহমেদ ভবন। কিন্তু কোন পরিস্থিতিতে, কী ব্যক্তিগত কারণে প্রায় রাজি হয়েও সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় পার্টি সদস্য পদ নেননি, বা বলা ভালো নিতে পারেননি তা আজ আর প্রাসঙ্গিক নয়। শুধু এটুকুই লিখতে পারি, সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের মৃত্যুর পর তাঁর মরদেহ আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে যায়নি, সেটা বড় কোনও ব্যাপার নয়। সে তো অশোক মিত্রর মরদেহও যায়নি। কিন্তু সোমনাথবাবুর মৃত্যুর পর আলিমুদ্দিন স্ট্রিট যা পেল, তা তাদের প্রাপ্য ছিল না।

এ প্রাপ্তি জেলভরো আন্দোলনের সাফল্য বা ভাঙড়ের ব্যর্থতা দিয়ে মাপা যায় না। এ প্রাপ্তি চিরকালীন দুঃখের, বেদনার।

Comments are closed.