পুরুষ-নারীর আয়ের ফারাকই ভারতে সৃষ্টি করছে অর্থনৈতিক বৈষম্য, জাতি বৈষম্যও দারিদ্রের অন্যতম কারণ, রিপোর্ট অক্সফামের

ভারতে বৈষম্য বাড়ছে। আর লাফিয়ে বেড়ে চলা বৈষম্যের নেপথ্য কারণ হিসেবে অর্থনীতিবিদরা বলছেন লিঙ্গ বৈষম্য এবং অর্থনীতির উপর তার প্রভাবকে। যেখানে লুকিয়ে ভারতে বৈষম্যের এক চিরকালীন ছবি।
একই কাজ করে পুরুষদের চেয়ে অনেক কম উপার্জন করেন মহিলারা। ফলে সমাজের সর্বস্তরেই একই কাজ করেও পুরুষের তুলনায় আয় কম মহিলাদের। ফলে পুরুষতান্ত্রিক ভারতে যে সমস্ত পরিবারে মূল উপার্জনকারী মহিলা, সেখানে স্বাভাবিকভাবেই উপার্জন কম।
শেষ পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০১১-১২ সালে ভারতে পুরুষ ও মহিলাদের পারিশ্রমিকের পার্থক্য ছিল ৩৪ শতাংশ। অর্থাৎ, একজন পুরুষ কাজ করে ১০০ টাকা উপার্জন করলে, সেই একই কাজ করে মহিলা পাবেন মাত্র ৬৬ টাকা। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, নারী-পুরুষে আয়ের এই বৈষম্যই প্রাথমিক স্তরে জন্ম দিচ্ছে অর্থনৈতিক বৈষম্যকে। পরবর্তীতে যা সর্বব্যাপী হয়ে উঠছে।
২০১৮ সালে ওয়ার্ল্ড ইকনমিক ফোরামের গ্লোবাল জেন্ডার গ্যাপ ইনডেক্সে ভারতের স্থান ছিল ১০৮। ২০০৬ সাল থেকে ১০ ধাপ নীচে। সামগ্রিক লিঙ্গ বিভাজনের নিরিখে ভারতের গড় বিশ্বের গড়ের অনেকটাই নীচে। এমনকী চিন, বাংলাদেশের মতো প্রতিবেশী দেশেরও পেছনে রয়েছে ভারত।
কেবলমাত্র লিঙ্গভিত্তিক সমীক্ষাই নয়, জাতি ভিত্তিক সমীক্ষাগুলোতেও উঠে এসেছে ভারতে বৈষম্যের করুণ ছবি। অক্সফামের রিপোর্ট বলছে, ৪২ শতাংশ উপজাতীয় (ট্রাইবাল) শিশুই ভোগে কম ওজনের সমস্যায়। যে হার সাধারণ বর্গের শিশুদের তুলনায় দেড়গুণ বেশি। ভারতের গরিব পরিবারের শিশুরা জন্মের পর নিজের প্রথম জন্মদিনও দেখতে পারে না, তার আগেই মৃত্যু হয়, এই পরিমাণ সাধারণ বর্গের অবস্থাপন্ন শিশুদের তুলনায় তিনগুণ বেশি। অক্সফাম বলছে, ভারতে একজন দলিত মহিলা উচ্চবর্ণের মহিলার চেয়ে গড়ে ১৪.৬ বছর কম বাঁচেন। অথচ কেরল, মিজোরাম এবং অন্যান্য কেন্দ্র শাসিত এলাকায় সাক্ষরতার হার ৯০ শতাংশেরও উপরে। সবচেয়ে বড় কথা, জনসংখ্যার একেবারে উপরের শ্রেণির ধনী পরিবারগুলোর মেয়েরা গড়ে ন্যূনতম ৯ বছর শিক্ষার সুযোগ পান, আর জনসংখ্যার একেবারে তলার ২০ শতাংশ মেয়েদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার কোনও সুযোগই নেই।
তাহলে বৈষম্য দূরীকরণের দাওয়াই কী? অক্সফামের রিপোর্ট বলছে, সামাজিক ক্ষেত্রে সরকারি ব্যয়বরাদ্দ বৃদ্ধি করা ছাড়া রাস্তা নেই। শিক্ষা, স্বাস্থ্যে বরাদ্দ বাড়ানো গেলে এবং তা প্রতিটি মানুষের কাছে পৌঁছনো গেলেই একমাত্র এই বৈষম্যের অবসান হবে। তবে এক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা সামাজিক। ঘোর পুরুষতান্ত্রিক ভারতে নারী স্বাধীনতা কিংবা নারী-পুরুষ সমানাধিকারের বুলি উচ্চারণ হয়েছে সহস্রবার, কিন্তু কাজের কাজ যে কিছুই হয়নি, অক্সফামের রিপোর্টে তা জলের মত পরিষ্কার।
তবে এই বৈষম্য যে কেবলমাত্র ভারতেই বিরাজ করছে, এমনটা নয়। গোটা বিশ্বের অর্থনীতিকেই বৈষম্যের ঝাপটা সহ্য করতে হচ্ছে। গরিব মানুষের সংখ্যা যে হারে বাড়ছে, ধনী, অতি ধনীদের বাড়বাড়ন্ত টেক্কা দিচ্ছে তাকে। রিপোর্ট বলছে, ২০১৮ সালে গোটা বিশ্বে মোট ২,২০৮ জন বিলিওনিয়ার ছিলেন। পরিস্থিতি এমনই যে, প্রতি দু’দিনের মধ্যে একজন করে বিলিওনিয়ার হিসেবে স্বীকৃতি পাচ্ছেন। গত ১ বছরে বিশ্বের ১,৯০০ জন বিলিওনিয়ারের সম্পদ বেড়েছে দৈনিক ২.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বা ১৭৫ বিলিয়ন টাকা হিসেবে। আর প্রদীপের তলার অন্ধকারের মতো অর্ধেক মানব সমাজ, অর্থাৎ ৩.৮ বিলিয়ন মানুষের সম্পদ কমেছে ১১ শতাংশ হারে। ২০১৮ সালের হিসেব দেখলে চোখ কপালে উঠবে। সেখানে বলা হয়েছে মাত্র ২৬ জন সুপার রিচের কাছে যা সম্পত্তি আছে, তা বিশ্বের ৩.৮ বিলিয়ন গরিব মানুষের হাতে থাকা মিলিত সম্পত্তির পরিমাণের সমান। বিশ্বের সবচেয়ে বড়লোক অ্যামাজনের কর্ণধার জেফ বেজোসের হাতে থাকা বিপুল সম্পত্তির মাত্র ১ শতাংশের যা মূল্য, তা ইথিওপিয়ার মতো দেশের স্বাস্থ্য বাজেটের সমান। ইথিওপিয়ার জনসংখ্যা সাড়ে ১১ কোটি।

Comments are closed.