বিহারের পশু খাদ্য মামলায় এক সময়ের অভিযুক্ত কলকাতার এক ব্যবসায়ী উধাও, সিবিআই অফিসারকে জেরা রাজ্য পুলিশের, চাঞ্চল্য 

বিহারের ৯০০ কোটি টাকার পশু খাদ্য কেলেঙ্কারিতে এক সময়ের ‘অভিযুক্ত’, বর্তমানে ‘সাক্ষী’ এবং অন্য একটি নতুন মামলায় অভিযুক্ত কলকাতার এক ব্যবসায়ী সিবিআই অফিসারকে নিজের গাড়িতে লিফট দিয়ে মাঝ রাস্তায় ‘অসুস্থতা’র কথা বলে রহস্যজনকভাবে উধাও হয়ে গেলেন। ঘটনাটি ঘটেছে গত ১৭ ই অগাস্ট হাওড়া স্টেশন সংলগ্ন ফোরশোর রোডে। ঘটনার পরদিন সন্ধ্যায় সিবিআইয়ের সাব ইন্সপেক্টর হাওড়া থানায় অভিযোগ দায়ের করেন। এই ঘটনায় এখন সিবিআইয়ের সাব ইন্সপেক্টরকেই জেরা করছে রাজ্য পুলিশ। তাঁর বক্তব্যে বেশ কিছু অসঙ্গতি রয়েছে বলেও প্রাথমিক তদন্তে রাজ্য পুলিশের অফিসারদের ধারণা। গোটা ঘটনাটি নিয়ে চাঞ্চল্য শুরু হয়েছে সিবিআইয়ের অন্দরে।
ওই ব্যবসায়ীর নাম দীপেশ চন্দক। তাঁর বিরুদ্ধে এক সময় বিহারের পশু খাদ্য কেলেঙ্কারিতে যুক্ত থাকার অভিযোগ ছিল। সূত্রের খবর, সুনীল মিনা নামে সিবিআইয়ের এক সাব ইন্সপেক্টর গত ১৮ অগাস্ট ওই ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে হাওড়া থানায় এক অভিযোগ দায়ের করেছেন। অভিযোগে তিনি জানিয়েছেন, দীপেশ চন্দক নামের ওই ব্যবসায়ী ‘অসুস্থতা’র কথা বলে তাঁর চোখে ধূলো দিয়ে ১৭ ই অগাস্ট ফরশোর রোড থেকে পালিয়ে গেছেন। তদন্তে নেমে রাজ্য পুলিশ এই ঘটনায় ওই সিবিআই অফিসার সুনীল মিনাকে দু’বার জেরা করেছে। এবং তদন্তকারীদের প্রাথমিক দাবি, ঘটনার যে বিবরণ সুনীল মিনা পুলিশকে দিচ্ছেন, তা সম্পূর্ণ সত্যি নাও হতে পারে।
সিবিআই “হেফাজত” থেকে এভাবে এই ব্যবসায়ীর পালিয়ে যাওয়ায় শুধু মাত্র রাজ্য পুলিশেরই চোখ কপালে ওঠেনি, সিবিআইয়ের একটা অংশের তদন্তকারী অফিসাররাও এই ঘটনায় বিস্মিত। সূত্রের খবর, চন্দকের পালানোর এই ঘটনায় দুই প্রত্যক্ষদর্শীকে জেরা করেছে পুলিশ। তাঁরা পুলিশকে ঘটনার যে বিবরণ দিয়েছেন, তা ওই সিবিআই অফিসারের বয়ানের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। এই ঘটনায় সিবিআই সাব ইন্সপেক্টরকে জেরার পাশাপাশি, পুলিশ ইতিমধ্যেই সিআরপিসি’র ১৬৪ নম্বর ধারা অনুযায়ী ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে ওই দুই প্রত্যক্ষদর্শীর গোপন জবানবন্দি রেকর্ড করিয়েছে। গত শনিবার ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে এই বয়ান রেকর্ড করা হয়।

 

কে এই দীপেশ চন্দক ও তাঁর পালনোর ঘটনাটি এত গুরুত্বপূর্ণ কেন?

এই শিল্পপতি একদা আরজেডি সুপ্রিমো লালু প্রসাদ যাদবের খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন। অভিযোগ, বিহার ও ঝাড়খন্ডে যে প্রায় ৯০০ কোটি টাকার পশু খাদ্য কেলেঙ্কারি হয়েছিল তাতে প্রায় ৪৫০ কোটি টাকা সরিয়েছিলেন এই ব্যবসায়ী। সিবিআই ৫৫ টি কেসের বেশিরভাগেই তাঁর নাম দেয়। কিন্তু পরে সিবিআই নিজেই ‘অভিযুক্ত’র তালিকা থেকে বাদ দিয়ে তাঁর নাম ‘সাক্ষী’র তালিকায় ঢুকিয়ে দেয়। এই বছরের মার্চ মাসে বিশেষ সিবিআই কোর্টের বিচারক শিব পাল সিংহ সমন জারি করে দীপেশ চন্দককে দুমকা ট্রেজারি মামলায় আদালতে হাজির করানোর নির্দেশ দেন সিবিআইকে। আদালতে ‘সাক্ষী’ হিসাবে ওই ব্যবসায়ী জানান, তিনি মাল সরবরাহ না করেও বিপুল পরিমাণ টাকা পেয়েছিলেন এই দুর্নীতির ঘটনায়। সেই সময় বিচারক জানিয়েছিলেন, যেভাবে সিবিআই তদন্তকারীরা ‘অভিযুক্ত’ থেকে এই ব্যবসায়ীকে ‘সাক্ষী’র তকমা দিয়েছেন তা বিস্ময়কর।

দীপেশ চন্দকের বিরুদ্ধে সিবিআইয়ের মামলার বর্তমানে কী অবস্থা?
ফুড কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়ার একটি গোডাউন ঘুষ দিয়ে লিজ দেওয়ার অভিযোগে গত মাসে দীপেশ চন্দকের বিরুদ্ধে নতুন মামলা করে সিবিআই। রাঁচির এফসিআই জেনারেল ম্যানেজার এ সিকান্দার এবং রণজয় চিৎলাঙ্গিয়া নামে দীপেস চন্দকের এক কর্মচারীকেও গ্রেফতার করে সিবিআই। জানা গেছে, রাঁচিতে দীপেশ চন্দকের একটি গোডাউন আছে, যেটি তিনি এফসিআইকে লিজ দেন। লিজের সময়সীমা শেষে হয়ে গেছে। এরপর দীপেশের নির্দেশে তাঁর কর্মী চিৎলাঙ্গিয়া ফুড কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়ার জেনারেল ম্যানেজার এ সিকান্দারকে লিজের সময়সীমা এবং লিজের টাকা বাড়ানোর কথা বলেন। সিবিআই সূত্রে জানা গেছে, অভিযোগ, গত ৩০ জুলাই চিৎলাঙ্গিয়া, এ সিকান্দারকে ২ লক্ষ টাকা দেন ও অগাস্টের ১৭ তারিখ অন্যান্য এফসিআই আধিকারিকদের তাঁর আরও টাকা দেওয়ার কথা ছিল। কোনও ফিল্ড স্টাডি না করেই, চিৎলাঙ্গিয়ার দেওয়া নথির উপর ভিত্তি করে এফসিআই আধিকারিকরা নতুন দামে লিজ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নেন। নথিপত্র তৈরি করার কথা মেসার্স বিনা টেক্সটাইলসের নামে। এই ঘটনায় এ সিকান্দার, দীপেশ চন্দক এবং  চিৎলাঙ্গিয়ার বিরুদ্ধে ১৬ অগাস্ট এফআইআর দায়ের করে সিবিআই।
কীভাবে পালালেন দীপেশ চন্দক?
গত ১৮ ই অগাস্ট হাওড়া পুলিশের কাছে দায়ের করা অভিযোগে সিবিআই অফিসারক সুনীল মিনা জানিয়েছেন, হাওড়ার জালান ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্সে দীপেশ চন্দকের
কারখানার বিষয়ে খোঁজ খবর নিতে তাঁকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। তাই ১৭ তারিখ তিনি সেখানে যান। কাজ শেষের পর তাঁকে রাচি যাওয়ার জন্য হাওড়া স্টেশনে যেতে হয়। দীপেশ চন্দক নিজের গাড়িতে তাঁকে লিফট দেন স্টেশনে নামিয়ে দেওয়ার জন্য। মিনা জানিয়েছেন, হাওড়ায় যাওয়ার রাস্তায় ‘অসুস্থতা’ বোধ করেন দীপেশ চন্দক। সেই সময় তিনি তাঁর সঙ্গে থাকা একজন কনস্টেবলকে জল আনতে পাঠান ও নিজেও গাড়ি থেকে নেমে ওষুধ আনতে যান। কিন্তু ফিরে আসার পর তাঁরা চন্দক বা তাঁর ড্রাইভারকে খুঁজে পাননি। তাঁরা এই কেসের গুরুত্বপূর্ণ কিছু নথি নিয়ে পালিয়ে যান। মিনার দাবি, ঘটনাটি ঘটে ১৭ ই অগাস্ট রাত ৯ টা ৪৫ নাগাদ। যদিও তিনি অভিযোগ দায়ের করেন পরদিন বিকাল ৬টা ৪৫ মিনিটে।
রাজ্যের তদন্তকারী পুলিশ অফিসাররা জানাচ্ছেন, যে অভিযোগ ওই সিবিআই আধিকারিক দায়ের করেছেন, তাতে অনেক ফাঁকফোঁকর রয়েছে। ওই সিবিআই অফিসার কেন নিজে ওষুধ আনতে ও কনস্টেবলকে জল আনতে পাঠালেন, তা তদন্তকারীদের কাছে পরিষ্কার হচ্ছে না। যেখানে একজনই এই দুটি কাজ করতে পারতেন। কেন চন্দকের গাড়ির ড্রাইভারকেই বা এই কাজে পাঠানো হয়নি, তাও ভাবাচ্ছে পুলিশ আধিকারিকদের। জানা গেছে, সেদিন মিনা প্রথমে কলকাতায় চন্দকের বাড়িতে গিয়েছিলেন, কিন্তু সেখানে তাঁকে না পেয়ে পরে হাওড়ায় তাঁর কারখানায় যান। চন্দকের গাড়িতে মিনার লিফট নেওয়ার বিষয়টি এবং এফআইআর করতে দেরি হওয়ার বিষয়টিও ভাবাচ্ছে তদন্তকারী পুলিশ অফিসারদের। মিনা কেন অভিযুক্তের গাড়িতে উঠতে রাজি হলেন, তাও পরিষ্কার নয়।
১৫ ই সেপ্টেম্বর, শনিবার ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে ঘটনার দুই প্রত্যক্ষদর্শী নিজেদের বয়ান জানিয়েছেন। পুলিশ সূত্রে খবর, প্রত্যক্ষদর্শীদের বক্তব্য এবং মিনার কথায় অনেক অমিল রয়েছে। এবিষয়ে জানতে মিনার সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, তিনি এবিষয় কথা বলতে চান না। তাঁকে যেন আর ফোন করা না হয়।

Comments are closed.