আর্যাবর্তের এই কলোনিতে আওয়াজ বারণ, নিঃশ্বাস আছে মানে, হিংসারও বাকি আছে! দাঙ্গা বিধ্বস্ত দিল্লিতে এক সাংবাদিকের সারাদিন

বহুক্ষণ ধরে গোল গোল করে মাথার উপর ঘুরে বেড়াচ্ছে চিল। ভাসতে ভাসতে নামছে, আবার শন শন করে উপরে। কুড়ি গজ দূরে ঘিলু বেরিয়ে গেছে একটা কুকুরের, পোড়া বাইক আর স্কুটারগুলোর স্তূপের ঠিক পাশেই। তার পাশেই মসজিদ। গত তিন দিন ধরে ওই মসজিদ নিয়ে অনেক কথা হয়েছে, হয়েছে রটনাও, যার উত্তাপ কতটা তীব্র, আশপাশের মহল্লায় ঢুকলে বুঝতে অসুবিধা হয় না।

মসজিদের পাশের বাড়ির রং দু’দিন আগেও নিশ্চয় হলদেটে ছিল। নিশ্চয় রং চটা চটা রং ছোপ ছোপ হয়ে ছিল। বিত্তবানের বাড়ি বলে তো মনে হয় না। আজ সেই দোতলা বাড়ি অনেক দিন পরিষ্কার না হওয়া হ্যারিকেনের মতো কালো হয়ে গিয়েছে। সামনে স্তূপিকৃত ছাই।
বাড়ির দরজা হাট করে খোলা। না, একে খোলা বলা যায় না, ভাঙা। ভিতরে হালকা রোদের আভায় যেটুকু দেখা যায়, তাকে শ্মশানের শূন্যতা বলে। দরজায় এক দলা কাঠ হয়ে যাওয়া ছাই রঙা ভাত দেখে বোঝা যায়, পালানোর সময় বাড়ির মালকিন ডেকচির ভাতটুকুও উনুন থেকে নামানোর সময় পাননি। যারা জ্বালিয়েছে, ডেকচিটা বাইরে নিয়ে আগুনের মুখে ফেলার সময় ভাতটুকু পড়ে গিয়েছে দরজার ধারে। ভাত পেরিয়ে আরেকটু এগোতেই আতঙ্ক বয়ে গেল মেরুদণ্ড বেয়ে। নিঃশ্বাসের শব্দ।

পেশাদার সাংবাদিক ভরপেটে সকাল থেকে উত্তর পূর্ব দিল্লিতে ঘুরে বেড়াচ্ছে কন্ডাক্টেড ট্যুরে। কোথাও গাইড গত তিনদিন ধরে এ অঞ্চলে আসা পরিচিত সাংবাদিক। আসব শুনেই বলেছিল, এমন জায়গা দেখাবে, যেখানে তখনও পর্যন্ত ক্যামেরার প্রবেশ ঘটেনি। সাংবাদিক ইনস্টিঙ্কট। পরের গাইড পুলিশ, ”পত্রকারজি, জান খতরে পে মৎ ডালো। আগর উধার জানা হ্যায় তো জরুর বাতা না। ম্যায় এসকর্ট ভেজ দুঙ্গা।” এসকর্ট বদল হয় মাঝ দুপুরে। ২৩ এর তরুণ হাত ধরে নিয়ে যায় কলোনির ভিতর। শিরোস্ত্রাণ, বর্ম পরা অটোমেটিক মেশিন গানের ট্রিগারে হাত রাখা পুলিশ এখনও সেখানে ঢোকার অনুমতি পায়নি। প্রাণেরও ধর্ম আছে। সরকার শিখিয়ে দিয়েছে। নতুন মহল্লায় পত্রকার, ভাইজান। হ্যাঁ, ভাইজান কারণ তাঁর হাতের বুমে বিদেশি সংবাদ সংস্থার লোগো। দেশি সাংবাদিকেরও সেখানে প্রবেশ নিষেধ। তবে শর্ত আছে। যা শ্যুট হলো, সেই ফুটেজ এবং স্টিল ছবি দেখিয়ে নিতে হবে। গলির মোড়ের কমিটি তাতে ছাড়পত্র দিলে তবেই মুক্তি। এই সব সাত পাঁচ দেখতে দেখতেই পৌঁছনো গেল নো ম্যানস ল্যান্ডে। কোনও গাইডই ঢুকছেন না সেখানে। জতুগৃহের মতো এক চিলতে পাড়া গুম মেরে পড়ে আছে শিববিহার শ্মশান পাড়ায়। শ্মশানের নিস্তব্ধতা এতটাই যে গত তিন দিন ধরে সত্যিকারের শ্মশানে একটাও মরার খাট আসেনি। ডোমের ঘরে তালা।
ভাঙা দরজার গায়ে নিঃশ্বাসের শব্দে ঠান্ডা রক্তের স্রোত বেয়ে যায় শিরদাঁড়া বেয়ে। উত্তর পূর্ব দিল্লির বিস্তীর্ণ অঞ্চলে এখন প্রাণ মানেই ভয়। নিঃশ্বাস আছে মানে, হিংসারও বাকি আছে।
সন্ত্রাস দেখতে আসা পর্যটক সাংবাদিকের ক্যামেরা সজাগ হয়। বলা তো যায় না, এখানেই হয়তো মিলে যাবে পুলিৎজার জেতার মতো কোনও এক আহত শরীর। সন্ত্রাসীরা মৃত ভেবে যে শরীরকে দিয়ে জনগণমন গাওয়ায়নি। প্যান্ট খুলিয়ে বুঝতে চায়নি গভীর পরিচয়।
শরীরই তো! খয়রি ভেলভেট ফারের নেড়ি কুকুরের শরীরটাও এখন কালো পোচ লাগা বাড়িটার মতো। গলায় স্বর নেই, ওঠার ক্ষমতা নেই। জিভ বেরিয়ে বুকে গিয়ে লাগছে একবার করে, আর শনিবারের ডিস্কের মতো বাস সাউন্ডের অনুরণন হচ্ছে জ্বলে যাওয়া হলের ভিতর।
কুকুরটা এক চোখে তাকিয়ে আছে সাংবাদিকের দিকে। অন্য চোখের পোড়া বেয়ে কষ গড়িয়ে ভিজে গিয়েছে মাটি। শন শন ঝাপটায় ক্যামেরার জুম ছুঁয়ে চিল তুলে নিল রাস্তায় পড়ে থাকা মৃত কুকুরের ঘিলু। আরেকটা কালো কুকুর লেজ সোজা করে আপাদমস্কক ছাই মেখে শিবের মতো উদ্দাম নৃত্য করতে করতে একবার যাচ্ছে ঘিলু হারানো মৃতদেহের সামনে, একবার সাংবাদিকের ব্যাগ রাখা সিঁড়ির কিনারে। মুখে শব্দ নেই। শ্মশানে সকলেই বাকরুদ্ধ হয়। আর্যাবর্তের এই কলোনিতে আওয়াজ বারণ।

ক্লিক ক্লিক ক্লিক। তিনবার শাটারের শব্দ। ডান পায়ে চোখের কষ মুছে ফাটা শেল পড়ে থাকা শূন্যতায় দৃষ্টি বিলীন হলো একাকী সারমেয়র। এই ঘর, একদা এই বাড়ির যাবতীয় পারিবারিক কলহ এবং ভালবাসার সাক্ষী বুঝিয়ে দিল, সাংবাদিকের কাজ শেষ। তার কাজ শেষ হবে সেই দিন, যে দিন সে বুঝতে পারবে, বাড়ির সকলে আর ফিরবে না। বিপুল মারের পর আগুনে পুড়তে পুড়তে ওর মালিক কি ভেবেছিলেন পাহারাদার পোষ্যের কথা?
সময় ফুরোতে থাকে। পুলিশ এবং ভাইজান গাইড পাখি পড়ার মতো শিখিয়ে দিয়েছিলেন, আলো কমার আগে ছাড়তে হবে এলাকা। সঙ্গী সহকর্মী ফোন করছেন, গাড়ি নিয়ে এগিয়ে যেতে হয়েছে কয়েকশো গজ। রাস্তার মোড়ে শুরু হয়েছে পাথর বৃষ্টি। আহত হয়েছেন এক মহিলা। যুদ্ধক্ষেত্র পেরিয়ে যত দ্রুত সম্ভব পৌঁছতে হবে গাড়িতে। গাড়ির চালক হিন্দু। ড্যাশ বোর্ডে শিবের ছবি। থাকতে চাইছেন না।
যে কোনও ভয়ের ছুটের টাইম ক্যালকুলেটর হয় না। এক মিনিট এক ঘণ্টা, পাঁচশো গজ সাতশো মাইলের মতো। তবে সঙ্গী ছিল। শিব রঙে ছেয়ে থাকা ল্যাজ সোজা কুকুরটা। যুদ্ধক্ষেত্রে কভার দেওয়ার মতো পাশে পাশে, একদম গাড়ির দরজা পর্যন্ত।
বাকি পথটা চলতি ন্যারেটিভ। দাঙ্গার ঠিক ভুল। কে আগে শুরু করেছিল, শেষের দায় কার! সোশাল নেটওয়ার্কের সততা, টেলিভিশনের প্যানেল, খবরের কাগজের পলিসি, সেই সমস্ত দায় এবং দায়িত্ব জমিদারী সম্মানের মতো নিয়ে বসে আছে। অনেক ফুটেজ ওদের, সে বিষয়ে কথা বলা নেহাতই ধৃষ্টতা।

Comments are closed.