ইঞ্জিনিয়ার ভাই-বোনের অন্যরকম পথ চলা ‘ফুচকাWala’য় মজে বাঙালি

ফুচকার সঙ্গে বাঙালির জিভের যোগ নিবিড়। মণ্ডা-মিঠাই, কোফতা-কাবাব যাই থাকুক না কেন, বাঙালির প্রাণের আরাম ফুচকাই।

এহেন ফুচকাই যদি রকমারি হয় কেমন হয়? টক জলের পাশাপাশি বাংলাদেশি ফুচকা, চিংড়ি ফুচকা, চিজ কর্ন ফুচকা, আইসক্রিম ফুচকা মেনু কার্ডে থাকলে, ফুচকাপ্রেমী বাঙালির কাছে তা একপ্রকার স্বর্গ।

দাদা যাদবপুর ইউনিভার্সিটি থেকে প্রিন্টিং ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়াশোনা করেছেন। বোন কম্পিউটার সাইন্স নিয়ে বি-টেক করছেন, দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী। ভাই-বোন দু’জনে এখন নেট রাজ্যে ‘ফুচকাWala’ নামে তুমুল জনপ্রিয়। রবিবার সকালে ফুচকাওয়ালার অন্যতম কর্ণধার জ্যোতির্ময়ী সাহা কথা বললেন ‘TheBengalStory’এর সঙ্গে।

প্রথম লকডাউনে কোম্পানি দাদার মাইনে কমিয়ে অর্ধেক করে। এদিকে বাবার মুদিখানার দোকানও সেভাবে চলছে না। পয়সার অভাবে তাঁর ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের পড়া বন্ধ হতে চলেছে। এমন সময় যাদবপুরের প্রাক্তনী দাদা দেবজ্যোতি সাহার মাথায় প্রথম আসে ফুচকার কথা! জানান জ্যোতির্ময়ী। দাদার প্রস্তাবে তিনিও রাজি। তবে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের পড়া করে ফুচকা বিক্রি করবে! ছেলে মেয়ের মুখে এমন কথা শোনার পর কার্যত বাজ পড়েছিল সাহা বাড়িতে। মা বাবা পত্রপাঠ প্রস্তাব নাকচ করেন। শুধু নাকচই নয় রীতিমত বকুনি খেতে হয়েছিল ভাইবোনকে। কিন্তু তাঁরা নাছোড়বান্দা। মা রাজি হলেও বাবা রাজি নয়। এক সপ্তাহ লেগেছিল শুধু মা বাবাকে বোঝাতে, বলেন বি-টেকের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী জ্যোতির্ময়ী।

‘ফুচকাWala’ নামটা কীভাবে মাথায় এল? এটা বাবারই দেওয়া। মুচকি হেসে উত্তর দিলেন তিনি। আসলে হয়েছে কী, একদিন বাবা প্রচন্ড রাগারাগি করছেন। আমাদের বকতে বকতে খুব উত্তেজিত হয়ে বললেন, মুদিখানা দোকান চালিয়ে ছেলে মেয়েকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়িয়েছি ফুচকাওয়ালা বানানোর জন্য! ব্যাস সেখান থেকেই দাদা নামটা লুফে নিল। দাদা বলেছিল, যে কারণে এত কথা শুনতে হচ্ছে, সেই ফুচকাওয়ালাই হবে আমাদের দোকানের নাম। জানান জ্যোতির্ময়ী।

কথায় কথায় বললেন, মা বাবা মেনে নিলেও তারপরের জার্নিটা সহজ ছিল না। বন্ধুরাও শুনে অবাক। টেকনো ইন্ডিয়াতে পড়তাম তখন, অনেক বন্ধু আমার ফুচকা বিক্রির কথা শোনার পর আমাকে এড়িয়ে চলতে শুরু করল।

ইঞ্জিনিয়ারিং স্টুডেন্টের ফুচকা বিক্রিটা ভালোভাবে না দেখাই স্বাভাবিক। জ্যোতির্ময়ীর কথায়, আমরা বাধ্য হয়েছিলাম সে সময় ফুচকা বিক্রি করতে। অন্য ব্যবসা করতে গেলে অনেক পুঁজির প্রয়োজন। আমাদের বাড়িতে তখন খারাপ অবস্থা। ফুচকা বিক্রিটাই দেখলাম সবথেকে সহজ রাস্তা। তাই বাবার মুদিখানা দোকানেই শুরু করলাম কাজটা।

বর্তমানে ‘ফুচকাwala’ র দোকানের সাজসজ্জা যে কোনও ঝাঁ চকচকে রেস্তোরাঁকেও টেক্কা দেবে। জানালেন প্রথম দিন তাঁদের দোকানে ১৫ থেকে ২০ জন এসেছিলেন। এখনও প্রথম খদ্দেরকে ভোলেননি। একটি ছেলে দোকানে এসে জিজ্ঞেস করেছিল এখানে কী ফুচকা পাওয়া যায়? ওঁ ভাবতেই পারেনি আমরা ফুচকা বিক্রি করছি। বলেন, জ্যোতির্ময়ী।

এই যে এত রকমের ফুচকা বিক্রি করেন, বাংলাদেশি ফুচকা, কর্ন ফুচকা, এই আইডিয়া কোথা থেকে এলো? বললেন, আমাদের যা খেতে ভালো লাগে তাই ফুচকার সঙ্গে জুড়ে দেওয়ার চেষ্টা করি। নিজেরাই প্রথম ট্রাই করি তারপর ভালো লাগলে সেটা মার্কেটে আনি। সেই সঙ্গে জ্যোতির্ময়ী বললেন, আমাদের পপুলার চিকেন ফুচকা আইটেমটা যেমন মায়ের মস্তিস্কপ্রসূত। আমার আবিষ্কার ধনিয়া ফুচকা। অনলাইন ফুড ডেলিভারি সাইটে এখন ধনিয়া ফুচকা সবথেকে বেশি বিক্রি হওয়ার খাওয়ারের মধ্যে অন্যতম।

পড়াশোনার সঙ্গে এই কাজ সামলাচ্ছেন কীভাবে? দেখুন দাদার সাহায্য ছাড়া এত কিছু সম্ভব নয়। এমনও হয়েছে একটা মেলায় আমরা স্টল দিয়েছি। সেদিনই আমার পরীক্ষা। দাদা দোকান সামলাচ্ছে আর আমি অনলাইনে বি-টেকের থার্ড সেমিস্টারের পরীক্ষা দিচ্ছি দোকানে বসেই। হাসতে হাসতে বলেন জ্যোতির্ময়ী।

ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে পড়তে ফুচকা বিক্রির কথা ভেবেছেন। এরকম একটা ভাবনার জন্য তো যথেষ্ট সাহস লাগে। যারা অন্যরকম কিছু করতে চায়, দশটা পাঁচটার চাকরি করতে আগ্রহী নয়, বা চাকরি পাচ্ছেন না, তাঁদের কী বলবেন? জ্যোতির্ময়ীর উত্তর, দেখুন কাউকে অনুপ্রাণিত করার মত আমরা এমন কিছুই অর্জন করিনি। একপ্রকার বাধ্য হয়েই কাজটা করেছিলাম। তবুও বলব, সমাজ কী ভাববে এই দায়িত্বটা সমাজের উপরে ছেড়ে দিয়ে আমাদের উচিত নিজেদের লক্ষ্য স্থির রেখে কাজ করে যাওয়া।

Comments are closed.