ওলা ক্যাব প্রত্যাখ্যান ও অভিষেক মিশ্রর হিন্দুত্ব

বিশ্ব হিন্দু পরিষদের জনৈক নেতা অভিষেক মিশ্র ওলা ক্যাবের বুকিং বাতিল করেছেন এই ‘কারণ’-এ, ড্রাইভার একজন মুসলমান এবং তিনি কোনও জেহাদিকে তাঁর অর্থ দিতে নারাজ। ঘটনাটি লখনউতে ঘটেছে, দিন কয়েক আগে। অভিষেক শেয়ার ক্যাব বুক করেছিলেন।
অভিষেক মিশ্রের এই ‘আদর্শ’-গত অবস্থান নতুন কিছু নয়। যাঁরা একটু খোঁজখবর রাখেন বা বিশ্ব হিন্দু পরিষদের বিষ পুস্তিকা পড়েছেন, তাঁরা জানেন অভিষেক মিশ্রদের এই রাষ্ট্রবিরোধী অবস্থান অনেক পুরনো।
বছর পনেরো-ষোলো পিছু হেঁটে চিনুভাই প্যাটেলদের প্রচার পুস্তিকা ঘাঁটলে দেখতে পাওয়া যায়, মুসলমানদের অর্থনৈতিক বয়কটই তাঁদের এই দেশ থেকে উচ্ছেদের একমাত্র সমাধান। সঙ্ঘ ও পরিষদের সিদ্ধান্ত হল, মুসলমান দোকানদারদের কাছে কিছু কেনা নিষেধ, ওঁদের কাছে কিছু বিক্রি করা বারণ। তাঁদের হোটেল গ্যারেজ ব্যবহার না করার নির্দেশ; সূচ থেকে সোনা—মুসলমানদের কিছু বেচা বা কেনা যাবে না। মুসলমান নায়ক-নায়িকা আছে, এমন সিনেমা বয়কট করার আজ্ঞা, মুসলমানদের অফিসে কাজ না দেওয়া এবং তাদের অধীনে কাজ না করার নির্দেশ আছে ওই সব প্রচার পুস্তিকায়। উগ্র এই সংগঠনের কথা অনুযায়ী, আঁটোসাঁটো আর্থিক বয়কট মুসলমানদের দমবন্ধ করে দেবে, মেরুদণ্ড ভেঙে দেবে, দেশের কোনও প্রান্তে ওঁরা বাঁচতে সক্ষম হবেন না। শেষে হুমকি, এই প্রচার পুস্তিকা দশ কপি ছাপিয়ে বিলি করুন, না করলে হনুমান ও রামচন্দ্রের অভিশাপ লঙ্ঘনকারীদের উপর পড়বে।
গুজরাত দাঙ্গার সময় তখন। সে সব থিতু হতেই দেশ জুড়ে এই সব ঘৃণা ও বিদ্বেষের বিরুদ্ধে একটা জনরব উঠেছিল বটে, আপত্তিকারীরা ১৫৩ (এ) এবং ১৫৩ (বি) ধারা অনুযায়ী প্রচারকারীদের শাস্তিও চেয়েছিলেন। বলা বাহুল্য, কিছুই হয়নি। পরিষদের মিডিয়া কর্মকর্তা অভিষেক মিশ্র সেই ভাবধারার মানুষ, সুতরাং তিনি এর বাইরে কিছু বলবেন না। ঠিক কী কী বলেছেন মাননীয় মুসলমানবিদ্বেষী মিশ্র মহাশয়? চলুন দেখে নিই আর এক বার।
তাঁর টাকা তিনি মুসলমান জেহাদিদের দেবেন না। যে ড্রাইভারকে তিনি জেহাদি ঠাওরেছেন, সেই মাসুদ আসলাম উত্তরপ্রদেশের রাজধানী লখনউতে গাড়ি চালান। লখনউয়ের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী হলেন যোগী আদিত্যনাথ। একজন জেহাদিকে একটি রাজ্যের রাজধানীতে কীভাবে গাড়ি চালানোর অনুমতি যোগী দিলেন, সেই প্রশ্ন কিন্তু ওঠে। কিন্তু পরিষদ বা সঙ্ঘ যুক্তির ধার দিয়ে যায় না। লখনউ শহরকে ঢেলে সাজিয়েছিলেন নিশাপুরি রাজবংশের নবাব আসফ-উদ-দৌলা। তার আগে আওয়াধ রাজ্যের রাজধানী ছিল ফৈজাবাদ। অষ্টাদশ শতকে ওই নবাব পাঁচ লক্ষ টাকা খরচ করে লখনউতে দোল-উৎসব পালন করতেন। মুসলমান মাত্রই যদি জেহাদি হয়, তবে এই ঐতিহাসিক শহরের নবরূপকার আসফ-উদ-দৌলাও একজন জেহাদি। সেই জেহাদির বানানো শহরে বাস করছেন যোগী আদিত্যনাথ থেকে অভিষেক শর্মা। শর্মাজির বয়স খুব অল্প নয়। মোদিজির সঙ্গে করমর্দনের ছবিতে তাঁকে দেখা গিয়েছে। আর এক ‘জেহাদি’ এপিজে আবদুল কালাম ভারতের রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন অভিষেক মিশ্র ও তাঁর গুরুভাইয়েরা দেশের নাগরিকত্ব বজায় রেখে ওই ‘জেহাদি’-কে ‘সম্মান’ জানিয়েছিলেন। এ সব অবশ্য যুক্তির কথা। ওঁরা তো যুক্তি মানেন না, নইলে গাড়িতেই চাপতেন না, কারণ গাড়ির জ্বালানি আসে ‘জেহাদি’-দের দেশ আরব মুলুক থেকে।
অভিষেক মিশ্র-র আরও ‘যুক্তি’ আছে। তিনি বলেছেন, ওই মুসলমান জেহাদিরা কাঠুয়ার ধর্ষণকাণ্ডে হিন্দুদের ও হিন্দু দেবতাদের কালিমালিপ্ত করেছে। মন্দিরে যারা ধর্ষণ করল একটি আট বছরের বালিকাকে, তারা ধর্মকে কালিমালিপ্ত করল না, করল কারা? না, যাঁরা ওই ধর্ষণের বিরুদ্ধে, হত্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানালেন তাঁরা। এই হল সংঘের যুক্তিশৃঙ্খলা! কাঠুয়ার ধর্ষণকাণ্ডে যারা অভিযুক্ত এবং সেই অভিযুক্ত ধর্ষকদের পক্ষে যে সব বিজেপি নেতা মিছিল করেছিলেন, তাঁরা অভিষেকের টুইট অনুসরণ করেন কিনা জানা নেই, যদিও দেখা যাচ্ছে বহু বিজেপি নেতাই অভিষেকের টুইট-অনুসরণকারী। ধর্ষণপ্রবণ এই রাষ্ট্রে কাঠুয়ার ধর্ষণকাণ্ড একটি ব্যতিক্রমী ঘটনা। হিন্দু-মুসলমান বহু মানুষ সারা দেশ জুড়ে এর প্রতিবাদ করেছেন। বালিকাটি মুসলমান বলে নয়। একই সঙ্গে প্রতিবাদ করা হয়েছে উন্নাওয়ের ধর্ষণেরও, সেখানে মেয়েটি হিন্দু। যে আট জন মহিলা অতুল জোহরির বিরুদ্ধে মুখ খুলেছেন তাঁরাও হিন্দু। বর্ণিকা কুণ্ডূও তাই। সমস্যা হল, এই সব ক্ষেত্রে অভিষেক মিশ্রদের দল ও দলের মিডিয়া সেল অভিযুক্তের পাশে। এমনকি তাঁরা যে হিন্দুত্বে বিশ্বাস করেন, তা হল সাভারকরের রাজনৈতিক হিন্দুত্ব, যেখানে সাভারকর ধর্ষণকে কিছু ক্ষেত্রে বৈধতা দিয়েছেন। এই হিন্দুত্ব ভারতের আমজনতার শান্তির ও সহবস্থানের হিন্দুত্ব নয়, তা হল সংঘের ঘৃণাপ্রসূত হিন্দুত্ব। ওলা ক্যাবের ড্রাইভার মুসলমান জেহাদি, এই অজুহাত তাই নেহাত ছেঁদো নয়—এর ব্যাপকতা ও গভীরতার তল নেই, যেমন অতল ঘৃণা ও বিদ্বেষের সমুদ্র।
কয়েক দিন আগে একটি গল্প শুনেছিলাম। এক ‘ভদ্রলোক’ প্লেনে চেপে কোথাও যাচ্ছিলেন। মাঝপথে তেষ্টা পাওয়ায় তিনি একজন এয়ার হস্টেসের কাছে ‘পানি’ চান। জল দিতে এলে লোকটি দেখেন, জলপ্রদানকারীর বুকে লেখা ‘ফতিমা’। তিনি জল পান না করার সিদ্ধান্ত নিলেন। কিন্তু তেষ্টা তো কথা শোনে না। ফ্লোর ম্যানেজারকে পাশে পেয়ে তৃষ্ণার্ত লোকটি পুনরায় জল চাইলেন। ম্যানেজার বললেন, “ফতিমা, জরা ইধার আইয়ে, পানি দিজিয়ে ইনকো।”
তৃষ্ণার্তের তৃষ্ণা নিবারণ হয়েছিল কিনা, সে খবর আর নেওয়া হয়নি।

(মতামত লেখকের ব্যক্তিগত)

Leave A Reply

Your email address will not be published.