মাওবাদী ঘনিষ্ঠতার অভিযোগে গ্রেফতার ভারভারা রাওসহ পাঁচ মানবাধিকার কর্মীকে গৃহবন্দি রাখার নির্দেশ দিল সুপ্রিম কোর্ট

পুণে পুলিশের হাতে পাঁচ সমাজকর্মীর গ্রেফতারের ঘটনায় মহারাষ্ট্র সরকারের জবাব তলব করল সুপ্রিম কোর্ট। বুধবারের মধ্যে তাদের জবাব জমা দিতে বলা হয়েছে। পাশাপাশি আগামী ৬ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ধৃত সমাজকর্মীদের গৃহবন্দি রাখারও নির্দেশ দিয়েছে দেশের শীর্ষ আদালত। বুধবার বিকেলে দেশের প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বেঞ্চে এই মামলার শুনানি হয়। এই গ্রেফতারিকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে শীর্ষ আদালতে আবেদন করেছিলেন ঐতিহাসিক রোমিলো থাপারসহ বেশ কয়েকজন বুদ্ধিজীবী।
প্রধানমন্ত্রীকে হত্যার ষড়যন্ত্র এবং মাওবাদীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার অভিযোগে মঙ্গলবার দেশের একাধিক শহরে অভিযান চালিয়ে মানবাধিকার কর্মী, কবি ও অধ্যাপক ভারভারা রাওসহ পাঁচ বিশিষ্ট সমাজকর্মীকে গ্রেফতারের ঘটনায় দেশজোড়া ধিক্কারের মুখে পড়তে হয়েছে পুণে পুলিশকে। যেভাবে কোনও ওয়ারেন্ট ছাড়াই দেশের বিশিষ্ট মানবাধিকার কর্মী, সাংবাদিক, আইনজীবী, অধ্যাপকদের বাড়িতে তল্লাশি ও তাঁদের গ্রেফতার করা হয়েছে এবং তাঁদের বিরুদ্ধে ইউএপিএ ধারায় মামলা রুজু করা হয়েছে, দেশের তাবড় বুদ্ধিজীবী মহল তার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে। প্রতিবাদীদের একটা বড় অংশের মতে এটা অঘোষিত জরুরি অবস্থার শামিল এবং প্রতিবাদী ও বিরুদ্ধ মত দমন করার জন্য রাষ্ট্রীয় ষড়যন্ত্র। এই ঘটনায় স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে জাতীয় মানবাধিকার কমিশন রিপোর্ট তলব করেছে মহারাষ্ট্র পুলিশের ডিজির কাছে। সূত্রের খবর, কমিশন মনে করছে, যে কায়দায় ও যেভাবে এই বিশিষ্ট ব্যক্তিদের বাড়িতে তল্লাশি চালানো ও তাঁদের গ্রেফতার করা হয়েছে তাতে মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়ে থাকতে পারে।
ঘটনার তীব্র সমালোচনা করেছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। সংগঠনের ভারতীয় শাখার তরফে এই ঘটনাকে, বেদনাদায়ক ও মানবাধিকারের ক্ষেত্রে বিপদজনক বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
ঐতিহাসিক রোমিলো থাপার ইতিমধ্যেই এই গ্রেফতারির বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন জানিয়েছেন। বিশিষ্ট লেখিকা অরূন্ধতী রায় ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছেন, পুলিশের উচিত যারা গণপ্রহার, প্রকাশ্য দিবালোকে মানুষ খুনের সঙ্গে যুক্ত তাদের গ্রেফতার করা। লেখিকার মতে, ভারত যে কোথায় যাচ্ছে এই ঘটনা তার জ্বলন্ত প্রমাণ। ঐতিহাসিক রামচন্দ্র গুহ বলেছেন, কর্পোরেট চালিত ক্ষমতাসীন সরকার, আদিবাসীদের জমি, বনাঞ্চলের অধিকার ছিনিয়ে নিতে এই সব করছে।
রাজনৈতিক স্তরেও শুরু হয়েছে এই ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ। প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধী। ট্যুইটারে তিনি লিখেছেন, ‘ভারতে শুধু একটি মাত্র এনজিও’র কাজ করার অধিকার আছে, যার নাম আরএসএস। বাকি যারাই অভিযোগ তুলবে তাদের জেলে ভরো, গুলি করো। নতুন ভারতে স্বাগত।’ সিপিএম সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি বলেছেন, এরপরও মোদী সরকারের আসল রূপ চিনতে কি আর কারুর বাকি আছে!
কিন্তু এসবের মাঝে, বয়ানে কিছুটা বদল এসেছে পুণে পুলিশের। মঙ্গলবার গ্রেফতারির পর জানা গিয়েছিল, চলতি বছরের ১ লা জানুয়ারি মহারাষ্ট্রের ভীমা-কোরেগাঁওয়ে দলিত বিজয় দিবস পালন নিয়ে দলিত ও উচ্চবর্ণের মধ্যে যে গন্ডগোল হয়েছিল, যাতে এক জনের প্রাণ যায়, সেই ঘটনায় ইন্ধন ছিল মাওবাদীদের। সেই ঘটনার সূত্র ধরে এবছর জুন মাসে পাঁচ মানবাধিকার কর্মীকে গ্রেফতারও করেছিল পুণে পুলিশ। তখন পুলিশ জানায়, ধৃতদের সঙ্গে যোগ রয়েছে মাওবাদীদের। পুলিশ আরও জানিয়েছিল, তদন্তে নেমে একটি চিঠি পাওয়া গেছে যেখানে দেশের প্রধানমন্ত্রীকে হত্যার ষড়যন্ত্রের কথা উল্লেখ আছে। সেই চিঠিতে কবি ভারভারা রাওয়ের নাম উল্লেখ আছে। তবে সূত্রের খবর, এদিন পুলিশ নাকি আদালতে জানিয়েছে, প্রধানমন্ত্রীকে খুনের চক্রান্তের ওই চিঠিতে ধৃতদের কারও নাম পাওয়া যায়নি।
পুলিশ জানিয়েছে, এই গ্রেফতারির আগে টানা এক সপ্তাহ ধরে নজর রাখা হচ্ছিল এই সমাজকর্মীদের উপর। প্রতিটি খবর দেওয়া হয়েছে মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রীকে। পুলিশের দাবি, ১ জানুয়ারির ঘটনায় সুরেন্দ্র গ্যাডলিং, রোনা উইলসন, সুধীর ধাওয়ালে, সোমা সেন ও মহেশ রাওয়াত নামে যে পাঁচজনকে জুন মাসে গ্রেফতার করা হয়েছিল তাঁদের সঙ্গে মঙ্গলবার ধৃত এই পাঁচ সমাজকর্মীর যোগ রয়েছে। পুলিশের আরও দাবি, দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়াদের নিয়ে মাওবাদীপন্থী একটি দল গড়ারও প্রচেষ্টা চালাচ্ছিলেন তাঁরা। পড়ুয়ারা নাকি জেরায় সে কথা জানিয়েছে। এই প্রচেষ্টার মূলে ছিলেন ভারভারা রাও।
এই গ্রেফতারির প্রতিবাদে বুধবার দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিক্ষোভ দেখান বিভিন্ন মানবাধিকার কর্মী ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। ধৃতদের বিরুদ্ধে কেন ইউএপিএর মত আইনি ধারা প্রয়োগ করা হল তা নিয়েও উঠছে প্রশ্ন। মূলত সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপের ক্ষেত্রে এই ধারা প্রয়োগ করা হয়ে থাকে। এই ধারায় কোনও ওয়ারেন্ট ছাড়াই যে কোনও ব্যক্তির বাড়িতে তল্লাশি ও জিনিস বাজেয়াপ্ত করা যেতে পারে। এই ধারায় ধৃত ব্যক্তি জামিনের আবেদন করতে পারেন না। অন্যান্য ক্ষেত্রে ৯০ দিন হলেও এক্ষেত্রে ১৮০ দিন সময় থাকে চার্জশিট জমা দেওয়ার। সরকার রাষ্ট্রবিরোধী মনে করলে এই ধারায় যে কোনও সময় কাউকে গ্রেফতার করতে পারে।

Comments are closed.