উচ্চমাধ্যমিকে ৯১%: রাজনীতি ও পড়াশোনার বিরোধ নেই, বাঁকুড়ার অরিত্র বলছেন, ‘বামপন্থার বিকল্প নেই, স্বপ্ন দেখি ইঞ্জিনিয়ার ও শ্রমিকের বেতন সমান হবে

ছাত্রাবস্থায় রাজনীতি উচিত নয়, তাতে পড়াশোনার ক্ষতি হয়, এমন প্রচলিত ধ্যান-ধারনাকে ভুল প্রমাণ করে ছাড়লেন বাঁকুড়া জেলা স্কুলের ছাত্র অরিত্র বিশ্বাস। উচ্চমাধ্যমিকে ৯১ শতাংশ নম্বর পাওয়া অরিত্রের আস্থা বামপন্থায়। ভবিষ্যতে অঙ্ক বা পদার্থবিদ্যায় গবেষণার পাশাপাশি তাঁর লক্ষ্য দেশের রাজনীতিতে সক্রিয় অংশ নেওয়া।
ছাত্ররাজনীতি উচিত নাকি অনুচিত, এই বিতর্ক বহু পুরনো। অনেকেরই মত, স্কুল-কলেজ হল শুধু শিক্ষার জায়গা। সেখানে রাজনীতি করলে আখেরে ছাত্রজীবনেরই ক্ষতি হয়। আজকালকার মেধাবীদের রাজনীতি নিয়ে প্রশ্ন করা হলেও তাঁদের বেশিরভাগের সাধারণ প্রতিক্রিয়া ‘রাজনীতির কিছুই বুঝি না’। এই গতানুগতিক চিন্তাধারার উল্টোদিকে অবস্থান বাঁকুড়ার বাসিন্দা অরিত্র বিশ্বাসের। লাল পতাকা হাতে মিটিং-মিছিল করেও, কৃষক-শ্রমিকের দাবি নিয়ে রাস্তায় নেমেও উচ্চমাধ্যমিকের রেজাল্টে তিনি দেখালেন, পড়াশোনা ও রাজনীতির মধ্যে কোনও বিরোধ নেই। বরং শিক্ষিত ও মেধাবীদের হাতেই দেশের হাল থাকা উচিত।
বাঁকুড়া জেলা স্কুলের ছাত্র অরিত্র বিশ্বাসের উচ্চমাধ্যমিকে প্রাপ্ত নম্বর ৫৫৮। অঙ্কে পেয়েছেন ৯২, পদার্থবিদ্যা ও রসায়নে ৯৩, বাংলায় ৮৭ এবং ইংরেজিতে ৯১। ৯১ শতাংশের বেশি নম্বর পাওয়া এই ছাত্রের ইচ্ছে পদার্থবিদ্যা বা গণিত নিয়ে গবেষণা করা। প্রতিদিন নিয়মিত আট ঘণ্টা পড়াশোনা করতেন।

অরিত্রর রাজনীতিতে সক্রিয় অংশ নেওয়ার ভাবনা সেই বারো-তেরো বছর বয়স থেকে। তখন থেকেই মার্ক্সবাদ, দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ নিয়ে পড়াশোনা শুরু তাঁর।
কীভাবে এত ছোট বয়স থেকে রাজনীতিতে আগ্রহ? অরিত্রর কথায়, ‘আমার দাদু, মামারা চিরকাল লালঝাণ্ডা ও বামপন্থায় বিশ্বাসী। তাঁদের আলোচনা, গল্প শুনে আমারও রাজনীতিতে আগ্রহ জন্মায়। তাঁরাই আমার অনুপ্রেরণা। কিন্তু কারও মুখে শুনে কোনও মতাদর্শে অন্ধবিশ্বাস করতেও ঘোর আপত্তি বাঁকুড়া জিলা স্কুলের এই ছাত্রটির। তাই খুব ছোট বয়সেই তাঁর পড়ার টেবিলে পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি জায়গা করে নিয়েছছিল দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ, রাষ্ট্রবিপ্লবের বইপত্র। তবে রাজনীতিতে এই অদম্য আগ্রহ কখনও প্রথাগত পড়াশোনাতে ছাপ ফেলতে পারেনি। অরিত্রর কথায়, ‘আমার প্রিয় বিষয় অঙ্ক আর দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদে তো পার্থক্য নেই। বরং সম্পর্ক আছে।’ তবে তিনি এও জানেন, ভবিষ্যতে অঙ্ক বা পদার্থবিদ্যা নিয়ে পড়াশোনা এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে উচ্চমাধ্যমিকে ভালো ফল করাটাও জরুরি। তাই একাদশ শ্রেণি থেকে রাজনৈতিক পড়াশোনা মুলতবি রেখে ডুব দিয়েছিলেন ম্যাট্রিক্স, ডিফারেন্সিয়াল ক্যালকুলাস, পদার্থের দ্বৈত সত্তা ও বিকিরন ইত্যাদিতে। পরীক্ষা শেষ হতেই আবার শুরু করেছেন রাজনৈতিক পড়াশোনা।
স্কুল ছাড়িয়ে কলেজের আঙিনায় আসছেন এবার, কলেজ ইউনিয়ন, ছাত্ররাজনীতির বৃহত্তর ক্ষেত্র। সেখানে কী ভূমিকা নিতে চান? অরিত্রের উত্তর, আগে থেকে এসব ভাবছি না। তবে রাজনীতি নিয়ে আরও পড়াশোনা দরকার। সঠিক ও সুনির্দিষ্ট জ্ঞান ছাড়া কলেজ রাজনীতিতে গা ভাসিয়ে দিতে ঘোর আপত্তি আঠারো বছরের অরিত্রর। তবে এটাও ঠিক, পরবর্তীতে গবেষণার পাশাপাশি রাজনীতিও সমান গুরুত্ব পাবে আমার জীবনে, বলেন অরিত্র। তাঁর কথায়, জমিদারি প্রথা উঠে গেলেও এখনও এই সমাজে উপেক্ষিত কৃষক ও শ্রমিক শ্রেণি। একজন ইঞ্জিনিয়র বা চিকিৎসক তাঁর জ্ঞান দিয়ে দেশ ও দশের সেবা করেন। একজন কৃষক বা শ্রমিকও তো আট ঘণ্টা কায়িক শ্রম করেন। এরা সবাই সমাজের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। তাহলে একজন কৃষক ও একজন ইঞ্জিনিয়রের পারিশ্রমিকের কেন আকাশ-পাতাল ফারাক হয়? প্রশ্ন অরিত্রর। একজন কৃষক ও শ্রমিকের ঘরেও মাসের শেষে যেন ২৫ হাজার টাকা ঢোকে, সেই সমাজব্যবস্থা, সেই সাম্য দেখতে চাই আমি। আর তা সম্ভব হবে যখন মেধাবী ও শিক্ষিতদের হাতেই থাকবে দেশ চালানোর হাল, মন্তব্য অরিত্রর। দেশজুড়ে বেকারত্বের এই হাল তাঁকে ভীষণ ভাবায়। রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাকে যে বৃহত্তর বেসরকারিকরণের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার তাতে প্রবল আপত্তি অরিত্রর। তাঁর কথায়, ঠিক উল্টোটা হওয়া উচিত, আরও বেশি সংস্থাকে সরকারিকরণ করে নাগরিকের কর্মসংস্থান তৈরি করা প্রয়োজন। সেই লক্ষ্য ও দিশাতেই এগোবে অরিত্রের ভবিষ্যতের পদক্ষেপ।
বাড়িতে মা, দিদা ও বোনকে নিয়ে থাকেন অরিত্র। বাবা সেনাবাহিনীতে কর্মরত। এখন তাঁর পোস্টিং লখনউতে। ছেলের পরীক্ষার ফলে তিনি ভীষণ খুশি। তবে অঙ্কে একশোয় একশো পাওয়া উচিত ছিল ছেলের, আক্ষেপ অরিত্রের বাবার। সে যাই হোক, এখন অনেক পথ চলা বাকি। প্রচুর পড়াশোনা করতে হবে, মন্তব্য বাঁকুড়ার বামপন্থী মেধাবী ছাত্রটির।

Comments are closed.