আজও ব্রিটিশদের ব্যবহার করা জিনিসের নিলাম হয় দ্য রাসেল এক্সচেঞ্জে, জানেন কি কলকাতায় একমাত্র চালু অকশান সেন্টারের ইতিহাস?

কখনও নিলাম দেখেছেন? হ্যাঁ, দেখেছেন বই কী! আসলে নিলাম বা অকশান বলতে তো আমরা হালফিলে ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগের কর্পোরেট অকশান বা নিলামের সঙ্গে বেশি পরিচিত। কিন্তু মশাই, এই খাস কলকাতার বুকে দাঁড়িয়ে লাইভ অকশান দেখার অভিজ্ঞতাটা কি আছে? হ্যাঁ, কলকাতায় এমন একটি দোকান আছে, যেখানে এখনও নিয়ম করে প্রতি সপ্তাহে দু’দিন পুরনো জিনিসের নিলাম হয়। হ্যাঁ, নিলাম মানে অকশান।
‘auction’ শব্দটির উৎপত্তি ল্যাটিন শব্দ ‘auctus’ থেকে, ইংরাজিতে যার অর্থ ‘increasing’।
এবার একটু না হয় ইতিহাসের পাতা ঘাঁটা যাক। যত দূর জানা যায়, সারা পৃথিবীর মধ্যে প্রথমবাবের মতো নিলাম হয়েছিল খ্রীষ্ট পূর্ব ৫০০ অব্দে, গ্রীসে। আর সেখানে নিলাম করা হত নারীদের। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নিলামের সংজ্ঞাও পরিবর্তিত হয়েছে। সালটা ১৬৬৪, প্রথম কোনও অকশান হাউস স্থাপিত হল, যার নাম স্টকহোম অকশান হাউস। ১৭৪৪ সালে সোথবি হাউস আর ১৭৬৬ তে প্রতিষ্ঠা হল ক্রিস্টি হাউস

আমাদের খাস কলকাতার বুকে মোটামুটিভাবে ব্রিটিশ আমলে উনবিংশ শতক থেকে একের পর নিলামের দোকান খুলতে থাকল। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল ম্যাকেনজি অ্যান্ড লায়ল কোম্পানি। তথ্য বলছে, এখানে নাকি একবার আফিমের নিলামও হয়েছিল। তাছাড়া অন্যান্য দোকানগুলো হল ডালহৌসি এক্সচেঞ্জ, চৌরঙ্গি সেলস ব্যুরো, ডি অ্যালবার্ট অ্যান্ড কোম্পানি, দ্য রাসেল এক্সচেঞ্জ, স্টেইনার অ্যান্ড কোম্পানি ইত্যাদি। কিন্তু, ১৯৮৫ থেকে ২০০৫ সালের মধ্যে এগুলো সব একের পর এক বন্ধ হয়ে যেতে থাকল। শুধু টিকে থাকল দ্য রাসেল এক্সচেঞ্জ। তবে অন্য দু’একটা দোকানে আজও মাঝে মাঝে নিলামের আসর বসে। কিন্তু নিয়মিত নয়।

এই দ্য রাসেল এক্সচেঞ্জই এখনও পর্যন্ত সেই দিনের আভিজাত্য টিকিয়ে রেখেছে। এদের নিয়ে তো একটা গোটা সিনেমা করে ফেলেছিলেন এডওয়ার্ড ওলস (Edward Owles), যার নাম ‘The Auction House: A Tale of Two Brothers (2014)’। পার্ক স্ট্রিট থেকে রাসেল স্ট্রিটে প্রবেশ করে কিছুটা হাঁটলেই দেখতে পাবেন এই দোকান। শুরুটা হয়েছিল ১৯৪০ সালে, যা এখনও রমরমিয়ে চলছে।

‘আমার বাবার নাম আবদুল মাজেদ, তিনিই এই দোকানের প্রতিষ্ঠাতা। ১৯৭০ সালের মাঝামাঝি থেকে আমি এখানে আসতে শুরু করি। প্রথম থেকেই নিলামের সময় নিলামদার (অকশনার) থাকতাম আমি, আমার বয়স তখন ১৯–২০’, বললেন আরশাদ সেলিম। দ্য রাসেল এক্সচেঞ্জের বর্তমান কর্ণধার। আরশাদ বললেন, ‘সেই সময়ের নিরিখে গোটা ভারতবর্ষে আমি ছিলাম সবচেয়ে কমবয়সী অকশনার। আসলে এই নিলাম বিষয়টা আমাদের রক্তে’।
আরশাদ সেলিম তিন ভাই বোনের মধ্যে সব থেকে ছোট। দীর্ঘদিন ধরে তিনিই এই দোকান চালাচ্ছিলেন। দাদা আনোয়ার সেলিম বছর দশেক আগে বিদেশ থেকে কলকাতায় এসে ভাইয়ের সঙ্গে এই দোকান দেখছেন। তাঁদের আসল উদ্দেশ্য, পরিবারের এই লেগাসি বয়ে নিয়ে চলা। মূলত, ব্রিটিশরা যখন ভারত ছেড়ে চলে যেতে লাগল তখন তাদের ব্যবহৃত জিনিসপত্র বিক্রি করতে থাকল এবং এই সমস্ত কিছু বিক্রি করার সবচেয়ে ভাল উপায় ছিল নিলাম করা। আর সেই সূত্রেই নিলামের দোকানগুলোর আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল। প্রতি বৃহস্পতিবার দ্য রাসেল এক্সচেঞ্জে নিলাম হয়, তবে সেদিন নিলামটা শুধু জামা-কাপড়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। নিলামের আসল দিন হল রবিবার, যেদিন সব কিছুর নিলাম হয়। সব কিছু বলতে, সব কিছু। মোজা থেকে শুরু করে আসবাবপত্র পর্যন্ত। নিলামের আগের দিন, শনিবার হল ‘শো ডে’। মানে, রবিবার যা যা নিলাম হবে শনিবার সেগুলো দোকানে সাজানো হয়। আপনি চাইলে পরখ করে দেখে নিতেও পারেন, সেই মতোই পরের দিন না হয় দর হাঁকলেন।

আরশাদবাবুর নিলামের অভিজ্ঞতার ভাণ্ডারটি বেশ পরিপূর্ণ। তিনি জানালেন, ‘একদিন একটা বিদেশি কাচের বোতলের নিলাম হয়েছিল। আমার বয়স তখন বড়জোড় ১৯ হবে। নিলামে যে দুজনের মধ্যে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই চলছিল, তাদের মধ্যে একজন হলেন ব্রিটিশ পুরষ আর অন্যজন হলেন একজন রাজস্থানের গৃহবধু। ব্রিটিশ ভদ্রলোক চেয়েছিলেন, এই বোতলটিকে সুরা রাখার পাত্র হিসেবে ব্যবহার করবেন। অন্যদিকে, রাজস্থানের গৃহবধূর ভাবনা ছিল, সেটিতে রান্নাঘরে তেল রাখলে বেশ ভালো মানাবে। শেষমেশ অবশ্য ওই গৃহবধূর সঙ্গে রাজস্থানে পাড়ি দিয়েছিল ওই বহু চর্চিত গ্লাস কন্টেনারটি’। আরশাদ সেলিম অকশানিয়ার হিসাবে ব্রিটিশ হাই কমিশনেও গিয়েছিলেন নিলাম পরিচালনা করার জন্য। বললেন, ‘মোটামুটি ১৯৭০ সাল থেকে কলকাতায় ব্রিটিশদের ব্যবহার করা জিনিস নিলাম হতে শুরু করে। একটা ব্যবহার করা টুথ ব্রাশও নিলামে ওঠে, যেটা শেষ পর্যন্ত বিক্রি হয়েছিল ২৫০ টাকায়। না, ব্রাশটির কোনও বিশেষ গুণ ছিল না। আসলে বিষয়টা একটা রেষারেষির জায়গায় চলে গিয়েছিল।’ আর নিলামের দিন যাঁরা জিনিস কিনতে হাজির হন, সেখানে দাম নির্ধারনের ক্ষেত্রে এই রেষারেষির ব্যাপারটাও মাথায় রাখতে হয় নিলামদারকে।
‘একজন ভাল নিলামদার হতে গেলে সব সময় নিলামের বস্তুটির মূল্য যাচাই করার ক্ষমতা থাকা চাই, আর আমরা এটাই প্রায় বছর ৮০ ধরে করে আসছি। শুধু মানুষের বিশ্বাস আমাদের এই ব্যবসা টিকে থাকার অন্যতম কারণ,’ বললেন ষাটোর্ধ আরশাদ সেলিম। তাঁর সঙ্গে কথায় কথায় এরকম অনেক গল্প উঠে এল। একদিন নাকি যাদবপুরের এক বাসিন্দা কিছু বই এই দোকানে দিয়ে গিয়েছিলেন নিলাম করার জন্য। সেই বইয়ের মধ্যে থেকে একটি বই আলাদা করে রেখেছিলেন আরশাদ। বাকি বইগুলো মাত্র ২০ টাকায় বিক্রি হয়, আর ওই বইটা বিক্রি হয়েছিল ২০ হাজারে! আসলে এখানেই একজন নিলামদারের অভিজ্ঞতা কাজ করে। আরশাদ সেলিম বুঝতে পেরেছিলেন, ওই বইটার গুরত্ব কী।

এই দোকানে কে আসেননি? সত্যজিৎ রায় তো বহুবার এসেছেন এখানে, পরবর্তীকালে তাঁর ছেলে সন্দীপ রায়ও এসেছেন। মূলত এনারা আসতেন সিনেমার জন্য পুরনো আসবাবপত্র দেখতে। দ্য রাসেল এক্সচেঞ্জ সিনেমার সেটে ব্যবহার করার জন্য আসবাব ভাড়াও দেয়। কলকাতা, মুম্বইয়ের বহু সিনেমার জন্য প্রযোজকরা এনাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। চোখের বালি সিনেমায় ব্যবহৃত বেশিরভাগ আসবাব দ্য রাসেল এক্সচেঞ্জ থেকেই গিয়েছিল। শর্মিলা ঠাকুর স্বয়ং এখানে উপস্থিত হয়েছেন, গণেশ পাইন বহুবার এসেছেন। বাঁকুড়ার জমিদার কে কে দত্ত জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এখানে আসতেন। একাধিক আসবাব কিনেছেন, যার সংখ্যা ১০০ র কাছাকাছি। বার্ধক্য তাঁকে কখনই হার মানাতে পারেনি।

দুই ভাইয়ের সঙ্গে দোকানে নিয়মিত আসেন বড় দিদি সরফরাজ বেগম শামসি। বললেন, ‘আসলে এটা একটা নেশার মত। নিলামের দিন এমন অনেকে আসেন, যাঁরা কিছু কেনার জন্য নয়, শুধু দেখতে আসেন। আমিও প্রতি রবিবার দোকানে আসি।’ বেগম সাহেবা সারা ভারতবর্ষের মধ্যে সম্ভবত একমাত্র মহিলা নিলামদার। তিনি নিলাম পরিচালনা করেন রবিবার। ‘আমি ১০ বছর হল এই নিলাম পরিচালনা করছি, তার আগে কলকাতার বহু স্কুলে শিক্ষকতা করেছি। তখন আমার ছোট ভাই আরশাদ এখানে নিলামে পরিচালনা করত, এখন আমি আর ভাই মিলে করি।’ আর নতুন প্রজন্ম কি আসে এখানে? সরফরাজ বেগম শামসির অকপট স্বীকারোক্তি, ‘নতুন প্রজন্মের মধ্যে এই ব্যাপারটা নেই। কিন্তু যাঁরা বাবা, ঠাকুরদার হাত ধরে কোনও এক কালে এখানে এসেছেন, তাঁরা কিন্তু এখনও আসেন। আসলে এটা যে একটা নেশার মতো।’
কিন্তু আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে এই নিলাম হাউস কি সত্যিই প্রাসঙ্গিক? এখন তো একাধিক অনলাইন সংস্থা রয়েছে, যেখানে যে কেউ পুরনো জিনিস এক মুহূর্তের মধ্যে কিনতে অথবা বিক্রি পারেন। কিন্তু এখানে আসলে আপনার পছন্দের জিনিসটা হাতে ছুঁয়ে দেখতে পারবেন। আর কিছু বিক্রি করতে চাইলে দিয়ে যেতেই পারেন এখানে, যে দামে আপনার জিনিসটি বিক্রি হবে, তার থেকে ২০ শতাংশ দ্য রাসেল এক্সচেঞ্জ রেখে, বাকি টাকা আপনাকে দিয়ে দেবে। আপনাকে শুধু বিশ্বাস করে জিনিসটা দিতে হবে। এই বিশ্বাসের উপর নির্ভর করেই কিন্তু এখনও পর্যন্ত এই নিলামের দোকানটি টিকে রয়েছে।

এত কিছু জানার পর নিশ্চয়ই ভাবছেন, একবার দ্য রাসেল এক্সচেঞ্জে নিলামের অভিজ্ঞতাটা হওয়া প্রয়োজন। যে কোনও রবিবার চলে আসতেই পারেন। কিছু কেনার প্রয়োজন নেই? তাতে কী, নিলামটা না হয় উপভোগই করলেন। একাধিক মানুষ আসেন প্রতি রবিবার, কোলাহলে মেতে থাকে এই দ্য রাসেল এক্সচেঞ্জ। রেষারেষি, উত্তেজনার মধ্যেই কাটে সারাটা দিন। কলকাতা শহরে রয়েছেন এত বছর, অথচ এই নিলামটার সাক্ষী থাকবেন না একবার! নিলাম দেখতে দেখতে কেই বা জানে, চোখে পড়ে যেতেই পারে কোনও পছন্দের জিনিস! তাহলে আর কি, নিলামে অংশ নিন, বিড করুন এবং সবচেয়ে বেশি বিড আপনার হলে জিনিসটার মালিকও হয়ে যেতে পারেন। আর যদি সেই দৌড়ে শরিক হতে না চান, তবেও আপনি সাক্ষী থাকতে পারবেন কলকাতার এমন এক ঐতিহ্যের, যা হবে আপনার জীবনে নতুন অভিজ্ঞতা।

Comments are closed.