ক্ষিতি দা, এভাবে আপনার চলে যাওয়া মানতে পারছি না

ক্ষিতি দার সঙ্গে আমার আলাপ সাংবাদিকতায় আসার অনেক আগে। আমি সাংবাদিকতা শুরু করি ১৯৮৪ সালে। আর ক্ষিতি দাকে আমি চিনি আমার ছেলেবেলা থেকে। ক্ষিতি দা যে বামপন্থী দলের নেতা ছিলেন, ঘটনাচক্রে আমার বাবা, কাকা, দাদাও সেই আরএসপি দলের সঙ্গে যুক্ত। সেই কারণেই ক্ষিতি দার সঙ্গে আমাদের পারিবারিক সম্পর্ক বহু বছরের। আমিও ছাত্রাবস্থায় আরএসপির ছাত্র শাখা পিএসইউ-এর সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছিলাম। তখন থেকেই আমি ক্ষিতি দার ভক্ত। এত ভালো বক্তা ছিলেন যে, বলার নয়। ছাত্র থাকাকালীন ক্ষিতি দার অনেক রাজনৈতিক ক্লাস করেছি। অনেক সময় আমাদের বাড়িতে সেই সব ক্লাস হয়েছে। ক্ষিতি দা আমার মায়ের রান্না খুব ভালোবাসতেন। দলের কাজে আমাদের বাড়িতে এলেই মা বলত, ক্ষিতি, কাজ সাইরা চারডি ভাত খাইয়া যাইও। ক্ষিতি দা এক কথায় খেতে রাজি হয়ে যেতেন।
ক্ষিতি দা তখন পিএসইউ-এর রাজ্য সম্পাদক। ওই সংগঠনের রাজ্য দপ্তর ছিল সূর্য সেন স্ট্রিটে। অফিসের নীচের তলায় একটা চায়ের দোকান ছিল। দারুণ চা বানাতেন সেই দোকানের মালিক। মনে পড়ে, দাদা, দিদির সঙ্গে গেলে পিএসইউ অফিসে সেই চা ছিল বাঁধা। পরে যখন কলকাতার হেয়ার স্কুলে বারো ক্লাসে ভর্তি হই, তখনও ওই চায়ের লোভে পিএসইউ অফিসে ঢুঁ মারতাম। ক্ষিতি দা অফিসে থাকলে অনেক গল্প হত।
পরে সাংবাদিকতায় আসার পর ক্ষিতি দার সঙ্গে যোগাযোগ আরও নিবিড় হয়। যেহেতু ক্ষিতি দা আমাদের একেবারে ছোটবেলা থেকে দেখেছেন, তাই তিনি আমাদের ডাকনামেই ডাকতেন। দলের তরফে বা পরবর্তীকালে মন্ত্রী হওয়ার পর ক্ষিতি দা সাংবাদিক সম্মেলন করলে কখনও কখনও তাঁর মুখ দিয়ে আমার ডাকনামটাই বেড়িয়ে যেত। পরে অবশ্য সেটা সামলে নিতেন। তা নিয়ে সাংবাদিক বৈঠকে মাঝে মাঝে হাসিঠাট্টাও হত। ক্ষিতি দা আমার নাম করে বলতেন, ও তো আমাদের ঘরের ছেলে। তাই ডাকনামটাই বেড়িয়ে যায় মুখ দিয়ে।
এমএলএ হওয়ার পরে বিধানসভায় বিভিন্ন বিষয়ে ক্ষিতি দার বক্তব্য শুনেছি অনেকবার। শুনে মোহিত হয়ে যেতাম। মাঠে ময়দানেও তিনি ছিলেন অসাধারণ বক্তা।
ক্ষিতি দা ছিলেন অত্যন্ত স্পষ্টবক্তা। বামফ্রন্টের বৈঠকে কোনও পদক্ষেপ বা সিদ্ধান্ত আপছন্দ হলে সেটা সিপিএম নেতাদের মুখের উপরেই বলে দিতেন। ২০০৬ সাল থেকে শুরু হওয়া সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম পর্বে নিজের সরকারের বিরুদ্ধে মন্ত্রিসভার সদস্য হয়েও তিনি ছিলেন অন্যতম প্রতিবাদী মুখ। জোর করে জমি কেড়ে নেওয়ার সরকারি সিদ্ধান্ত তিনি মেনে নিতে পারেননি। মন্ত্রিসভার বৈঠকে কিংবা বামফ্রন্টের বৈঠকে ক্ষিতি দা জোরালো প্রতিবাদ করেছিলেন। এমনকি নিজের দলের অন্দরে তিনি প্রস্তাবও দিয়েছিলেন, দরকারে এই ইস্যুতে মন্ত্রিসভা থেকে আরএসপি সদস্যরা বেরিয়ে আসুন। শেষ পর্যন্ত অবশ্য সেই প্রস্তাব আর কার্যকর হয়নি। তবে নন্দীগ্রামে সিপিএমের তথাকথিত সূর্যোদয় অভিযানের প্রতিবাদে তিনি মন্ত্রী পদ থেকে ইস্তফাও দেন। বেশ কয়েক দিন ক্ষিতি দা মহাকরণেও যাননি। পরে দলের নির্দেশে তিনি মহাকরণে যেতে শুরু করেন।
ক্ষিতি দার ব্যবহারও ছিল খুবই অমায়িক। খুব ধীরে ধীরে কথা বলতেন। অবুঝ কাউকে বোঝানোর একটা ঈশ্বরপ্রদত্ত ক্ষমতা ছিল তাঁর। ছাত্র থাকার সময়ও দেখেছি, অনেক কঠিন বিষয়ও তিনি জলের মতো করে বুঝিয়ে দিতেন। ২০১১ সালে রাজ্যে পালা বদলের পরই ক্ষিতি দার স্ত্রী সুনন্দা মুখোপাধ্যায়কে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি রাজ্য মহিলা কমিশনের সভানেত্রী করেন। তা নিয়ে দলের ভিতরে বাইরে ক্ষিতি দাকে অনেক সমালোচনা সহ্য করতে হয়। এ নিয়ে তাঁদের পরিবারেও অশান্তি দেখা দেয়। কিন্তু তার কোনও ছাপ ক্ষিতি দা বাইরে পড়তে দেননি।
গত কয়েক বছর ধরে ভুগছিলেন তিনি। বছর কয়েক আগে তাঁর বাইপাস অপারেশন হয়। সম্প্রতি ভোকাল কর্ডের সমস্যা হচ্ছিল। ফেব্রুয়ারি মাসে বামেদের ব্রিগেড সমাবেশে যখন তিনি ভাষণ দিচ্ছিলেন, মনে হচ্ছিল, তাঁর কষ্ট হচ্ছে। শেষের দিকে কথা বলতে পারছিলেন না, খুব কষ্ট হচ্ছিল। কিন্তু তার জন্য এভাবে চলে যেতে হবে, ক্ষিতি দা? সারা দেশে বামপন্থী রাজনীতির সামনে এখন গভীর সঙ্কট। এই সময় আপনার মতো আদর্শ বাম নেতার বড় দরকার ছিল। বড় অসময়ে চলে গেলেন আপনি। এক মাসও হয়নি, আর এক প্রবাদপ্রতিম কমিউনিস্ট নেতা গুরুদাস দাশগুপ্ত চলে গিয়েছেন। এক মাসের মধ্যেই দুই আদর্শনিষ্ঠ বাম নেতার প্রয়ান বাম আন্দোলনের ক্ষতি করবে।
ক্ষিতি দা, ভালো থাকুন, শান্তিতে ঘুমান আপনি।

 

Comments are closed.