ইন্দিরা গান্ধী প্রবর্তিত এনএসএ কেন দিল্লিতে লাগু করল মোদী সরকার? গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তি পাবেন না বিচার! কী আছে এই আইনে?

রাজধানী দিল্লিতে ৩ মাসের জন্য লাগু হয়েছে ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট (National Security Act) বা এনএসএ। তা নিয়ে সমালোচনায় সরব বিরোধীরা। তাদের বক্তব্য, রাজধানীর বুকে সরকার বিরোধী একের পর এক গণআন্দোলনে দিশেহারা মোদী সরকার আইনের দোহাই দিয়ে তা দমন করতে চায়, তাই কালা কানুন লাগু করা হয়েছে। যদিও কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক একে রুটিন বলে জানিয়েছে। কিন্তু কী আছে এই আইনে, যা নিয়ে সরব বিরোধীরা?
ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট কী?
বিশেষ এই আইনের বলে পুলিশের হাতে চলে আসে বিপুল ক্ষমতা। স্রেফ সন্দেহের বশে কাউকে আটক করতে পারে পুলিশ। এমনকী আটক হওয়া ব্যক্তিকে কী কারণে আটক বা গ্রেফতার করা হল, না জানানো হতে পারে তাও। এই বিশেষ আইনের (National Security Act) ব্যাপক অপব্যবহারের অভিযোগ বহু প্রাচীন। যে অভিযোগ আজও অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক।
কী আছে এনএসএতে?
১. ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের (National Security Act) বলে কোনও রাজ্য কিংবা কেন্দ্রীয় সরকার জাতীয় নিরাপত্তা লঙ্ঘিত হতে পারে এই অভিযোগে কাউকে গ্রেফতার বা আটক করতে পারে।
২. আইন মোতাবেক সরকার গ্রেফতার বা আটক হওয়া ব্যক্তিকে সর্বোচ্চ ১২ মাস বা ১ বছর হাজতবন্দি রাখতে পারে। তারপরও আটক রাখতে হলে নতুন করে প্রমাণ পেশ করতে হবে সরকারকে। সাধারণ ক্ষেত্রে গ্রেফতারের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে পেশ করা বাধ্যতামূলক। তবে
সমস্যার জায়গা কোথায়?
ক. সাধারণভাবে কাউকে গ্রেফতার করা হলে, সেই ব্যক্তি মৌলিক অধিকার থেকে কয়েকটি স্বাধীনতা পেয়ে থাকেন। যেমন, তাঁকে কী কারণে গ্রেফতার করা হয়েছে, তা পুলিশের জানানো বাধ্যতামূলক। পাশাপাশি রয়েছে গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তির জামিনের অধিকার সুনিশ্চিতকরণ।
খ. কিন্তু এই মৌলিক অধিকারের সুবিধাগুলো এনএসএতে গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তি পান না।
গ. সর্বোপরি এই আইনে গ্রেফতারের জন্য কোনও এফআইআর দায়ের করা হয় না।
ঘ. গ্রেফতার হওয়ার পর ৫ দিন ব্যক্তিকে তাঁর গ্রেফতারির কারণ জানানো হয় না। ব্যতিক্রমী ক্ষেত্রে তা বেড়ে ১০ দিন পর্যন্ত হতে পারে। কিন্তু সাধারণ ক্ষেত্রে গ্রেফতারির কারণ জানাতে হয়।
ঙ. এনএসএতে গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তি আইনি সহায়তা পাবেন না।
চ. ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর কাছে এনএসএতে কতজন গ্রেফতার হয়েছে তার কোনও তথ্য থাকে না। ফলে এখনও পর্যন্ত কতজনকে এই আইনে গ্রেফতার করা হয়েছে তার কোনও সঠিক তথ্য নেই।
কবে এল এই আইন?
এই ধরনের আইন বা প্রিভেনটিভ ডিটেনশন আইনের শুরু ব্রিটিশ ভারতে। ১৮১৮ সালের বেঙ্গল রেগুলেশন থ্রি প্রবর্তিত হয়। সেখানে গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তি আইনের সহায়তা পেতেন না। তার এক শতাব্দী বাদে, ১৯১৯ সালে আসে কুখ্যাত রাউলাট আইন। স্বাধীনতার পর ভারত পেল তার প্রথম প্রতিরোধমূলক আটক (প্রিভেনটিভ ডিটেনশন) আইন। ১৯৫০ সালে প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর হাত দিয়ে প্রবর্তিত হয় প্রিভেনটিভ ডিটেনশন অ্যাক্ট। সেই আইনের সঙ্গে বর্তমান এনএসএর মিল খুঁজে পান অনেকে। ১৯৬৯ সালে এই আইন তামাদি হওয়ার পর ১৯৭১ সালে ইন্দিরা গান্ধী জারি করেন মিসা। জনতা পার্টির সরকার এসে সেই আইন বাতিল করে। তারপর ফের ইন্দিরা মসনদে ফিরে আনেন ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট বা আজকের এনএসএ।
ভয়ের কারণ কী?
১. দেশের অধিকাংশ নির্বাচিত সরকারের বিরুদ্ধেই ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের অপব্যবহারের অভিযোগ রয়েছে।
২. জাতীয় নিরাপত্তার পক্ষে আশঙ্কার কারণ হওয়া ব্যক্তিদের শায়েস্তা করতে যে আইনের জন্ম, তা বহু ক্ষেত্রে স্রেফ রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করার সরকারি হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে বলে অভিযোগ মানবাধিকার সংগঠনগুলোর।
৩. মানবাধিকার কর্মীদের অভিযোগ, সঠিকভাবে আইন প্রয়োগের বদলে সরকার এই আইনকে বিচার বহির্ভূত (এক্সস্ট্রা জুডিশিয়াল) অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে আসছে।
রাজধানী দিল্লিতে আগামী ৩ মাস লাগু থাকবে ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট। তারপর ফের নতুন করে পর্যালোচনা হবে। কিন্তু রাজধানীতে নির্বাচনের মরসুমে এই বিশেষ আইন চালু করার যৌক্তিকতা এখনও স্পষ্ট নয়।

Comments are closed.