বেতন-পিএফ নেই, অফিসে জল নেই, বিদ্যুৎ নেই! ডেকান ক্রনিকলের কলকাতার সংবাদকর্মীদের মর্মান্তিক অবস্থা, চিঠি প্রধানমন্ত্রীকে

গত বছর অক্টোবর থেকে বেতন বন্ধ। দীর্ঘ কয়েক বছর জমা পড়েনি পিএফের টাকা। অফিসে কেটে দেওয়া হয়েছে বিদ্যুতের লাইন। নেই খাবার জল। ডেকান ক্রনিকল সংবাদপত্রের কলকাতা ব্যুরো অফিসের কর্মীরা দাঁতে দাঁত চেপে লড়ে যাচ্ছেন, অনন্ত অপেক্ষার লড়াই।
২০০৮ সাল। ক্রিকেট দুনিয়াকে চমকে দিয়ে ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগের আসর বসে ভারতে। গ্ল্যামারের হাজার ওয়াটের স্পটলাইটে বিশ্বের তাবড় ক্রিকেটারদের মহা মিলনক্ষেত্র। দেশের প্রতিটি বড় শহর থেকে একটি করে দল। হায়দরাবাদ থেকে আইপিএলের দল কিনে সেদিন সবাইকে চমকে দিয়েছিল দক্ষিণের সংবাদপত্র সংস্থা ডেকান ক্রনিকল। ১০৭ মিলিয়ন মার্কিন ডলার দিয়ে কেনা দলের নাম হয়েছিল ডেকান চার্জার্স। স্থানীয় তারকা ভিভিএস লক্ষণের সঙ্গে ছিলেন অ্যাডাম গিলক্রিস্ট, রোহিত শর্মা, শাহিদ আফ্রিদির মতো আন্তর্জাতিক মহা তারকারা। তারপর হুসেন সাগরের জলের নাব্যতা কমেছে-বেড়েছে, কেটে গিয়েছে এক দশকেরও বেশি সময়। ডেকান চার্জার্স দলের অস্তিত্ব আজ ইতিহাসের পাতায়। কিন্তু ডেকান ক্রনিকল আজও প্রকাশিত হয়। সেখানেই করানো কালে সামনে এসেছে এক ভয়াবহ ঘটনা।

 

পড়ুন: কীসের ভিত্তিতে ছাঁটাই তালিকা? কেন বন্ধ বেতন? ‘এই সময়’ কর্তৃপক্ষকে আইনি নোটিস সিনিয়র অ্যাসিস্ট্যান্ট এডিটরের

 

ডেকান ক্রনিকলের কলকাতা ব্যুরোতে মোট ১৯ জন কর্মী। গত বছর অক্টোবর থেকে কেউই বেতন পাচ্ছেন না। এহ বাহ্য, চাকরিদাতা কর্মীকে যে কনট্রিব্যুউটরি প্রভিডেন্ড ফান্ড দিতে অঙ্গীকারবদ্ধ, সেখানেও বড়সড় দুর্নীতির অভিযোগ করছেন কলকাতা ব্যুরোর সংবাদকর্মীরা। যেখানে কর্মীদের অবস্থা শোচনীয় বললেও কম বলা হয়।
দীর্ঘদিন ডেকান ক্রনিকলের কলকাতা ব্যুরোয় কর্মরত এক কর্মী জানালেন তাঁর করুণ কাহিনি। বললেন, পকেটের অবস্থা এতই খারাপ যে, অসুস্থ মায়ের জন্য প্রয়োজনীয় ওষুধটুকুও কিনতে পারছি না। ফ্ল্যাটের ভাড়া মেটাতে পারিনি বেশ কয়েকমাস। বাড়িওয়ালা নিত্য ফ্ল্যাট ছাড়ার হুমকি দিচ্ছেন। সমস্যার সুরাহা কীভাবে হবে? উত্তর জানা নেই দমদম ক্যান্টনমেন্ট এলাকার বাসিন্দা বছর পয়তাল্লিশের সংবাদকর্মীর। কিন্তু এর মধ্যেও অফিস আসায় বিরাম নেই। খরচ বাঁচাতে কখনও কখনও পায়ে হেঁটে যতদূর পারছেন যাচ্ছেন।
গত জুলাই মাসে কার্ডিয়াক অ্যারেস্টে মৃত্যু হয় মধ্যমগ্রামের বাসিন্দা ডেকান ক্রনিকল কর্মী অসীম উপাধ্যায়ের। এই মানসিক চাপ সামলাতে না পেরেই তাঁর মৃত্যু হয়েছে বলে দাবি সহকর্মীদের।
কলকাতা ব্যুরোয় কর্মীদের সবাই মোটামুটি ৪৫ থেকে ৫৫ বছরের মধ্যে। সব দেখে হতাশ এক কর্মী বলছেন, সুরাহা হওয়া পর্যন্ত বেঁচে থাকবো তো?
যতবারই বকেয়া বেতনের দাবি করছেন, তত বারই হয় ফোন কেটে যাচ্ছে কিংবা প্রসঙ্গান্তরে চলে যাচ্ছে মালিক পক্ষ, অভিযোগ কলকাতা ব্যুরোর কর্মীদের। মেল করলে মিলছে না উত্তর। একই অবস্থা বেঙ্গালুরু, কেরল, মুম্বইয়ের ডেকান ক্রনিকল কর্মীদের। এই বিষয় নিয়ে তাঁরা আদালতেও গিয়েছেন। কর্মীদের অভিযোগ, আদালতের নির্দেশকেও পরোয়া করছে না কর্তৃপক্ষ। এবার বাধ্য হয়ে ডেকান ক্রনিকলের কলকাতা ব্যুরোর কর্মীরা চিঠি দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে। তাঁদের আশা, প্রধানমন্ত্রী অন্তত এ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করবেন। বকেয়া বেতন পাবেন তাঁরা।

ডেকানের কলকাতার কর্মীরা বলছেন, বেতন নিয়ে সমস্যার সূত্রপাত ২০১৮ সালের গোড়া থেকে। আগে বেতন হোত প্রতি মাসের ৭ তারিখ। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে গত বছরের অক্টোবর থেকে বেতন নেই। তাঁদের বিস্ফোরক অভিযোগ, প্রভিডেন্ড ফান্ডের টাকা ৩০-৪০ মাস ধরে জমা পড়ছে না। অথচ যখন শেষ বেতন হয়েছিল, তখন সেই বাবদ কর্মীদের বেতন থেকে টাকা কাটা হয়েছিল। তাহলে এত মাস ধরে টাকা কোথায় গচ্ছিত হচ্ছে? এটা কি ফৌজদারি অপরাধের আওতায় পড়ে না? প্রশ্ন করছেন তাঁরা।

 

পড়ুন: কেন আনন্দবাজারে বেতন ১ এর বদলে ৪ তারিখ? প্রশ্ন, সংশয়, জল্পনা কর্মীদের মধ্যে

 

বেতন বন্ধ দীর্ঘদিন। এই পরিস্থিতিতে, যা হওয়ার কথা ছিল অবসরের কোরামিন, সেই প্রভিডেন্ড ফান্ডে হাত দিতে হয়েছে কর্মীদের। যে তহবিলে টাকা দেওয়া নিয়ে ডেকান ক্রনিকল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে বিরাট দুর্নীতির অভিযোগ করছেন তাঁরা।
কর্মীরা বলছেন, গত বছর ডিসেম্বর মাসে তাদের ১৭ জন কর্মীকে বদলির নোটিস দেয় হায়দরাবাদের ডেকান কর্তৃপক্ষ। বেতন না হওয়ায় ব্যুরোর ১৪ জনই বদলি নিতে আপত্তি করেন। কিন্তু একজন সংবাদকর্মী করিমনগরে বদলি নেন। বিজয়ওয়াড়ায় যে ২ জনকে বদলি করা হয়েছিল, তা তাঁরা মেনে নেন এবং নতুন কর্মস্থলে কাজে যোগ দেন। আশা একটাই, বকেয়া বেতন মিলবে। কিন্তু কলকাতা ব্যুরোর কর্মী করিমনগরে যোগ দেওয়ার মাসখানেকের মধ্যেই ওই সংস্করণই তুলে দেয় ডেকান কর্তৃপক্ষ। একইভাবে ঝাঁপ বন্ধ হয় ডেকান ক্রনিকলের মুম্বই ব্যুরোরও।
ডেকানের কলকাতা ব্যুরোর এক কর্মী বলছেন, এরই মধ্যে এ বছর মে-জুন মাসে হঠাৎ হায়দরাবাদের হেড অফিস থেকে জানানো হয়, লকডাউনের কারণে ব্যবসায় লোকসান হচ্ছে, তাই আগামী অগাস্ট থেকে বেতনের অর্ধেক কেটে নেওয়া হবে। সেই কর্মীর মতে বেতনই তো পাচ্ছি না, এর মধ্যে আবার বেতন অর্ধেকের বিজ্ঞপ্তি! নিষ্ঠুর রসিকতা আর কি।
তাঁরা বলছিলেন, গোটা দেশেই ডেকান ক্রনিকল তার কর্মীদের সঙ্গে এই ব্যবহার করে চলেছে। কোথাও বেতন বাকি ৩ মাস, আবার কোথাও বছর ঘুরতে চলল, যেমন কলকাতা। পেটের তাগিদে বেতনহীন ক্রনিকল কর্মীরা কিছু জায়গায় একশো দিনের কাজের প্রকল্পে নাম লিখিয়ে চাষের কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন বলেও জানাচ্ছেন তাঁরা।

 

পড়ুন: মিডিয়ায় চলছে লাগাতার ছাঁটাই, সত্যিই কি মিডিয়া সংকটে, নাকি পরিস্থিতির সুযোগ নিচ্ছে মালিক পক্ষ?

 

সংবাদকর্মীদের ইউনিয়ন কর্মীদের পাশে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু ইউনিয়নের গতি প্রকৃতিতে খুব একটা ভরসা পাচ্ছেন না ভুক্তভোগী সংবাদকর্মীরা। তাঁরা বলছেন, আইপিএলে ডেকান চার্জার্স দল কেনাই আজকে মুখ থুবড়ে পড়ার প্রধান কারণ। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া সংবাদমাধ্যম কর্মীরা অফিস ঘেরাও করার কর্মসূচি নিয়েছিলেন। কিন্তু তাতে বাদ সেধেছে কোভিড।
এই অবস্থার মধ্যেই আগামী ১৯ সেপ্টেম্বর দুবাইয়ে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে আবারও শুরু হয়ে যাচ্ছে আইপিএল। তার মাত্র ১১ দিন পর বেতনহীনতার বর্ষ পেরোবে ডেকান ক্রনিকল সংবাদপত্রের কলকাতা ব্যুরোর কর্মীদের।

Comments are closed.