২০২২ সালের মার্চের মধ্যেই গঙ্গার নীচ দিয়ে ছুটবে Underwater Metro, দাবি কেএমআরসিএলের
কলকাতা মহানগরের মুকুটে যোগ হতে চলেছে নতুন পালক, সৌজন্য ভারতীয় রেল। দেশের মধ্যে প্রথমজলের নীচ দিয়ে মেট্রো ট্রেন চালুর ইতিহাস সৃষ্টির পথে কলকাতা। হুগলি নদীর নীচ দিয়ে চলা হাওড়া ও কলকাতার সংযোগ স্থাপনকারী মেট্রোর প্রথম টানেল তৈরির কাজ প্রায় শেষ। ২০২২ সালের মার্চের মধ্যেই জলের তলা দিয়ে মেট্রো রেলের ছোটা শুরু হবে বলে আশাবাদী রেল। দেখে নেওয়া যাক দেশের প্রথম আন্ডার ওয়াটার মেট্রো সম্পর্কে বেশ কিছু তথ্য।
Underwater Metro-র কাজ শুরু
২০১৭ সালের এপ্রিল মাসে হাওড়া থেকে হুগলি নদীর নীচ দিয়ে টানেল বসানোর কাজ শুরু হয়। এই টানেলগুলির দৈর্ঘ্য ৫২০ মিটার, ব্যাস ৬ মিটার ও গভীরতা ৩০ মিটার। রচনা ও প্রেরণা নামে দুটি টানেল বোরিং মেশিন আনা হয় জার্মানি থেকে।
১৯৮৪ সালে ভারতে প্রথম মেট্রো চালু হয় এই কলকাতাতেই। জলের তলা দিয়ে মেট্রো চালুর ক্ষেত্রেও ভারতের পথপ্রদর্শক হতে চলেছে রাজ্যের রাজধানী শহর।
ইস্টওয়েস্ট মেট্রোর ১৬.৬ কিলোমিটার পথের মধ্যে ৫২০ মিটার থাকছে নদীর নীচ দিয়ে। গঙ্গাবক্ষ থেকে প্রায় ৩৩ মিটার নীচে তৈরি টানেলের মধ্যে একফোঁটা জল না প্রবেশ করানোটাই ছিল বড় চ্যালেঞ্জ।
দেশের মধ্যে জলের তলায় প্রথম বড় টানেল তৈরিতেও ইতিহাস সৃষ্টি করল কলকাতা। কলকাতা মেট্রো রেল কর্পোরেশন লিমিটেড (কেএমআরসিএল)-এর চিফ ইঞ্জিনিয়ার (সিভিল) বি দেওয়ানজি জানান, দু’টি টানেলের ডায়ামিটার ৫.৮ মিটার করে। টানেলদুটি থাকছে ১.৪ মিটারের কংক্রিটের বলয়ের ভেতর। তার উপর বিশেষ গাস্কেট ব্যবহার করা হচ্ছে, যাতে কোনওভাবেই জল ঢুকতে না পারে।
খরচ
দেশের মধ্যে ইতিহাস সৃষ্টিকারী এই Underwater Metro-র খরচের দিকটাও একটা বড় চ্যালেঞ্জ সরকারের কাছে। ২০১৪ সালের মধ্যে ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রো প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও নানা সমস্যার সম্মুখীন হয়ে কাজ কয়েক দফায়পিছিয়েছে। একাধিকবার রুট বদলের কারণে খরচও বেড়েছে। সব মিলিয়ে ২০২১ সাল নাগাদ এই পুরো প্রকল্প শেষ করতে প্রায় ৮ হাজার ৫০০ কোটি টাকা খরচ হবে বলে মনে করা হচ্ছে।
সময়
ব্যস্ত কলকাতার রাস্তার ভিড় এড়িয়ে সময়ে স্কুল-কলেজ-অফিসে পৌঁছতে শহরের মানুষের বড় ভরসা মেট্রো রেল। এদিকে ব্যস্ত সময়ে ফেরিপথে কিংবা জ্যাম ঠেলে হাওড়া ব্রিজ পারাপার করে হাওড়া থেকে কলকাতা বা কলকাতা থেকে হাওড়া যেতে নাকাল হতে হয় মানুষকে।
একবার জ্যামে পড়লে যেমন কখন সেতু পেরিয়ে হাওড়া যাবে তার কোনও নির্দিষ্ট সময় থাকে না, ফেরি পারাপারে প্রায় ২০ মিনিট লেগে যায়, সেখানে ৫২০ মিটার টানেল পার করতে মাত্র ৬০ সেকেন্ড লাগবে মেট্রো ট্রেনের। মাত্র ৩০ সেকেন্ডে হাওড়া ও কলকাতায় পারাপার হওয়া যাবে।
সুরক্ষার প্রশ্ন
দেশে প্রথম জলের তলা দিয়ে Underwater Metro, তাও আবার গঙ্গার নীচ দিয়ে। সেখানে যাত্রীদের সুরক্ষা একটি বিশাল ব্যাপার। কেএমআরসিএলের চিফ ইঞ্জিনিয়ার অবশ্য জানাচ্ছেন, সুরক্ষা নিয়ে তাঁরা উপযুক্ত ব্যবস্থা নিয়েছেন। কোনও খুঁত নেই। কংক্রিটের টানেল তৈরি করে প্রবেশ করানো হয়েছে। এই কংক্রিটের মধ্যে হাইড্রোফিলিক গাস্কেট থাকছে, যাতে কোনওভাবে জল ঢুকে পড়লে, তা বেরিয়ে যেতে পারে। তাছাড়া মোট চার ধাপে সুরক্ষার বলয় তৈরিহয়েছে বলে জানান তিনি।
প্রায় ১৫০ ট্রাক কাদা বের করা হয়েছে শুধু মেট্রো চলাচলের বাধা দূর করতে। সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করার জন্য এক হাজারের বেশি শ্রমিক দিন রাত খেটে চলেছেন।
আপৎকালীন পরিস্থিতির জন্য থাকছে ফায়ার অ্যালার্ম। আবার দমকল বাহিনীও যাতে বিপদে আপদে টানেলে ঢুকতে পারে, তার জন্যও রয়েছে বিশেষ ব্যবস্থা। গঙ্গার মধ্যে দুটি টানেলের মধ্যে ট্রেন চলে যাওয়ার সময় জলের তরঙ্গজনিত সমস্যায় যাতে না পড়তে হয়, তার ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছে।
চ্যালেঞ্জ
ইতিহাস সৃষ্টিকারী এই Underwater Metro প্রকল্পে কেএমআরসিএলের কাছে আরও একটি বড় সমস্যা হল, যে জায়গায় প্রকল্প তৈরি হচ্ছে তার আশপাশে পুরনো বাড়িঘরগুলিকে অক্ষত রাখা। ব্রিটিশ আমলের বেশ কিছু পুরনো বাড়ি রয়েছে গঙ্গার দু’ধারের এলাকায়। মাস কয়েক আগে এই প্রকল্পের কাজ করতে গিয়ে বৌবাজারের বেশ কিছু বাড়ি হেলে গিয়েছিল, ভেঙে পড়েছিল। প্রচুর মানুষকে বাড়ি ছেড়ে হোটেলে থাকতে হয়, একাধিক দোকানকর্মী আশ্রয়হীন রাস্তায় রাত কাটাতে বাধ্য হন। এই রকম পরিস্থিতি যাতে ফের না হয়, তার জন্য কড়া দৃষ্টি রেখেছে রেল কর্তৃপক্ষ।
তাছাড়া যে এক হাজার কর্মী টানেলের ভিতর ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় কাজ করছেন, তাঁদের নিরাপত্তার বিষয়টিও দেখতে হচ্ছে। অক্সিজেনজনিত অসুবিধে, প্রচণ্ড গরম সয়ে দিনের পর দিন কাজ করে চলেছেন এই কর্মীরা। তাঁদের সাধুবাদ জানাতেই হয়।
ট্র্যাফিক জ্যাম থেকে মুক্তি
কলকাতা ও হাওড়ার আমজনতার দীর্ঘ সময়ের অপেক্ষার অবসান হতে চলেছে বছরখানেকের মধ্যে। Underwater metro প্রজেক্ট শেষ হলে কলকাতা ও হাওড়ার মানুষের যাতায়াতের চালচিত্রই বদলে যাবে বলে মনে করছে ওয়াকিবহাল মহল। হাওড়া ময়দান থেকে মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যে মেট্রো রেলের সৌজন্যে চলে আসা যাবে সল্টলেক সেক্টর ফাইভে। প্রতিদিন প্রায় ৯০ লক্ষ মানুষ এই নতুন ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রোয় সফর করতে পারবেন বলে দাবি কেএমআরসিএলের।
Comments are closed.