নন্দীগ্রাম আসলে যা ঘটেছিল: দ্বিতীয় হুগলি ব্রিজে গাড়ি থেকে নামলেন মমতা ব্যানার্জি! এক পায়ে চটি, অন্য পায়ে নেই

আগের পর্ব যেখানে শেষ হয়েছিল: ২০০৯ লোকসভা ভোট মিটতে না মিটতেই ফের নন্দীগ্রামে শুরু হল সংঘর্ষ! এলাকাছাড়া হতে শুরু করলেন মানুষ……

 

১৬ মে ২০০৯, লোকসভার রেজাল্ট। একদিকে গোটা দেশ, আর একদিকে নন্দীগ্রাম, খেজুরির মানুষ। দেশের ১২০ কোটি মানুষের সঙ্গে তাদের ভাবনার, আকাঙ্ক্ষার কোনও মিল নেই। গোটা দেশ যখন তাকিয়েছিল দিল্লির সরকার কে গড়বে সেদিকে, নন্দীগ্রাম-খেজুরির মানুষ সেই সময় প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে আক্রমণ এবং আত্মরক্ষার। পূর্ব মেদিনীপুর জেলার তমলুক এবং কাঁথি, দুটো আসনেই জিতল তৃণমূল কংগ্রেস। শুভেন্দু অধিকারী তমলুকের এবং শিশির অধিকারী কাঁথির সাংসদ হলেন।

আড়াই বছর আগে শুরু হওয়া নন্দীগ্রাম আন্দোলনের একটা বৃত্ত সম্পূর্ণ হল। এবার কাউন্টডাউন বিধানসভা নির্বাচন ২০১১। আরও বড়ো লড়াইয়ের মঞ্চ, স্বাভাবিকভাবেই আরও ব্যাপক প্রস্তুতি।

নন্দীগ্রাম উত্তর যুগে খেজুরিতে প্রথম রাজনৈতিক সংঘর্ষ হল ১৭ মে, লোকসভা রেজাল্টের ঠিক পরদিন। আক্রান্ত এবং আক্রমণকারীর ভূমিকাটা এবার উলটে গেল। খেজুরিতে সেদিনই প্রথম আক্রান্ত হল সিপিআইএম, আক্রমণকারী তৃণমূল কংগ্রেস। তবে সেই সংঘর্ষ মাত্রা ছাড়াল না। পুলিশ নিয়ন্ত্রণে আনতে পারল সেই পরিস্থিতি। কিন্তু ১৭ মে স্পষ্ট ইঙ্গিত দিল, পূর্ব মেদিনীপুরে সিপিআইএমের শেষ দূর্গের পতন স্রেফ সময়ের অপেক্ষা। ১৭ মে’র মহড়া দেখে খেজুরি হাতছাড়া হওয়ার অনিবার্য পরিণতির আশঙ্কা গ্রাস করল জেলার সিপিআইএম নেতৃত্বকে। আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা নিয়ে বেশিদিন কাটাতেও হল না তাদের, খেজুরিতে ব্যাপক তাণ্ডব শুরু হল কয়েকদিন বাদেই, ৮ জুন।

সিপিআইএমের একের পর এক পার্টি অফিস আক্রান্ত। ২০০৭ সালের সেই ৫ জানুয়ারি থেকে কয়েকদিন আগের লোকসভা ভোট পর্যন্ত খেজুরির যে সমস্ত জায়গা থেকে, যারা যারা আক্রমণ শানিয়েছে, তার জবাব দিতে শুরু করল নন্দীগ্রামের তৃণমূল কংগ্রেস। তাদের সঙ্গী তখন দীর্ঘদিন মুখ বুজে থাকা খেজুরির সিপিআইএম বিরোধী লোকজনও। দলে দলে ঘর ছাড়তে শুরু করলেন খেজুরের সিপিআইএম নেতারা। কারও খালি বাড়ি ভাঙচুর হল, কারও বাড়ি আগলে পড়ে থাকলেন দোর্দণ্ডপ্রতাপ সিপিআইএম নেতার বয়স্ক মা। ভাঙচুর হতে শুরু করল সিপিআইএমের একের পর এক পার্টি অফিস। নন্দীগ্রাম শান্ত হয়েছে, এবার আমার অ্যাসাইনমেন্ট খেজুরি।

৯ জুন একদম ভোরে কলকাতা থেকে রওনা দিলাম খেজুরির উদ্দেশে, এবার আমার সঙ্গী ক্যামেরাম্যান জয়ন্ত বেহরা। পৌঁছে গেলাম সক্কাল সক্কাল। নন্দীগ্রামে প্রবেশের চন্ডিপুর পেরিয়ে হেঁড়িয়ার মোড় থেকে পূর্বদিকে ঘুরলেই খেজুরি শুরু। ঘুরে ১০০ মিটার এগোলেই বাঁদিকে সিপিআইএমের বড়ো পার্টি অফিস। গাড়ি থামালাম। পাশেই চায়ের দোকান। এখানে বসে কত চা খেয়েছি। পদবী মনে নেই, নাম বিনয়, সিপিআইএমের সর্বক্ষণের কর্মী। এই পার্টি অফিসে বসতেন। চা খাওয়াতেন। কোথায় কী? একটা লোকও নেই পার্টি অফিসে। দরজা ভেঙে পড়ে আছে। অফিসের চেয়ার, টেবিল সব ভাঙা। এই পার্টি অফিসের নেতা-কর্মীরাই ১৪ মার্চ ব্যারিকেড বসিয়েছিলেন, যাতে কোনও বহিরাগত নন্দীগ্রামে ঢুকতে না পারে। গাড়ি, বাস থামিয়ে তল্লাশি করছিলেন, লুকিয়ে যেন কোনও সাংবাদিক ঢুকে পড়তে না পারে। কী দাপট তখন। ১০ নভেম্বর অপারেশন সূর্যোদয়ের পর যখন এই রাস্তা দিয়ে ঢুকছিলাম, তখনও আক্রান্ত হয়েছি এই পার্টি অফিসের সামনে। আর এখন? কোথায় কী? ৯ জুন ২০০৯, সকালে খেজুরিতে ঢোকার রাস্তায় সিপিআইএমের পার্টি অফিসের সামনে দাঁড়িয়ে ভাবছিলাম, প্রবেশ পথে বড়ো রাস্তার ওপরেই যদি এই হাল হয়, ভেতরে গ্রামে-গঞ্জে না জানি কী অবস্থা! ইতিহাসের চাকা এত দ্রুতও ঘোরে? সিপিআইএম নেতাদের আতিথেয়তা বা চোখ রাঙানি, কোনওটাই নেই, সব শুনশান। চা খেয়ে এগোলাম খেজুরির দিকে।

সেদিনই খেজুরির আক্রান্ত কর্মী, সমর্থকদের দেখতে সেখানে যাওয়ার কথা রাজ্যের একাধিক নেতা, মন্ত্রীর। আগের দিন রাতে কলকাতাতেই শুনেছি, মন্ত্রী পার্থ দে, রেখা গোস্বামী, চক্রধর মেইকাপ, রবিলাল মৈত্রসহ জেলার নেতারা খেজুরি যাবেন। সিপিআইএম ভেবেছিল, তড়িঘড়ি কয়েকজন মন্ত্রীকে পাঠিয়ে দিলে তৃণমূল কংগ্রেস অনায়াসে খেজুরি দখল করতে পারবে না। হেঁড়িয়ার মোড়ে পৌঁছেই ঠিক করে নিয়েছিলাম রাজ্যের মন্ত্রীরা যখন যাবেন দেখা যাবে, আগে নিজে দেখে আসব ভিতরে কী অবস্থা। প্রথম ৩-৪ কিলোমিটার দেখে বোঝার কিছু উপায় নেই। সবই স্বাভাবিক, শান্ত। কিন্তু তারপর এগোতেই বোঝা গেল আসল ছবিটা। রাস্তার ধারে সিপিআইএমের পার্টি অফিসে আগুন জ্বলছে। রাস্তায় পড়ে আছে জ্যোতি বসু, লেনিন, ওই জেলার জনপ্রিয় নেতা প্রয়াত সুকুমার সেনগুপ্তর ফ্রেমে বাঁধানো ছবি। ফ্রেমের কাচ ভাঙা। পার্টি অফিসের বাইরে পড়ে প্রচুর কাগজপত্র। রাস্তায় পড়ে আছে গণশক্তি পত্রিকা, লেখার প্যাড, বই, লিফলেট। আর রাস্তায় ৮০-১০০ জনের একটা জটলা। চেহারায় ঠিকরে বেরচ্ছে আনন্দ, উল্লাস। এরাই ভাঙচুর করছে, আগুন ধরাচ্ছে পার্টি অফিসগুলোতে। জয়ন্ত ছবি তুলছে, কেউ কোনও বাধা দিচ্ছে না। ‘দাদা, কী অত্যাচারটাই না সিপিআইএম করেছে এতদিন। মারধোর থেকে জরিমানা কী করেনি? ভাল করে দেখান, আজ খেজুরি সিপিআইএম মুক্ত হয়েছে।’ নিয়ন্ত্রিত উচ্ছ্বাস খেজুরির তৃণমূল কংগ্রেস কর্মীদের গলায়।

আরও এগোলাম। একে একে কামারদা, কুঞ্জপুর, কলাগেছিয়া, বিদ্যাপীঠ মোড়,  বড়তলা,  জনকা, নিচকশবা, খেজুরির এলাকার পর এলাকা ৮ তারিখ থেকে শুরু হয়ে ৯ তারিখের মধ্যে সিপিআইএম শূন্য হয়ে গেল। এখানেও এত লোক ছিল সিপিএমের বিরুদ্ধে? দুপুরের খবর পেলাম, খেজুরিতে যাওয়ার জন্য সিপিএমের যে নেতা, মন্ত্রীরা কলকাতা থেকে রওনা দিয়েছিলেন তাঁরা অবরোধে আটকে পড়েছেন। নন্দকুমার-দীঘা রাজ্য সড়কে অবরোধ করে হেঁড়িয়া মোড়ের  আগেই তাঁদের কনভয় আটকে দিয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস। তৃণমূল কংগ্রেসের প্ল্যান ছিল, সিপিআইএম নেতা, মন্ত্রীদের খেজুরিতে ঢুকতে দেওয়া হবে না। ঘটনাস্থলে দাঁড়িয়ে সিনিয়র অফিসারদের নেতৃত্বে বিরাট পুলিশ বাহিনী। খবর পাচ্ছি, রাজ্যের একাধিক মন্ত্রী মাঝরাস্তায় দাঁড়িয়ে আছেন, কিন্তু বিরোধী দলের কর্মীদের অবরোধে এক পাও এগোতে পারছেন না। আর সেখান থেকে কয়েক কিলোমিটার মাত্র দূরে খেজুরিতে সিপিআইএম অফিস তছনছ করছে তৃণমূল বাহিনী। তৃণমূল কংগ্রেসের অবরোধ তুলতে বা খেজুরিতে এলাকা দখল রুখতে বিন্দুমাত্র উদ্যোগও নিচ্ছে না পুলিশ। মাঝরাস্তায় দাঁড়িয়ে শাসক দলের মন্ত্রীরা অসহায়ের মতো একবার মুজফফর আহমেদ ভবনে, একবার মহাকরণে ফোন করছেন। বলছেন, তৃণমূল কংগ্রেসের অবরোধ তোলার জন্য সেখানে পুলিশকে নির্দেশ দিতে। ঘটনাস্থলে দাঁড়িয়ে এক আইপিএস অফিসার রাজ্যের স্বরাষ্ট্র সচিবকে বলছেন, ‘স্যার, এখানে পরিস্থিতি খুব খারাপ। অগ্নিগর্ভ অবস্থা। ভিআইপি’দের খেজুরি নিয়ে যাওয়ার জন্য অবরোধ তুলতে গেলে ফোর্স অ্যাপ্লাই করতে হবে। গুলি পর্যন্ত চালাতে হতে পারে। কী করব? আপনি অর্ডার দিন।’ এরপর আর কোন অফিসার মহাকরণ থেকে অর্ডার দেবেন অবরোধ তুলতে। স্বাভাবিকভাবেই অবরোধ তোলার জন্য ফোর্স অ্যাপ্লাইয়ের নির্দেশ দিয়ে মহাকরণ থেকে আর ফোন গেল না পুলিশ অফিসারদের কাছে। ঘণ্টা দুয়েক তৃণমূল কংগ্রেসের অবরোধে আটকে খেজুরির দোরগোড়া থেকে কলকাতায় ফিরে আসতে সেদিন বাধ্য হয়েছিলন রাজ্যের মন্ত্রীরা। কলকাতা ফেরার সময় হয়তো তাঁরা ভাবছিলেন, এখনও আমরাই সরকারে আছি তো? আসলে সরকারে তখন তাঁরা ছিলেন শুধুমাত্র খাতায়-কলমে, সংখ্যায়। তার পরেও সিপিআইএম সরকারের ছিল দু’বছর। মৃত্যুশয্যায় থাকা রোগীর কোনওক্রমে বেঁচে থাকার মতো।

২০০৬ সাল থেকে বিরোধীদের নানারকম আন্দোলনের সাক্ষী ছিল রাজ্যের মানুষ। কিন্তু রাজ্যের মন্ত্রীরা কোথাও যেতে চাইলেও, যেতে পারছেন না, এমন পরিস্থিতি তার আগে কেউ ভাবতেও পারেননি। ২০০৯ লোকসভা ভোটের পর থেকেই ক্ষমতাহীন পাপেট সরকার তখন পশ্চিমবঙ্গের মসনদে। ২০০৭ সালের নন্দীগ্রাম আন্দোলন শুরু হওয়ার পর পূর্ব মেদিনীপুরের নানা জায়গায় একাধিকবার রাস্তা অবরোধ করে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং বিরোধীদের আটকে দেওয়ার কৌশল নিয়েছিল সিপিআইএম। কখনও চন্ডিপুর মোড়, তো কখনও মেচেদায় আটকানো হয়েছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, শুভেন্দু অধিকারীকে। তারও আগে সিঙ্গুরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাস্তা আটকানোর কৌশল নিয়েছিল প্রশাসন। কলকাতার ধর্মতলায় অনশনে বসার কয়েকদিন আগে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সিঙ্গুর যাচ্ছেন। তাঁর সঙ্গে আমিও যাচ্ছি। কোনা এক্সপ্রেসওয়ে পেরিয়ে এগোচ্ছে তৃণমূল নেত্রীর কনভয়। হাওড়া এবং হুগলি জেলার একদম সীমানায মাইতিপাড়া নামে একটা জায়গা। গাড়িতে বসে দূর থেকে দেখতে পাচ্ছি, মাইতিপাড়ার মোড়ে প্রচুর পুলিশ দাঁড়িয়ে। তখনও ব্যাপারটা বোঝা যায়নি। মাইতিপাড়ায় পৌঁছতেই হুগলির তৎকালীন পুলিশ সুপারিন্টেন্ডেন্ট সুপ্রতিম সরকারের নেতৃত্বে বিরাট পুলিশ বাহিনী কনভয় থামিয়ে দিল। পুলিশের নির্দেশ, হুগলি জেলায় ঢুকতে পারবেন না তৃণমূল নেত্রী। গাড়ি থেকে নামলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মিনিট পনেরো ধস্তাধস্তি চলল পুলিশের সঙ্গে। তারপর মহিলা পুলিশ প্রায় চ্যাংদোলা করে তুলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে তাঁর গাড়িতে তুলে দিলেন। ঘুরিয়ে দিলেন গাড়ির মুখ। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গাড়ি রওনা দিল কলকাতার দিকে। পেছনের গাড়িতে আমি। হঠাৎ দ্বিতীয় হুগলি সেতু পার করে থেমে গেল তাঁর গাড়ি। মমতা ব্যানার্জি নেমে পড়লেন গাড়ি থেকে। পেছনের গাড়ি থেকে আমিও নামলাম। দেখি তৃণমূল নেত্রীর এক পায়ে চটি আছে, অন্য পায়ে নেই। রাস্তায় নেমেই পুলিশের বিরুদ্ধে চিৎকার শুরু করলেন তৃণমূল নেত্রী। পাশে আমি দাঁড়িয়ে। মোবাইল থেকে ফোন করলেন বিধানসভার বিরোধী দলনেতা পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে।

‘পার্থদা আপনি কোথায়? নানা, আমাকে আটকে দিয়েছে। প্রচণ্ড মারধর করেছে পুলিশ। যেতে দেয়নি সিঙ্গুরে। আপনি কাল বনধ ডাকার প্রস্তুতি নিন…..,’ রাস্তায় পায়চারি করতে করতে ফোনে চিৎকার করছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আশেপাশে আর কেউ নেই। গোটা ঘটনা ঘটছে আমার আর তাঁর নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা দু’তিন জন পুলিশ অফিসারের সামনে।

একথা শুনেই পকেট থেকে মোবাইল ফোন বের করে আমিও অফিসে বলে দিলাম। ‘কাল বাংলা বনধ ডাকছে তৃণমূল কংগ্রেস। সিঙ্গুরে যাওয়ার পথে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে পুলিশের আটকে দেওয়ার প্রতিবাদে।’

‘আপনারা বিধানসভায় ব্যাপারটা তুলুন, আমাকে মারধর করেছে……’ পার্থ চট্টোপাধ্যায়কে টানা নির্দেশ দিয়ে ফের গাড়িতে উঠলেন তৃণমূল নেত্রী। তারপর তাঁর গাড়ি গিয়ে থামল সোজা বিধানসভার ভেতরে। পেছন পেছন আমিও গিয়ে নামলাম বিধানসভায়। তৃণমূল নেত্রীর পেছন পেছন বিধানসভায় ঢুকে দেখি সমস্ত টেবিল ভেঙে, উলটে পড়ে আছে। শুনলাম, দলনেত্রীকে পুলিশের মারধরের প্রতিবাদে তৃণমূল বিধায়করা কিছুক্ষণ আগেই বিধানসভার ভেতরে ভাঙচুর চালিয়েছে। বিধানসভার লবি লণ্ডভণ্ড অবস্থা। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সোজা চলে গেলেন বিরোধী দলনেতার ঘরে। সব মিলে সেই সময় চূড়ান্ত বিশৃঙ্খলা বিধানসভাজুড়ে। বিধানসভায় তখন উপস্থিত রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীও। কিছুক্ষণ বাদেই বিধানসভার নিজের ঘরে বসে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ঘোষণা করলেন, ‘সিঙ্গুরে ১৪৪  ধারা জারি হয়েছে আজ সকাল থেকে। তাই ওনাকে আটকেছে পুলিশ।’

সেদিন থেকে শুরুহয়েছিল রাজ্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে অবরুদ্ধ করার রাজনীতি। এরপর থেকে বহুবার পুলিশের মদতে সিপিআইএম তৃণমূল নেত্রীর গতিবিধি রুদ্ধ করেছিল। সেই অবরোধের রাজনীতিই সেইদিন, ৯ জুন ২০০৯, শাসক দলকে  সুদে আসলে ফেরত দিয়েছিল তৃণমূল কংগ্রেস। ফারাক শুধু একটাই, আগে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের পুলিশ সিপিআইএমের অবরোধ তুলত না, ২০০৯ সালের লোকসভা ভোটের পর সেই পুলিশই তৃণমূল কংগ্রেসের অবরোধেও নিষ্ক্রিয় থাকার কৌশল আয়ত্ত করে নিল। তারাও ততদিনে বুঝে গিয়েছে, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য নামেই মুখ্যমন্ত্রী। রাজ্যের ডিফ্যাক্টো মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাই সিপিআইএম, এমনকী মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ মান্য না করলেও কিছু এসে যাবে না।  মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়সহ বিরোধী দলকে অবরুদ্ধ করার যে রাজনীতি রাজ্যে আমদানি করেছিল সিপিআইএম, তা সেই বছর ৯ জুনের পরেও একাধিক জায়গায় প্রয়োগ করে তৃণমূল কংগ্রেস। বিশেষ করে ২০০৯ সালে রাজ্যে ভয়ঙ্কর ঘূর্ণিঝড় আয়লার পর ত্রাণের কাজ দেখতে যাওয়ার সময় মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সহ শাসক দলের একাধিক নেতা, মন্ত্রীর কনভয় আটকে দেয় বিরোধীরা।

 

সিপিআইএম নেতারাও সেদিন ৯ জুনের পর বুঝে গিয়েছিলেন, পুলিশ প্রশাসনের থেকেও আর কোনও সাহায্য পাওয়া যাবে না। তাই সেদিন থেকে তাদের লড়াইয়ে খুলে গেল দুটো ফ্রন্ট। একদিকে তৃণমূল কংগ্রেস। অন্যদিকে রাজ্যের পুলিশ, যার একটা বড়ো অংশই সিপিআইএম সরকারের অনিবার্য বিপর্যয় আঁচ করে অনেক ক্ষেত্রেই বিরোধীদের পক্ষ নিতে শুরু করেছিল।

জেলা পরিষদ হাতছাড়া, দুটো লোকসভা আসনে পর্যুদস্ত, নন্দীগ্রাম- খেজুরি বেদখল। পুলিশও পাশে নেই। প্রশাসন নিষ্ক্রিয়, বলা ভাল খানিকটা বিরোধীদের পক্ষে। পূর্ব মেদিনীপুরের সিপিআইএমের অবস্থা তখন ঢাল, তরোয়ালহীন নিধিরাম সর্দারের থেকেও খারাপ। তমলুকের জেলা পার্টি অফিস সুকুমার সেনগুপ্ত ভবন বা হলদিয়ার শ্রমিক ভবন থেকে শুরু করে ৩১ আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের নেতারাও ততদিনে বুঝে নিয়েছেন, হাতে সময় বেশি নেই, অবিলম্বে কোনও ব্যবস্থা না নিলে ২০১১ বিধানসভা নির্বাচনে ঘুরে দাঁড়ানো অসম্ভব। আর এখান থেকেই ফের একবার খেজুরি, নন্দীগ্রাম পুনর্দখলের প্ল্যান করেছিল হলদিয়ার শ্রমিক ভবন এবং মুজফফর আহমেদ ভবন।

শেষ চেষ্টা। এবং এই কাজে ফের দায়িত্ব পড়েছিল পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার ওপর। গড়বেতার নেতা তথা রাজ্যের এক মন্ত্রীকে দলের শীর্ষ নেতৃত্বের পক্ষ থেকে বলা হয় দ্রুত কোনও ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য। কিন্তু প্রস্তাব শুনেই সঙ্গে সঙ্গে না করে দিয়েছিলেন গরবেতার ওই নেতা। দলকে জানিয়ে দিয়েছিলেন, তাঁর পক্ষে এই কাজ করা সম্ভব নয়। ২০০৭ সালের ১০ নভেম্বর তাঁর দুই বিশ্বস্ত অনুগামী তপন ঘোষ এবং শুকুর আলি এগরা থেকে গ্রেফতারের ঘটনায় বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য এবং তাঁর পুলিশের ভূমিকায় অত্যন্ত ক্ষুব্ধ ছিলেন তিনি। পুলিশের সাহায্য তিনি চাননি, চেয়েছিলেন পুলিশ অন্তত  নিষ্ক্রিয় থাকুক। কিন্তু তা না হওয়ায় বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য প্রশাসনকে তিনি আর বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। এমনিতেই আগাগোড়া বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বিরোধী ওই নেতা কোনওদিনই সিপিআইএম সরকারের দ্বিতীয় মুখ্যমন্ত্রীকে মাঝারি মাপের প্রশাসক বলেও মনে করতেন না। তাই ফের নন্দীগ্রাম, খেজুরি দখলের জন্য লোক পাঠাতে হবে, এই প্রস্তাব পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে তা খারিজ করে দেন তিনি। তখন তাঁকে বোঝানোর দায়িত্ব নিয়েছিলেন পশ্চিম মেদিনীপুরের শীর্ষ নেতা। তিনি গড়বেতার নেতা এবং রাজ্যের ওই মন্ত্রীকে ডেকে বলেছিলেন, ‘এই শেষবার। আলিমুদ্দিন স্ট্রিট এবং সরকারের সঙ্গে কথা হয়ে গিয়েছে। পুলিশ দু’ দিন কোনও ব্যবস্থা নেবে না। খেজুরি, নন্দীগ্রাম উদ্ধার করতে হবে।’

তাতেও সহজে চিড়ে ভেজেনি।  তিনি জানিয়ে দেন, গড়বেতা, চন্দ্রকোণা থেকে লোক ফের নন্দীগ্রাম, খেজুরিতে পাঠানো সম্ভব নয়। টানা দু’দিন এই বোঝানোর পালা চলে। শেষমেশ তীব্র অনিচ্ছা সত্ত্বেও ফের একবার তাঁর অনুগামীদের পূর্ব মেদিনীপুরে পাঠাতে রাজি হয়ে গিয়েছিলেন গড়বেতার নেতা এবং রাজ্যের মন্ত্রী। শর্ত ছিল, পুলিশ ৪৮ ঘন্টা, দু’ দিন কোনও সক্রিয়তা দেখাবে না। অভিযোগ পেলেও ব্যবস্থা নেবে না। খেজুরি, নন্দীগ্রাম পুনরুদ্ধার হলে, তার মধ্যেই হবে। নয়তো হবে না। এমনই ছিল সিপিআইএমের আত্মবিশ্বাস।

২০১০ সালের নভেম্বর মাসে এই পরিকল্পনা হয়। তিন বছর আগে এই নভেম্বরেই নন্দীগ্রাম দখলে এসেছিল মাস্টারদার বাহিনী। এবার অবশ্য মাস্টারদা নন, চন্দ্রকোণার অন্য এক পার্টি সদস্য এবং নেতার ওপর দায়িত্ব পড়ল খেজুরি, নন্দীগ্রাম পুনর্দখলের। সেই সময় খেজুরি, নন্দীগ্রামের ৪০-৫০ জন ঘরছাড়া সিপিআইএম কর্মী, যাঁরা ২০০৭ থেকে সেখানে ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির সঙ্গে লড়াই করেছিলেন, তাঁদের অনেকেই পশ্চিম মেদিনীপুরের চন্দ্রকোণা, গড়বেতা এলাকায় আশ্রয় নিয়েছিলেন। তাঁদের সঙ্গে আরও প্রায় ৫০ জন গড়বেতা, চন্দ্রকোণার ছেলেকে দায়িত্ব দেওয়া হল খেজুরি, নন্দীগ্রাম পুনর্দখলের। ২৩ নভেম্বর ২০১০ গড়বেতা পৌঁছে গিয়েছিলেন খেজুরির সিপিআইএম নেতা হিমাংশু দাস। পরিকল্পনা হয়েছিল খেজুরি, নন্দীগ্রামের ওই ৪০-৫০ জন ঘরছাড়া এলাকায় ফেরার জন্য রওনা দেবে। তাদের সঙ্গে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে যাবে চন্দ্রকোণা এবং গড়বেতার প্রায় ৫০ জনের বাহিনী। তারপর শুরু হবে অপারেশন খেজুরি এবং নন্দীগ্রাম। ২৩ নভেম্বর মাঝরাতে দুটো লরিতে চেপে প্রায় ১০০ জন গড়বেতা থেকে রওনা দিয়েছিল খেজুরির উদ্দেশে। হাতছাড়া হয়ে গেলেও তখনও খেজুরিতে সিপিআইএমের সাংগঠনিক শক্তি নন্দীগ্রামের থেকে অনেক বেশি। ঠিক হয়েছিল, দুটো লরিতে চেপে প্রায় ১০০ জন হেঁড়িয়া  মোড় দিয়ে খেজুরিতে ঢুকবে। সেই খবর যাতে কোনওভাবে জানাজানি না হয়, তার জন্য পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার লরিও ব্যবহার করা হয়নি। লরি দুটো আনা হয়েছিল পাশের অন্য এক জেলা থেকে।

এমনকী লরির চালকদেরও বদলে দেওয়া হয়েছিল। আসল দুই চালককে গড়বেতায় রেখে দেওয়া হয়েছিল, লরি চালিয়ে নিয়ে গিয়েছিল পশ্চিম মেদিনীপুরে দু’জন। ২৩ নভেম্বর মাঝরাতে গড়বেতা থেকে রওনা দিয়ে ২৪ তারিখ ভোর রাতে দুটো লরি গিয়ে পৌঁছয় খেজুরির সিপিআইএমের কলাগেছিয়া পার্টি অফিসে। ভোর সাড়ে ৪টে-৫টা হবে। কয়েক মিনিটের মধ্যে প্রায় ১০০ জনকে পার্টি অফিসের সামনে নামিয়ে লরি দুটো ফিরে গিয়েছিল গড়বেতায়। খেজুরি, নন্দীগ্রামের তখনও পুরোপুরি ঘুম ভাঙেনি। আবার একটা অপারেশনের প্রস্তুতি নিতে শুরু করল সিপিআইএমের সশস্ত্র বাহিনী।

ঘণ্টাখানেকের ভেতরেই খেজুরিতে কলাগেছিয়া, কামারদা এবং আশপাশের এলাকার সিপিআইএম কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে খবর চলে গিয়েছিল, তাদের লোকজন পৌঁছে গিয়েছে সেখানে। আস্তে আস্তে লোক জমতে শুরু করে কলাগেছিয়া পার্টি অফিস চত্বরে। হাজার পাঁচেক সিপিআইএম কর্মী সমর্থক জড়ো হয়ে যায় সকাল সাতটার মধ্যে। প্ল্যান ছিল, বড়ো মিছিল শুরু করা হবে। মিছিলেই থাকবে সশস্ত্র বাহিনী। একদিকে যেমন ঘরছাড়া নেতারা বাড়িতে ঢুকবেন, অন্যদিকে বিভিন্ন এলাকায় তৃণমূল কংগ্রেসের প্রভাবশালী নেতাদের বের করে দেওয়া হবে। এই মিছিল করার পরিকল্পনা ছিল নন্দীগ্রামেও। সিপিআইএম জানত, ওই সকালে তৃণমূল কংগ্রেস প্রতিরোধের জন্য তৈরি থাকবে না। সিপিআইএমের মিছিল শুরু হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যে সে খবর ছড়িয়ে পড়ে খেজুরির বিভিন্ন প্রান্তে। তৃণমূলের বিভিন্ন নেতা আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কায় এদিক-ওদিক পালাতে শুরু করেন। সিপিআইএম সশস্ত্র মিছিল বের করে  ফের এলাকা দখল করার চেষ্টা করছে, মুহূর্তের মধ্যেই এই খবর পৌঁছায় কাঁথিতে তৃণমূল কংগ্রেস সাংসদ পিতা-পুত্রের কাছে। শিশির অধিকারী এবং শুভেন্দু অধিকারী সঙ্গে সঙ্গে তৎপর হয়ে ওঠেন সিপিআইএম বাহিনীকে ঠেকাতে। তাঁরা জানতেন গড়বেতা, চন্দ্রকোণার সশস্ত্র বাহিনীর দক্ষতা।

তখন পূর্ব মেদিনীপুর জেলার পুলিশ সুপার অশোক বিশ্বাস। শুভেন্দু অধিকারীর চাপে খেজুরির দিকে রওনা দেন কাঁথির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হৃষিকেশ মিনা। তখন প্রায় সাড়ে ন’টা- দশটা বাজে। খেজুরির একটা বড়ো অংশ ততক্ষণে সিপিআইএম দখল করে ফেলেছে। তৃণমূল কংগ্রেসের বহুলোক ঘরছাড়া হয়ে গিয়েছে। প্রায় বিনা রক্তপাতে তৃণমূল কংগ্রেসের দখলে থাকা খেজুরির বিরাট অংশে তখন আবার উঠতে শুরু করেছে লাল পতাকা। এমন সময়ে নাটকীয়ভাবে খেজুরিতে প্রবেশ হৃষিকেশ মিনার নেতৃত্বে বিরাট পুলিশ বাহিনীর। মিছিলকে তাড়া করতে শুরু করে পুলিশ। তৃণমূল কংগ্রেস নেতৃত্বের কাছে যেমন খবর ছিল না সিপিআইএম বাহিনীর যাওয়ার, তেমনই সিপিআইএমের কাছেও খবর ছিল, পুলিশ যাবে না। তাই পুলিশ দেখে হকচকিয়ে যায় সশস্ত্র লোকজন। গড়বেতা, চন্দ্রকোণার সিপিআইএম নেতাদের ধারণাতেও ছিল না, তাদের সরকারের পুলিশই অস্ত্র হাতে তাড়া করবে। বরং তাঁরা জানতেন, পুলিশ বেরোবেই না, এমনই নির্দেশ আছে প্রশাসনের। প্রথমে তাঁরা ঠিক বুঝতে পারেননি, পুলিশ কী করতে চাইছে। তাঁরা ভেবেছিলেন, কিছু একটা ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে, একটু পরেই সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু অতিরিক্ত পুলিশ সুপার নিজে রিভলবার হাতে বাহিনী নিয়ে এগোচ্ছেন, এই দৃশ্য দেখার পর সিপিআইএম বুঝে যায় ব্যাপারটা অত সাধারণ নয়। এরপরই পুলিশের সঙ্গে সিপিআইএমের সশস্ত্র বাহিনীর প্রায় লড়াই শুরু হওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়ে যায় খেজুরিতে। মিছিলে থাকা সশস্ত্র লোকজনকে পুলিশ তাড়া করতে শুরু করে। সিপিআইএমের গড়বেতা, চন্দ্রকোণার বাহিনীও পালাতে শুরু করে। তারা প্রায় কেউই খেজুরির রাস্তা চিনতো না। কোনওক্রমে তারা সেখানকার দলীয় কর্মীদের সাহায্যে হলদি নদীর কাছাকাছি পৌঁছয়। তাদের ধরার জন্য পুলিশ গুলি চালায়। গড়বেতার বাহিনীকে যিনি নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন তিনি ততক্ষণে বুঝে গিয়েছেন, অবস্থা খুব খারাপ। দলের প্রায় সবার হাতেই বন্দুক রয়েছে, তার মধ্যে বেশ কয়েকটা অত্যাধুনিক। এই বন্দুক নিয়ে পুলিশের হাতে গ্রেফতার হলে পার্টির সর্বনাশ হবে। শুধু তাই নয়, গোটা পরিকল্পনা ফাঁস হয়ে যাবে। পুরো ঘটনায় জড়িয়ে পড়বেন পার্টির একাধিক প্রথম সারির নেতা এবং মন্ত্রী। সমস্ত ঘটনা আঁচ করে তিনি পালাতে পালাতেই তাঁর দলের ছেলেদের নির্দেশ দিয়েছিলেন, পুলিশকে লক্ষ্য করে পালটা গুলি চালাতে। তিনি জানতেন, তাঁরা গুলি চালালে পুলিশও কিছুটা থমকে যাবে। সেই সুযোগে তিনিও দলের নেতাদের পুরো পরিস্থিতি জানিয়ে পুলিশকে নিরস্ত করতে পারবেন। সেই মতো সিপিআইএম বাহিনী পালাতে পালাতেই পুলিশকে লক্ষ্য করে পালটা গুলি চালায়।

পড়ুন আগের পর্ব: নন্দীগ্রাম আসলে যা ঘটেছে #২৭: আগুনে পুড়ছে পরপর বাড়ি, মাথার ওপর দিয়ে গুলি উড়ে যাচ্ছে

খেজুরিতে যখন এই সব কাণ্ড ঘটছে, গুলি বিনিময় হচ্ছে হৃষিকেশ মিনার নেতৃত্বে পুলিশের সঙ্গে সিপিআইএম বাহিনীর, ঠিক সেই সময় রাজ্যের মন্ত্রী এবং গড়বেতার নেতা মহাকরণে ঢুকছেন। সেদিন কিছুক্ষণ বাদে মহাকরণের রোটান্ডায় মন্ত্রিসভায় বৈঠক। মহাকরণে ঢুকেই তিনি খেজুরি থেকে ফোনে খবর পেলেন, পুলিশ তাঁদের লোকজনকে তাড়া করেছে। বাধ্য হয়ে তাদের লোকও পালটা গুলি করেছে। এই ঘটনা জানতে পেরেই ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন তিনি। পুলিশ অ্যাকশন নেবে না, রাজ্যস্তরের সর্বোচ্চ নেতৃত্বের এই প্রতিস্রুতিতেই তিনি লোকজন পাঠিয়েছিলেন। প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হয়ে গড়বেতার ওই মন্ত্রী মহাকরণে নিজের ঘরে বসেই লিখতে শুরু করেন তাঁর পদত্যাগ পত্র। ঠিক করেন, মন্ত্রিসভার বৈঠক চলাকালীনই সেখানে ঢুকে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের হাতে পদত্যাগ পত্র দিয়ে বেরিয়ে যাবেন মহাকরণ থেকে। পদত্যাগ পত্র নিয়ে ঘর থেকে বেরোনোর আগে দু’জনকে  ফোনে একথা জানান গড়বেতার ওই মন্ত্রী। প্রথমজন তাঁরই জেলা পশ্চিম মেদিনীপুরের সিপিআইএমের শীর্ষ নেতাকে। অন্যজন সরকারের ভূমি ও ভূমি সংস্কারমন্ত্রী আবদুর রেজ্জাক মোল্লা। দু’জনের কাছেই  বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সম্পর্কে ব্যাপক গালিগালাজ করেন। পশ্চিম মেদিনীপুরের শীর্ষ নেতা বুঝে গিয়েছিলেন, ওই মন্ত্রীকে বোঝানো সম্ভব নয়। তিনি সঙ্গে সঙ্গে বিষয়টা জানান সিপিআইএমের রাজ্য সম্পাদক বিমান বসুকে। মন্ত্রিসভার বৈঠক শুরুর কয়েক মিনিট আগে বিমান বসু মহাকরণে ফোন করেন ওই মন্ত্রীকে। বিমান বসু কিছু বলার আগেই প্রচণ্ড চিৎকার করে ওঠেন পশ্চিম মেদিনীপুরের মন্ত্রী। তিনি ফোনে বলেছিলেন, ‘আপনারা কী চান…. আমি আত্মহত্যা করি? আপনাদের কথায় এতগুলো ছেলেকে পাঠালাম। একজনও যদি ধরা পড়ে যায় বা কারও কিছু হলে আমি ওদের পরিবারের কাছে মুখ দেখাতে পারব?’ এরপরেই বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে প্রচণ্ড জোরে গালিগালাজ করে বিমান বসুর ফোন কেটে দিয়েছিলেন তিনি। তিনি এত জোরে সেদিন ফোনে এই কথাগুলো বলেছিলেন, তাঁর অফিসের কয়েকজন তা শুনতেও পেয়েছিলেন। এরপর তিনি কথা বলেছিলেন তাঁর বিশেষ ঘনিষ্ঠ আবদুর রেজ্জাক মোল্লার সঙ্গে। রেজ্জাক মোল্লা তাঁকে তখনই পদত্যাগ না করতে পরামর্শ দিয়েছিলেন। রেজ্জাক মোল্লা বলেছিলেন, ‘তোমার এখন প্রথম কাজ ওই ছেলেগুলোকে ওখান থেকে বের করে আনা। পদত্যাগ করে দিলে তুমি তা করতে পারবে না। তাতে সমস্যা আরও বেড়ে যাবে।’ তিনিও বুঝতে পারেন, উত্তেজনার বশে পদত্যাগ করলে হিতে বিপরীত হবে। প্রথমত, পুরো ব্যাপারটা জানাজানি হয়ে যাবে। তাছাড়া নিজের লোকগুলোকে বের করে নিয়ে আসা অসম্ভব হয়ে উঠবে। এরপর দুপুর আড়াইটে নাগাদ মহাকরণ থেকে বেরিয়ে তিনি রওনা দিয়েছিলেন পশ্চিম মেদিনীপুরের দিকে। সেদিন আর মন্ত্রিসভার বৈঠকে যাননি, শুধু তাই নয়, তারপরও বহুদিন যোগ দেননি মন্ত্রিসভার বৈঠকে।

চলবে

(১৮ সেপ্টেম্বর থেকে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হচ্ছে নন্দীগ্রাম আসলে যা ঘটেছিল। প্রতি পর্বে লাল রং দিয়ে আগের পর্বের লিঙ্ক দেওয়া থাকছে)

Comments are closed.