নন্দীগ্রাম আসলে যা ঘটেছিল #২৯: নিরুপম সেন: ৩৪ বছর হল, আর কত বছর সরকার চালালে তোমরা খুশি হবে?

আগের পর্ব যেখানে শেষ হয়েছিল: ২০১০ সালের নভেম্বরে ফের একবার খেজুরি, নন্দীগ্রাম দখলের পরিকল্পনা করে সিপিআইএম। কিন্তু খেজুরিতে গিয়ে ২৪ নভেম্বর পুলিশের তাড়া খেয়ে পালায় সিপিআইএম বাহিনী……

২৪ নভেম্বর সিপিআইএমের গড়বেতা বাহিনী খেজুরিতে মিছিল শুরু করার পর তাদের তাড়া করতে শুরু করে পুলিশ। খবর পৌঁছাল মহাকরণে। পুলিশকে থামাতে মহাকরণে থেকে ফোন গেল পূর্ব মেদিনীপুরের পুলিশ সুপার অশোক বিশ্বাসের কাছে। খেজুরিতে পুলিশকে নিষ্ক্রিয় করার অনুরোধ জানিয়ে। ফোন করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ এক অফিসার। ততক্ষণে মহাকরণে খবর পৌঁছেছে, শুভেন্দু অধিকারী খেজুরিতে ঢুকছেন নিজেদের লোককে নিয়ে পালটা মিছিল করতে। পুলিশ সিপিআইএম ক্যাডারদের তাড়া করছে, এই পরিস্থিতিতে তমলুকের সাংসদও খেজুরিতে ঢুকে পড়েন। তাঁকে আটকানোর জন্য জেলার পুলিশ সুপারের কাছে নির্দেশ যায় মহাকরণ থেকে। কিন্তু পুলিশ সেই নির্দেশ পালন করতে অস্বীকার করে। পুলিশের তাড়া খেয়ে সিপিআইএমের লোকজন বিকেল নাগাদ খেজুরির একদম সীমানা এলাকায় পৌঁছে যায়। সেখানেও তাদের তাড়া করে পুলিশ গুলি চালায়। পালটা গুলি চালায় সিপিআইএমও। সিপিআইএমের এক প্রভাবশালী নেতা রাজ্য পুলিশের উচ্চপদস্থ অফিসারকে ফোন করে রীতিমতো হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন, ‘ফোর্সেকে গুলি চালানো বন্ধ করতে বলুন, নয়তো আমরাও গুলি চালালে ব্যাপারটা ভাল হবে না। এরপর পুলিশ সেদিনের মতো পিছু হঠেছিল। সন্ধে নামার পর সিপিআইএমের সশস্ত্র বাহিনী মাঠ, খাল পেরিয়ে নদীর ধারে গিয়ে অপেক্ষা করতে শুরু করে। নদীর অন্যদিকে শুনিয়ার চর। সেখানে তখনও সিপিআইএমের কিছুটা প্রভাব ছিল। রাতের মধ্যেই সবাইকে শুনিয়ার চরে পৌঁছে দেওয়া দেওয়ার উদ্যোগ নেন নেতারা। কীভাবে গড়বেতা, চন্দ্রকোণার এতজনকে অস্ত্রশস্ত্র সমেত খেজুরি থেকে বের করে আনা হবে তা ভেবে ঘুম ছুটে গিয়েছিল পশ্চিম মেদিনীপুর জেলা সিপিআইএমের। কারণ, এবারের পরিস্থিতি ২০০৭ সালের ১০ নভেম্বরের থেকেও খারাপ। সেবার মাস্টারদার বাহিনী খেজুরিতে আটকে পড়েছিল, কিন্তু সেই এলাকা তখন তাদের দখলেই ছিল। তাছাড়া তখন প্রশাসনের উপর দলের নিয়ন্ত্রণও ছিল অনেক বেশি। এবার এতগুলো ছেলে সকাল থেকে পুলিশের তাড়া খেয়ে নদীর ধারে গিয়ে পৌঁছেছে। মাঠে বসে আছে। তার ওপর গোটা এলাকা বিরোধীদের দখলে। পুলিশও বিরুদ্ধে।

শেষ পর্যন্ত বহু চেষ্টার পর পূর্ব মেদিনীপুর জেলার সিপিআইএমের এক নেতা প্রায় মাঝ রাতে বন্দোবস্ত করেন একটি বেসরকারি লঞ্চের। রাত দুটো নাগাদ সেই লঞ্চ গিয়ে পৌঁছায় নদীর ধারে, যেখানে সিপিআইএম বাহিনীর ৭০-৮০ জন অপেক্ষা করছিল। কিন্তু নদীর পারে তখন এত চড়া যে  লঞ্চ ঘাট পর্যন্ত যেতে পারেনি। সেখানে কোনও জেটিও ছিল না। নদীঘাটের প্রায় পাঁচশো মিটার আগে লঞ্চ জলে দাঁড়িয়ে যায়। আর এগোলে কাদায় আটকে যাবে। তারপর লঞ্চ থেকে জোরালো  আলো ফেলা হয় জলে। জলে নেমে সেই আলো অনুসরণ করে একে একে ৭০-৮০ জন গিয়ে লঞ্চে ওঠে। মাথার ওপরে হাতে বন্দুক ধরে, বুক এবং গলা পর্যন্ত জলে হেঁটে সবার লঞ্চে গিয়ে উঠতে দেড়- দু’ঘন্টা সময় লেগে যায়। ২৫ নভেম্বর ভোর সাড়ে চারটে-পাঁচটা নাগাদ সিপিআইএম বাহিনীকে নিয়ে লঞ্চ পৌঁছয় শুনিয়ার চড়ে। ২৩ তারিখ মাঝরাতে চন্দ্রকোণা থেকে রওনা দিয়ে ২৪ তারিখ ভোররাতে তারা পৌঁছেছিল খেজুরির কলাগেছিয়া পার্টি অফিসে। তারপর সকাল ১০টা  নাগাদ পুলিশের তাড়ায়  শুরু হয়েছিল পালানো। অচেনা রাস্তায় কয়েক কিলোমিটার হেঁটে, দৌড়ে আশ্রয় নদীর ধারে। তারপর গলা জলে নদীতে  হেঁটে লঞ্চে উঠে ২৫ তারিখ ভোরে শুনিয়ার চর। প্রায় ২৪ ঘন্টা কোনও খাবার নেই, পুরো ভেজা গায়ে সিপিআইএমের লোকজন কোনওক্রমে আশ্রয় নিল শুনিয়ার চরের কয়েকটি বাড়িতে।

অন্যদিকে, ২৪ তারিখ বিকেলেই গড়বেতার নেতা তথা রাজ্যের মন্ত্রী পৌঁছে যান পশ্চিম মেদিনীপুরের সিপিআইএম জেলা পার্টি অফিসে। জেলার শীর্ষ নেতার কাছে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে কিছুক্ষণের মধ্যে রওনা দিয়েছিলেন চন্দ্রকোণা রোড পার্টি অফিসের দিকে। সেদিন সন্ধ্যা থেকে ২৭ তারিখ ভোর পর্যন্ত তিনি ছিলেন সেই পার্টি অফিসেই। ২৫ তারিখ ভোরে শুনিয়ার চরে পৌঁছে গড়বেতা, চন্দ্রকোণার বাহিনী অপেক্ষা করতে থাকে নেতৃত্বের নির্দেশের। কীভাবে এতজন ফিরবে জানা নেই। পুলিশ বিভিন্ন জায়গায় অপেক্ষা করছে তাদের গ্রেফতারের জন্য। সেই সময় রাজ্যে সরকার পরিবর্তন হতে মাত্র মাস ছয়েক বাকি, স্বাভাবিকভাবেই পূর্ব মেদিনীপুর জেলা পুলিশ তখন কার্যত শুভেন্দু অধিকারীর অঙ্গুলিহেলনে চলে। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য তখন মহাকরণে মুখ্যমন্ত্রীর ভূমিকায় অভিনয় করছেন মাত্র। পুলিশ তাঁর কথা শোনে না, প্রশাসন তাঁর কথা শোনে না। অসহায় বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য নিয়ম মতো রোজ মহাকরণে যান, এই পর্যন্ত। রাজ্যের ডিফ্যাক্টো মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য সেদিন ছিলেন দিল্লিতে। তিনি তখন কেন্দ্রে দ্বিতীয় ইউপিএ সরকারের রেলমন্ত্রী। ২২ নভেম্বর চন্দ্রকোণা রোডের অফিসে যখন শেষবারের মতো খেজুরি, নন্দীগ্রাম দখলের  নীল নকশা চূড়ান্ত হচ্ছে, সেদিন তৃণমূল নেত্রী দেশের পশ্চিম প্রান্ত গোয়ার আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের উদ্বোধন করছেন। পরদিন ২৩ নভেম্বর তিনি চলে গিয়েছিলেন দিল্লি রেল দফতরের গুরুত্বপূর্ণ কাজে।

২৫ তারিখ সকাল থেকেই গড়বেতার নেতা, মন্ত্রী পুরোদমে তাঁর দলের ছেলেদের ঘরে ফেরানোর চেষ্টা শুরু করে দিয়েছিলেন। কিন্তু কোনওভাবেই উপায় খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। তিনি জানতেন, পুলিশ যেভাবে পিছনে পড়ে গিয়েছে, তাদের রাতের অন্ধকারে লুকিয়ে বের করতে হবে। আর কোনও উপায় নেই। কিন্তু কীভাবে এতগুলো ছেলেকে ফেরানো হবে? একজনও ধরা পড়ে গেলে সর্বনাশ। আরও বিপদ বন্দুক ধরা পড়লে। কোনও উপায় না দেখে ওই মন্ত্রী ফোন করলেন লক্ষ্মণ শেঠকে। বলেন, সন্ধেবেলায় একটা লঞ্চ জোগাড় করে দিতে, যাতে তিনি লোকজনকে শুনিয়ার চর থেকে বের করে আনতে পারেন। কিন্তু তমলুকের প্রাক্তন সাংসদ তা করতে পারেননি।

এরপর তিনি দক্ষিণ ২৪ পরগনার  এক সিপিআইএম নেতা এবং রাজ্য কমিটির সদস্যকে ফোন করে একই সাহায্য চেয়েছিলেন। অবস্থা বেগতিক বুঝে দক্ষিণ ২৪ পরগনার সেই নেতাও না করে দেন। ২৫ তারিখ সারা দিন চলে যায় গড়বেতা, চন্দ্রকোণার ছেলেদের শুনিয়া থেকে বের করার প্ল্যান করতে করতে। কিন্তু কাজের কাজ বিশেষ কিছুই হয়নি। দল বা সরকার কেউই যে বিষয়ে সাহায্য করবে না তা ততক্ষণে বুঝে গিয়েছিলেন ওই মন্ত্রী এবং পশ্চিম মেদিনীপুরের আরও দু’একজন শীর্ষ নেতা। এরপর তাঁরা নিজেদের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ এবং বিশ্বস্ত দু’একজন পুলিশ অফিসারের সাহায্য নিলেন গড়বেতা, চন্দ্রকোণার ছেলেদের ঘরে ফেরানোর জন্য। সেই ঘটনাও কম রোমহর্ষক নয়।

পরদিন ২৬ তারিখ সকালে পশ্চিম মেদিনীপুরের শীর্ষ নেতা ফোন করেছিলেন তাঁর অত্যন্ত পরিচিত রাজ্যের এক আইপিএস অফিসারকে। সেই আইপিএস অফিসারের নাম বা তিনি কোন পদে ছিলেন তা আমি লিখব না। কিন্তু তিনি সেদিন গভীর রাতে পুলিশের দুটো বড় প্রিজন ভ্যান পাঠিয়ে গড়বেতা, চন্দ্রকোণার প্রায় ৫০ জনকে শুনিয়া থেকে উদ্ধার করে পশ্চিম মেদিনীপুরে পৌঁছে দেন এই উদ্ধারকার্য কয়েকজন পুলিশ অফিসারের ভবিষ্যতের কথা ভেবেই বিস্তারিত লেখা সম্ভব নয়। কারণ, এই উদ্ধারকার্যে যে পুলিশ অফিসার ছিলেন তাঁরা এখনও কর্মরত। বিস্তারিত লিখলে অনেকেই বুঝে ফেলতে পারেন, কোন কোন পুলিশ অফিসার সেদিন চাকরি ঝুঁকি নিয়ে পশ্চিম মেদিনীপুরের শীর্ষ নেতাকে সাহায্য করেছিলেন। যতটা সম্ভব শুধু ততটাই লিখছি।

 

কোনওরকম উপায় না দেখে ২৬ তারিখ সকালে পশ্চিম মেদিনীপুরের শীর্ষ নেতা তাঁর খুবই কাছের এবং বিশ্বাসযোগ্য এক আইপিএস অফিসারকে ফোন করেন এবং সাহায্য চেয়েছিলেন। তিনি ততক্ষণে বুঝে গিয়েছেন, পুলিশের বিশেষ সাহায্য ছাড়া চন্দ্রকোণা, গড়বেতার ছেলেদের উদ্ধার করা যাবে না। এও বুঝেছিলেন, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের প্রশাসনের সাহায্য তাঁরা পাবেন না। আর পূর্ব মেদিনীপুর জেলায় সিপিআইএম পার্টির সাংগঠনিক অবস্থা তখন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের প্রশাসনের থেকেও খারাপ। তাদের পক্ষেও সাহায্য করা সম্ভব নয়। আর পার্টি এত জন নেতা-কর্মী তো অনন্তকাল শুনিয়ার চরে আটকে থাকতে পারেন না। সেই আইপিএস অফিসার সিপিআইএম নেতার এই প্রস্তাব শুনে প্রথমে বুঝে উঠতে পারেননি, কীভাবে সাহায্য করা সম্ভব। তারপর নিজের একদম বিশ্বস্ত ২-৩ জন অফিসারের সঙ্গে কথা বলে, দুপুর নাগাদ সিপিআইএম নেতাকে আশ্বাস দেন, গভীর রাতে তিনি রাজ্য পুলিশের দুটো খালি প্রিজন ভ্যান পাঠাতে পারেন পূর্ব মেদিনীপুরের শুনিয়ার চরের নিকটবর্তী কোনও বড়ো রাস্তায়। সিপিআইএমের ছেলেদের দ্রুত তাতে উঠে পড়তে হবে। কিন্তু কাক, পক্ষী যেন টের না পায়।

এই প্রস্তাব পাওয়ার পর সিপিআইএম নেতারা ভাবতে শুরু করেন, কীভাবে প্রায় ৫০ জনকে বড়ো রাস্তায় আনা হবে। কারণ, গোটা অপারেশনটাই করতে হবে চূড়ান্ত গোপনে। দু’একজন ছাড়া দলেরও কাউকে জানানো যাবে না। পাশাপাশি প্রশাসনেরও চোখে ধুলো দিয়ে ব্যাপারটা করতে হবে। কোনও অঘটন ঘটে গেলে সর্বনাশ হবে। বহু প্ল্যানিংয়ের পর ঠিক হয়েছিল, রাত দুটো নাগাদ রাজ্য পুলিশের দুটো বড়ো এবং খালি প্রিজন ভ্যান নন্দকুমার মোড় থেকে কাঁথি বা দিঘা যাওয়ার মেন রাস্তায় হেঁড়িয়া ছাড়িয়ে কালিনগরের কাছাকাছি একটা জায়গায় মিনিট পাঁচেকের জন্য গিয়ে দাঁড়াবে। সেই মতো শুনিয়ায় আটকে থাকা দলীয় কর্মী এবং নেতাদের সেদিন বিকেলে খবর দেওয়া হয়। ফোনে জানানো হয়, তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নিতে, সন্ধ্যার পর বেরতে হবে। কিন্তু কীভাবে ফেরা তখনও তারা কেউ জানত না।

তখন বেলা ছোট হয়ে আসছে। সন্ধে নামার পর অন্ধকার হলে, দলীয় নেতৃত্বের নির্দেশ অনুযায়ী সিপিআইএমের ছেলেরা প্রথমে শুনিয়ার চর থেকে সাঁতার কেটে নদী পার হয়। তারপর একটা ছোট খাল পার হয়ে পায়ে হেঁটে মেন রোডের দিকে রওনা দেয়। মাঠের আল ধরে কমপক্ষে ৮-১০ কিলোমিটার হেঁটে তারা মেন রোডে পৌঁছানোর কিছুটা আগে অন্ধকারের অপেক্ষা করতে থাকে। প্রিজন ভ্যান দুটো কাছাকাছি পৌঁছলে তাদের কাছে ফোন যায় মেন রোডে যাওয়ার জন্য। সেই সঙ্গে চন্দ্রকোণার ওই নেতাকে ফোনে জানানো হয় প্রিজন ভ্যানের নম্বর। খবর পেয়ে তারা দ্রুত হেঁটে মেন রোডে গিয়ে দাঁড়ায়। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সেখানে পৌঁছে যায় কয়েদি নিয়ে যাওয়ার দুটো প্রিজন ভ্যান। রাস্তার ঘন অন্ধকারে ভ্যান থামতেই পাঁচ মিনিটের মধ্যে দুটো গাড়িতে ২৪-২৫ জন করে উঠে পড়ে। প্রিজন ভ্যানের বেঞ্চে না বসে নীচে শুয়ে পড়ে তারা। তারপর দুটো প্রিজন ভ্যান এগরার রাস্তা ধরে রওনা দেয় পশ্চিম মেদিনীপুরের দিকে। ২৭ তারিখ ভোর সাতটা নাগাদ সিপিআইএম সশস্ত্র বাহিনীকে নিয়ে প্রিজন ভ্যান দুটো পৌঁছেছিল সিপিআইএমের চন্দ্রকোণা রোড পার্টি অফিসে। সেখানে মুহূর্তের মধ্যে তাদের নামিয়ে প্রিজন ভ্যান দুটো চলে যায়। তাদের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করাই ছিল। গড়বেতার নেতা তথা রাজ্যের মন্ত্রী তাদের সঙ্গে কথা বলে সকাল আটটা নাগাদ বাড়ি ফিরেছিলেন।

ওই মন্ত্রী ২৪ নভেম্বর দুপুরে মহাকরণ থেকে বেরিয়ে রওনা দিয়েছিলেন নিজের জেলায়। কিছুক্ষণ মেদিনীপুর শহরে থেকেই সন্ধেবেলা চলে গিয়েছিলেন চন্দ্রকোণা রোড পার্টি অফিসে। তারপর টানা ৬০ ঘণ্টার বেশি ছিলেন পার্টি অফিসে বসে। অনবরত চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছেন দলের কর্মী, নেতাদের পূর্ব মেদিনীপুর থেকে উদ্ধার করে এলাকায় ফেরানোর। সেই অভিযানে খেজুরি, নন্দীগ্রাম উদ্ধার করতে পারেনি সিপিআইএম। বরং তা উদ্ধার করতে গিয়ে নিজেরাই বন্দি হয়ে গিয়েছিল প্রশাসনের হাতে। যে পুলিশ প্রশাসন তিন বছর আগে যতটা সম্ভব নিষ্ক্রিয় থেকে সিপিআইএম বাহিনীকে সাহায্য করেছিল নন্দীগ্রামে ‘সূর্যোদয়’ ঘটাতে, সেই প্রশাসনই ২০১০ সালের শেষে এসে  রুখে দাঁড়াল শাসক দলের বিরুদ্ধে। ২০১১ বিধানসভা ভোটের দেওয়াল লিখন তখনই পড়ে ফেলেছিলেন মুজফফর আহমেদ ভবনের বাস্তবজ্ঞান সম্পন্ন নেতারা।

 

২০১১ বিধানসভা নির্বাচন এবং সিপিআইএম সরকারের পতন 

রাজ্যে ছয় দফার বিধানসভা নির্বাচন শুরু হয়ে গিয়েছে। বর্ধমান জেলার পার্কাস রোডের পার্টি অফিস। তিন-চার দিন বাদেই বর্ধমান জেলার ভোট। পার্টি অফিসে উপস্থিত নিরুপম সেন। তিনি বর্ধমান শহরের একটি বিধানসভা কেন্দ্রের প্রার্থীও। সবে প্রচার শেষ করে পার্টি অফিসের দোতালায় ঘরে এসে বসেছেন। তাঁর চারপাশের জেলার একাধিক শীর্ষ নেতা। ক’দিন আগেই এবিপি আনন্দ চ্যানেলে দেখানো হয়েছে ২০১১ সালের টানটান বিধানসভা নির্বাচন নিয়ে এসি নিয়লসন-এবিপি আনন্দর ওপিনিয়ন পোল। সেই ওপিনিয়ন পোল জানিয়েছিল, পর্যুদস্ত  হবে  সিপিআইএমের নেতৃত্বে বামফ্রন্ট। সাকুল্যে ৭০-৭২টা আসন পাবে। এই ওপিনিয়ন পোল নিয়ে তখন রাজ্যজুড়ে চর্চা। বিশেষ করে যে কোনও সিপিআইএম নেতা সঙ্গে দেখা কিংবা কথা হলে তাঁদের মুখে তখন একটাই প্রশ্ন, এটা আপনারা কী দেখালেন? এই রেজাল্ট অসম্ভব।

বর্ধমানের পার্টি অফিসে এবিপি আনন্দ’র ওপিনিয়ন পোল নিয়ে সেদিন সন্ধ্যায় নিরুপম সেনের সঙ্গে কথা হয়েছিল দু’একজন পার্টি নেতার। সবাইকে চমকে দিয়ে সিপিআইএমের পলিটব্যুরো সদস্য নিরুপম সেন বলেন, ‘এসি নিয়েলসনের ওপানিয়ন পোলের সঙ্গে আমি একমত। আমাদের পরাজয় হবে।’ সঙ্গে সঙ্গে জেলার এক শীর্ষ নেতা বলেন, ‘কী বলছেন আপনি? মিটিংয়ে, মিছিলে এত লোক আসছে। এত বড়ো বড়ো সমাবেশ হচ্ছে। শুধু বর্ধমান জেলাতেই আমরা অন্তত ১৭ টা আসন পাব।’

নিরুপম সেন পালটা জবাব দিয়েছিলেন, ‘তোমাদের ধারণার সঙ্গে আমি একমত নই। আমাদের রেজাল্ট খুব খারাপ হবে। আবার সরকার করতেই হবে এই ধারণা থেকে পার্টির এক্কেবারে সর্বক্ষণের কর্মী, নেতারা পরিবারের লোকজনকে নিয়ে মিটিং, মিছিলে আসছে। তাই তোমাদের মনে হচ্ছে, কর্মসূচিতে প্রচুর লোক হচ্ছে। সাধারণ মানুষ কিন্তু আসছে না আমাদের কর্মসূচিতে। আর সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ পুরো চুপ হয়ে গেছে, কোনও কথা বলছে না। এটা আরও খারাপ। তাই বলছি আমাদের রেজাল্ট খুব খারাপ হবে। তাছাড়া আর কতদিন সরকারে থাকলে তোমরা খুশি হবে? ৩৪ টা বছর! আর কত বছর ক্ষমতায় থাকতে চাও তোমরা?’  শুধু তাই নয়, তিনি নিজেও যে হেরে যাবেন তাও দলের নেতাদের সঙ্গে একান্ত আলোচনায় বলেছিলেন নিরুপম সেন।

নিরুপম সেনের এই স্পষ্ট ভবিষ্যদ্বাণী শুনে হতবাক হয়ে গিয়েছিলেন হরেকৃষ্ণ কোঙারের জেলার নেতারা। সেদিনের সপ্তাহ দু’য়েক বাদেই বিধানসভা নির্বাচনের রেজাল্ট  বেরোয়। ২৩৫ থেকে ৬২ আসনে নেমে এল বামফ্রন্ট। গোটা বিশ্বের সংসদীয় গণতন্ত্রের ইতিহাসে নজিরবিহীন রেকর্ড স্থাপনের পর থেমে গেল প্রবল পরাক্রান্ত সিপিআইএমের বিজয় রথ। যে রথের চাকা চার বছর আগে নন্দীগ্রামের মাটিতে বসে গিয়েছিল তা আর শত সাধ্যসাধনা করেও টেনে তুলতে পারলো না মুজফফর আহমেদ ভবন।

এই লেখাকে আর দীর্ঘায়িত করতে আমি চাই না। পাঠকের ধৈর্যের পরীক্ষা নেওয়ারও আর ইচ্ছে নেই আমার। শুধু ছোট্ট একটা ঘটনা উল্লেখ করে এই লেখা শেষ করব।

আসলে এত অসংখ্য টুকরো টুকরো ঘটনা সিপিআইএম সরকারের বিদায়ের আগে দেখেছি, শুনেছি এবং  যার মাত্র সামান্য কিছুই উল্লেখ করেছি এই লেখায়। অথচ সব সময় মনে হয়েছে, প্রতিটা ঘটনাই নিজগুণে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ এবং টানা ৩৪ বছরের সিপিআইএম সরকার পতনের বহুমাত্রিক কারণের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

২০০৮ সালের অক্টোবরের একদম শুরু। দুর্গাপুজোর ঠিক মুখে টাটা গোষ্ঠীর কর্ণধার রতন টাটা ঘোষণা করলেন, সিঙ্গুরে প্রকল্প তাঁরা বাতিল করেছেন। সন্ধে সাড়ে সাতটা নাগাদ এই ঘোষণা হল দক্ষিণ কলকাতার এক পাঁচতারা হোটেলে। তার আগে রতন টাটা দুপুরে কলকাতায় এসে মহাকারণে দীর্ঘ মিটিং করেছেন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সঙ্গে। রতন টাটার এই ঘোষণা তো শুধুমাত্র একটা গাড়ি কারখানার এরাজ্য ছেড়ে চলে যাওয়ার মতো বিষয় নয়। শুধুমাত্র পশ্চিমবঙ্গের গায়ে শিল্পবিরোধী তকমা এঁটে যাওয়ার ব্যাপার নয়। রাজ্যের ভবিষ্যতের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটা রতন টাটা তুলে দিয়েছিল সেদিন। সেই প্রশ্নটা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সরকার এবং প্রশাসনের  যোগ্যতা নিয়ে। সরকার এবং প্রশাসনের মেধা, দক্ষতা, দূরদর্শিতা নিয়ে। ২৯৪ এর মধ্যে ২৩৫ আসন পাওয়া যে সরকার মাত্র ৯৯৭ একর এলাকায় একটা কারখানা করার মতো পরিবেশ, পরিস্থিতি সুনিশ্চিত করতে পারে না, সে কি আদৌ রাজ্য চালানোর জন্য উপযুক্ত? এই সরকার, প্রশাসনের হাতে কি গোটা রাজ্য, রাজ্যের সাধারণ মানুষ এবং তাদের জীবন-জীবিকা নিরাপদ? সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে মহাকরণে বসে থাকা মানেই কি এই মৌলিক, গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নগুলোর সমাধান হয়ে যাওয়া? আমি বারবারই মনে করেছি, তা একেবারেই নয়। বরং প্রশাসন নেই, নির্বাচিত সরকার আছে, এই প্রবণতা সার্বিক সমাজের পক্ষে আরও বিপদজনক।

একইভাবে আমি ব্যরাবর মনে করেছি, সিপিআইমের নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্ট সরকারের ৩৪ বছর পর পতনের প্রধানতম কারণ নন্দীগ্রাম। যে নন্দীগ্রাম প্রশাসনিক এবং রাজনৈতিকভাবে বেআব্রু করে দিয়েছিল সিপিআইএমকে। যে নন্দীগ্রাম প্রথম দেখিয়েছিল ঐক্যবদ্ধ লড়াই দিয়ে  দিনের দিন সিপিআইএমের মতো সংগঠিত দলকেও ঠেকিয়ে রাখা যায়। নন্দীগ্রামই এরাজ্যে প্রথম দেখিয়েছিল, মহাকরণ বা আলিমুদ্দিন স্ট্রিটের নির্দেশ মানতে অস্বীকার করতে পারেন থানার ওসিও। আর এই কারণেই নন্দীগ্রামে ২০০৭ সালের জানুয়ারি মাস থেকে ২০০৮ সালের পঞ্চায়েত ভোট পর্যন্ত যা নিজের চোখে দেখেছি তা পর পর ঘটনার আকারে লিপিবদ্ধ করার চেষ্টা করেছি। এই লেখা কোনও সাহিত্য চর্চা নয়, নন্দীগ্রাম আসলে যা ঘটেছিল তা আসলে আমার নিজের দেখা-শোনা সমস্ত ঘটনার এক বিবরণ মাত্র।

এই লেখা শেষ করব এক ঘটনা দিয়ে।

টাটা মোটর্সের সিঙ্গুর থেকে ছোট গাড়ির কারখানা সরিয়ে নেওয়ার সরকারি ঘোষণা হয়ে যাওয়ার কয়েকদিন বাদে ৩১ আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে সিপিআইএমের রাজ্য কমিটির বৈঠক। প্রায় ৯০ শতাংশ কাজ হয়ে যাওয়ার পরও গাড়ি কারখানা চলে যাওয়ার শোকে মুহ্যমান পার্টির নেতারা একে অন্যকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন। আর সমানে চলেছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে  লাগামছাড়া দোষারোপ। কোনও কোনও ভবিষ্যতদ্রষ্টা নেতা নিদান দিলেন, এতদিনে মমতাকে কাবু করার রেডিমেড ওষুধ পাওয়া গেছে। তৃণমূল কংগ্রেসের গায়ে শিল্পবিরোধী, উন্নয়নবিরোধী লেবেল সেঁটে দিতে হবে ধারাবাহিক প্রচারে। তবেই শহর, মফস্বল এমনকী গ্রামেরও মধ্যবিত্ত, উচ্চ-মধ্যবিত্ত মানুষ পঙ্গপালের মতো ছুটে আসবে সিপিআইএমের ছাতার তলায়। এই নানান আলোচনার মাঝে এক রাজ্য কমিটির সদস্য এবং মন্ত্রী প্রস্তাব দিলেন, ‘আর এক মুহূর্ত আমাদের সরকারে থাকা উচিত নয়। এখনই পদত্যাগ করুন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। রাজ্যপালের কাছে ইস্তফাপত্র পাঠিয়ে দিন। তারপর সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে কিংবা সমাবেশ করে রাজ্যের মানুষকে জানিয়ে দিন, আমরা যে কর্মসূচির কথা ঘোষণা করে, শিল্পায়নের কথা বলে দু’বছর আগে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকারে এসেছিলাম, তা করতে পারিনি। তাই পদত্যাগ করছি এবং আবার রাজ্যবাসীর কাছে নতুন জনাদেশ চাইছি।’

রাজ্য কমিটির বৈঠকে যিনি এই প্রস্তাব দিয়েছিলেন তাঁর নাম কান্তি গঙ্গোপাধ্যায়। দক্ষিণ ২৪ পরগনার নেতা। তাঁর আর একটা পরিচয়, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য তাঁকে একেবারেই পছন্দ করতেন না। কান্তি গঙ্গোপাধ্যায়ের এই প্রস্তাবের পেছনে দুটো কারণ ছিল। প্রথমটা, নিখাদ বিবেক দংশন। তিনি বুঝেছিলেন এ রাজ্য সরকার প্যারালিসিসে চলে যাচ্ছে। বিরোধীদের বাধায় কাজই করতে না পারলে মন্ত্রীর চেয়ারে বসে থাকার মানে কী? দ্বিতীয় কারণটা, একশো শতাংশ রাজনৈতিক কৌশল। তিনি মনে করেছিলেন, রাজ্যের মানুষের মেরুকরণ তখনও সম্পূর্ণ হয়নি, বরং মানুষের মধ্যে কিছুটা বিভ্রান্তি, ধোঁয়াসা রয়েছে পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে। এই অবস্থায় ২০০৯  লোকসভা ভোটের সঙ্গে রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনে চলে গেল রেজাল্ট অনেকটাই সম্মানজনক হবে। শিল্পায়নকেই ফোকাস করে নির্বাচনে লড়লে ভরাডুবিটা আটকানো যাবে।

পড়ুন আগের পর্ব: নন্দীগ্রাম আসলে যা ঘটেছিল: দ্বিতীয় হুগলি ব্রিজে গাড়ি থেকে নামলেন মমতা ব্যানার্জি! এক পায়ে চটি, অন্য পায়ে নেই

কিন্তু কান্তি গঙ্গোপাধ্যায়ের এই বেয়ারা প্রস্তাব স্বাভাবিকভাবেই ধর্তব্যের মধ্যে আনেননি সিপিআইএমের শীর্ষ নেতৃত্ব। ফলে তা নিয়ে পরবর্তীকালে দলের মধ্যে কোনও আলোচনাও হয়নি। তার একটা বড়ো কারণ, মুজফফর আহমেদ ভবন বুঝতেই পারেনি, পাহাড়ের চূড়া থেকে পাথর একবার গড়াতে শুরু করলে তা যত নীচে নামবে ততই তার গতি বাড়বে। আর এই পাথরটা গড়াতে শুরু করে দিয়েছিল বহু বছর বাদে। যার প্রথম স্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়েছিল পঞ্চায়েত নির্বাচন ২০০৮। সিপিআইএমের সামান্য কিছু নেতা মনে করেছিলেন, পাথরটার গড়ানো আটকানো যাবে। আর অধিকাংশ নেতা তো মানতেই চাননি, নন্দীগ্রাম আন্দোলন এবং তাকে কেন্দ্র করে তাদের রাজনৈতিক প্রশাসনিক এবং সাংগঠনিক বিপর্যয় ভবিষ্যতে কী আকার নিতে চলেছে।

আমি বারবারই বিশ্বাস করে এসেছি, কান্তি গঙ্গোপাধ্যায় পার্টির অন্দরে সঠিক প্রস্তাবই দিয়েছিলেন ২০০৮ সালের শেষে। ২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে বামফ্রন্ট ১৫ টি আসনে জিতেছিল। রাজ্যের মোট ৯৯ টি বিধানসভা কেন্দ্রে বিরোধীদের তুলনায় এগিয়ে ছিলেন সিপিআইএমের নেতৃত্বে বামফ্রন্ট প্রার্থীরা। কিন্তু দু’বছর বাদে ২০১১  বিধানসভা নির্বাচনে এই ৯৯ টি বিধানসভা আসন নেমে এসেছিল ৬২ টিতে। আর বিষয়টা শুধুমাত্র বামফ্রন্টের  কম আসন পাওয়া কিংবা সিপিআইএমের বিপর্যস্ত হওয়ার মধ্যে আটকে ছিল না, কান্তি গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রস্তাব সেদিন গৃহীত হলে টানা দু’বছরেরও বেশি সময় ধরে রাজ্যের মানুষকে প্রশাসনহীন সরকারের অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হোত না।

 

শেষ

Comments are closed.