Hydroponics Farming কী? কেন এই পদ্ধতিকে কৃষির ভবিষ্যত বলা হচ্ছে?

জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে আবাদি জমির পরিমাণ কমছে। বর্ধিত চাহিদা পূরণে প্রয়োজন হচ্ছে অতিরিক্ত খাদ্য। এদিকে দূষণ মাত্রা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পাওয়া পৃথিবীতে কীটনাশক প্রয়োগ করে যে ফসল ফলানো হচ্ছে তাতে রয়েছে ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা। তাছাড়া এই জৈব চাষের রমরমার সময়ে যে আপনি স্বাস্থ্যকর এবং জৈব খাদ্য গ্রহণের চেষ্টা করছেন, সেটি কতটা পরিবেশ বান্ধব সে প্রশ্নও থেকে যায়। এই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে আজ hydroponic agriculture হয়ে উঠছে ভবিষ্যতের দিশারি।

 

Hydroponics পদ্ধতিতে চাষ কী কেমন?

হাইড্রোপনিক (Hydroponic) একটি অত্যাধুনিক কৃষি পদ্ধতি। অতি লাভজনক ফসলের ক্ষেত্রে এই পদ্ধতিতে নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে মাটির পরিবর্তে (soilless farming) জলে গাছের প্রয়োজনীয় খাবার (Nutrient) সরবরাহ করে ফসল উৎপাদন করা হয়। জনবহুল দেশ যেখানে স্বাভাবিক চাষের জমি কম সেখানে বাড়ির ছাদ, উঠোন, পলি টানেল এবং নেট হাউজে হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে সবজি ও ফল উৎপাদন হয়।

আমেরিকা, জাপান, তাইওয়ান, চিন, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়ার মতো দেশে বাণিজ্যিকভাবে Hydroponic agriculture এর মাধ্যমে সবজি ও ফল উৎপাদন করা হয়। এই চাষে সবচেয়ে বড় সুবিধা হল সারা বছরই চাষ করা যায় এবং উৎপাদিত ফসলে কোনও কীটনাশক ব্যবহার করতে হয় না। তার চেয়েও বড় কথা, মাটি ছাড়াই ভিন্ন মাধ্যমে ফসল উৎপাদন করে খাদ্যের চাহিদা পূরণ করা যে সম্ভব, সেই পথ দেখিয়েছে হাইড্রোপনিক পদ্ধতি। অনুর্বর এবং উপকূলীয় লবণাক্ত এলাকার জায়গায় নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে যেমন এই পদ্ধতিতে ফসল উৎপাদন করা যাবে তেমনি ঝাঁ চকচকে শহরের বদ্ধ জায়গায় উচ্চমূল্যের ফসল উৎপাদন করে লাভবান হওয়া সম্ভব। এটি পরিবেশবান্ধব এবং এই পদ্ধতির চাষে কীটপতঙ্গের আক্রমণ কম বলে ফসলে কোনো পেস্টিসাইড বা কীটনাশক ব্যবহারের প্রয়োজন হয় না। ফলে উৎপাদিত ফসলে কোনো বিষাক্ত প্রভাব থাকে না।

এই পদ্ধতির চাষ যে একেবারে নতুন তা বলা যাবে না। অনেক আগে থেকেই hydroponic cultivation চলে আসছে। তবে বর্তমানে সেখানে প্রযুক্তির ব্যবহারে তা হয়ে উঠেছে আরও উন্নত। যেসব অঞ্চলে দীর্ঘদিন জল জমে থাকে সেখানে ভাসমান জৈব বেডে এই পদ্ধতিতে সীমিত পরিসরে চাষবাস হয়ে আসছে। তবে প্রচলিত পদ্ধতির উন্নয়নের জন্যও আধুনিক হাইড্রোপনিক পদ্ধতি সম্পর্কে জানা দরকার। মনে রাখা প্রয়োজন যে ভাসমান চাষ পদ্ধতি বর্তমান প্রযুক্তি নির্ভর হাইড্রোপনিক পদ্ধতি থেকে আলাদা।

 

চাষের পদ্ধতি (Process of Hydroponics Farming)

hydroponic agriculture

 

হাইড্রোপনিক পদ্ধতি হচ্ছে মাটিবিহীন ফসল ও সবজি চাষের পদ্ধতি।

এ পদ্ধতির মূলনীতি হল নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে গাছের অত্যাবশ্যকীয় প্রয়োজনীয় খাদ্য উপাদান জলের মধ্যে সরবরাহ করে প্লাস্টিকের ট্রে, বালতি বা বোতলে ফসল উৎপাদন করা।

হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে আবাদি জমির কোনও প্রয়োজন নেই। যে কোনও ফাঁকা জায়গায় ফসল চাষ করা যায়। নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে সারা বছর সবজি, ফল ও ফুল চাষাবাদ করা সম্ভব হয়।

 

হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে যেসব ফসল উৎপাদন করা যায়

প্রয়োজনীয় প্রায় সব শাক- সবজি ও ফলমূল হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে চাষ করা যায়।

যেমন, পাতা জাতীয় সবজির মধ্যে আছে লেটুস, গিমা, কলমি, বিলাতি ধনেপাতা, বাঁধাকপির চাষ। ফল জাতীয় সবজির মধ্যে রয়েছে টম্যাটো, বেগুন, ক্যাপসিকাম, ব্রোকোলি, ফুলকপি, শসা, মেলন, স্কোয়াস ইত্যাদি। ফলের মধ্যে রয়েছে স্ট্রবেরীর চাষ। তাছাড়া ফুল চাষও সম্ভব। গাঁদা, গোলাপ, অর্কিড, জারবেরা, চন্দ্রমল্লিকা ইত্যাদি ফুলের চাষ করা যায় হাইড্রপনিক পদ্ধতিতে।

 

হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে চাষের সুবিধা (Benefits of Hydroponics Farming)

hydroponic cultivation

 

আগেই বলা হয়েছে এই চাষে মাটির প্রয়োজন হয় না, আবাদি জমিরও দরকার হয় না। সবচেয়ে বড় সুবিধা এটাই। প্লাস্টিকের তৈরি চারকোনা বাক্সে জল ব্যবহার করে বাড়ির ছাদ, বারান্দা এবং খোলা জায়গায় ফসল উৎপাদন করা যায়। এটি মাটিবিহীন চাষ পদ্ধতি হওয়ায় মাটিবাহিত রোগ ও কৃমিজনিত রোগ হয় না। তাই নিশ্চিন্তে চাষ করা যায়। নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে সারাবছর ফসল ফলানো যায়। কীটপতঙ্গের আক্রমণ কম হওয়ায় এই পদ্ধতিতে বিষমুক্ত সবজি উৎপাদন করা যায়।

সুবিধা ও সামর্থ্য অনুযায়ী ছোট ও বড় পরিসরে স্বাস্থ্যসম্মত এবং পরিচ্ছন্নভাবে ফসল উৎপাদন করা যায় এই পদ্ধতিতে। অর্থাৎ, হাইড্রোপনিক পদ্ধতির চাষ হল লাভজনক, অর্থকরী এবং পরিবেশ ও স্বাস্থ্যের পক্ষে নিরাপদ।

 

হাইড্রোপনিক ব্যবহার পদ্ধতি

দুই উপায়ে হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ করা যায়।

১) সঞ্চালন পদ্ধতি (Circulating System) এবং

২) সঞ্চালন বিহীন পদ্ধতি (Non Circulating System)

সঞ্চালন পদ্ধতি (Circulating System): এই পদ্ধতিতে গাছের অত্যাবশ্যকীয় খাদ্য উপাদানসমূহ যথাযথ মাত্রায় মিশিয়ে একটি ট্যাঙ্কের মধ্যে নেওয়া হয়। এরপর পাম্পের সাহায্যে ট্রেতে পুষ্টি দ্রবণ (Nutrient Solution) সঞ্চালন করে ফসল উৎপাদন করা হয়। প্রতিদিন অন্ততপক্ষে ৭ থেকে ৮ ঘন্টা পাম্পের সাহায্যে এই সঞ্চালন প্রক্রিয়া চালু রাখতে হয়। প্রাথমিকভাবে প্রথম বছর ট্রে, পাম্প এবং পাইপের আনুসাঙ্গিক খরচ একটু বেশি হলেও পরবর্তী বছর থেকে শুধু রাসায়নিক খাদ্য উপাদানের খরচ প্রয়োজন হয়। ফলে চাষের দ্বিতীয় বছর থেকে খরচ অনেকটাই কমে যায়।

সঞ্চালনবিহীন পদ্ধতি (Non-Circulating System)ঃ এই পদ্ধতিতে একটি ট্রেতে গাছের প্রয়োজনীয় খাদ্য উপাদান পরিমিত মাত্রায় সরবরাহ করে সরাসরি ফসল উৎপাদন করা হয়। খাদ্য উপাদান সরবরাহের জন্য কোনও পাম্প বা জল সঞ্চালনের প্রয়োজন হয় না। এক্ষেত্রে খাদ্য উপাদান মিশ্রিত দ্রবণ ও তার উপর কর্কশীটের  মাঝ বরাবর ৫-৭ সেমি জায়গা ফাঁকা  রাখতে হবে এবং কর্কশীটের উপরে ৪-৫ টি ছোট ছোট ছিদ্র করে দিতে হবে যাতে সহজেই বাতাস চলাচল করতে পারে। এতে গাছ কর্কশীটের ফাঁকা জায়গা থেকে তার প্রয়োজনীয় অক্সিজেন সংগ্রহ করতে পারে। ফসলের প্রকারভেদে সাধারণত ২-৩ বার এই খাদ্য উপাদান ট্রেতে যোগ করতে হয়। এই পদ্ধতিতে কোনও বৈদ্যুতিক মোটর, পাম্প বা পাইপ ব্যবহারের প্রয়োজন হয় না। প্লাস্টিক বালতি, বোতল ইত্যাদি ব্যবহার করে বাড়ির ছাদ, বারান্দা এবং খোলা জায়গায় সঞ্চালনবিহীন পদ্ধতিতে সবজি উৎপাদন করা যায়। এতে খরচ তুলনামূলকভাবে কম।

 

হাইড্রোপনিক পদ্ধতির অসুবিধা

১) হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে দ্রবণ প্রস্তুতি, দ্রবণের অম্লত্ত ও ক্ষারত্ব, Electric Conductivity (EC), বিভিন্ন খাদ্যোপাদানের অভাবজনিত লক্ষণ সনাক্তকরণ ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য দরকার কৃষিকাজে দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা।

২) এই পদ্ধতির চাষে কখনও নেটহাউজ বা গ্লাসহাউজের প্রয়োজন হয় যা বেশ খরচসাপেক্ষ। নেটহাউজ বা গ্লাসহাউজের ভিতরের তাপমাত্রা বেশি হওয়ার কারণে ফলন কমেও যেতে পারে।

৩) হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে সব ধরনের ফসল চাষ করা যায় না। এই পদ্ধতির চাষে কারিগরি জ্ঞান, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা বিশেষ প্রয়োজন।

 

হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে ফসল উৎপাদনের সতর্কতা

soilless farming

 

হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে ফসল উৎপাদনের জন্য বেশ কয়েকটি বিষয়গুলির উপর বিশেষভাবে নজর রাখতে হবে।

১) সাধারণত PH এর মাত্রা ৫.৮- ৬.৫ এবং EC এর মাত্রা ১.৫- ২.৫ ds/m এর মধ্যে রাখতে হবে। এই মাত্রার বাইরে চলে গেলে গাছের শিকড় ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। হঠাৎ জলীয় খাদ্য দ্রবণের PH এবং EC পরিবর্তন করা চলবে না।

২) গাছের খাদ্য উপাদানের প্রয়োজনীয়তা, স্বল্পতা, কিংবা আধিক্য গাছের স্বাস্থ্য ও পাতার রং দেখে বোঝা যায়। খাদ্য উপাদানের লক্ষ্যণ দেখে বোঝা এবং প্রয়োজন অনুযায়ী সেই অভাব পূরণ করতে হয়। এ জন্য প্রতিটি উপাদানের অভাব জনিত উপসর্গ সম্পর্কে জ্ঞান থাকতে হবে।

৩) দ্রবণের আদর্শ তাপমাত্রা রক্ষণাবেক্ষণ করতে হবে। দ্রবণের তাপমাত্রা বেড়ে গেলে শ্বসনের হার এবং অক্সিজেনের চাহিদাও বৃদ্ধি পায়। ফলে দ্রবণের অক্সিজেনের পরিমাণ কমে যায়। জলীয় খাদ্য দ্রবণে অতিরিক্ত অক্সিজেন সরবরাহের ব্যবস্থা করতে হবে। কারণ অক্সিজেনের অভাবে গাছের শিকড় নষ্ট হলে ফলন কমে যাবে।

৪) চাষের জায়গায় পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা করতে হবে এবং রোগমুক্ত চারা ব্যবহার করতে হবে। কোনও রোগাক্রান্ত গাছ দেখা গেলে সঙ্গে সঙ্গে তা তুলে ফেলে দিতে হবে।

এই সতর্কতার দিকে খেয়াল রেখে হাইড্রোপনিক পদ্ধতিতে চাষ করলে বিপুল লাভের সম্ভাবনা। ভারতের মতো জনবহুল দেশে যেখানে চাষের জমির পরিমাণ ক্রমশ কমে আসছে সেখানে কৃষির ভবিষ্যৎ হতে চলেছে Hydroponics Farming পদ্ধতি।

Comments are closed.