মুসলমান, দলিত, আদিবাসীর ওপর ঘৃণাজনিত হিংসার ঘটনা বাড়ছে দেশে, রিপোর্ট অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের।

ঘৃণা এবং বিদ্বেষজনিত হিংসার ঘটনা দেশে উদ্বেগজনকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। মূলত দলিত, ধর্মীয় সংখ্যালঘু, আদিবাসী এবং পিছিয়ে পড়া সম্প্রদায়ের পুরুষ-মহিলা ঘৃণাজনিত কারণে দেশজুড়ে ব্যাপকভাবে আক্রান্ত হচ্ছেন। এই মারাত্মক তথ্য উঠে এল মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সাম্প্রতিকতম এক রিপোর্টে।

অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল জুলাই মাসে যে রিপোর্ট প্রকাশ করেছে, তা অনুযায়ী ২০১৮ সালের প্রথম ছ’মাসে দেশে ১০০ টি ঘৃণাজনিত হিংসার ঘটনা ঘটেছে। এই ধরনের হিংসা এবং আক্রমণের শিকার মূলত ধর্মীয় সংখ্যালঘু, পিছিয়ে পড়া জনজাতি, দলিত, আদিবাসী, ট্রান্সজেন্ডারসহ সমাজের প্রান্তিক মানুষ। তাদের ওপর আক্রমণের ঘটনা লাগাতার বাড়ছে। মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের ভারতীয় শাখার এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর আকর প্যাটেল জানিয়েছেন, ‘শুধুমাত্র ঘোড়ায় চড়ার জন্য দলিতকে কিংবা গরু হত্যার গুজবকে কেন্দ্র করে মুসলমানকে খুন করা হচ্ছে। দলিত মহিলাকে ধর্ষণ করা হচ্ছে, পুড়িয়ে হত্যা করা হচ্ছে’। তিনি আরও জানান, এবছর জানুয়ারি থেকে জুন মাস পর্যন্ত গোটা দেশে ঘৃণাজনিত সেই ঘটনাগুলিই তাঁরা লিপিবদ্ধ করেছেন, যেগুলি সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। বহু ঘটনা দেশের নানা প্রান্তে ঘটছে, যা সংবাদমাধ্যমের নজরেও আসছে না’।
বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনের উপর ভিত্তি করে তৈরি হওয়া অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের এই রিপোর্ট অনুযায়ী, এবছর প্রথম ছয় মাসে দলিতদের উপর ৬৭ টি, মুসলমানদের উপর ২২ টি এরূপ হিংসার ঘটনা ঘটেছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, মহিলাদের উপর যৌন অত্যাচারের ঘটনাও বেশ উদ্বেগজনক। গত কয়েক বছরের মতো এবারও এই ঘৃণাজনিত হিংসার তালিকার শীর্ষে রয়েছে উত্তর প্রদেশ। এছাড়াও তালিকার উপরের দিকে রয়েছে গুজরাত, রাজস্থান, বিহার, তামিলনাড়ু্র নাম। এবছর প্রথম ছ’মাসে যে ১০০ টি ঘৃণাজনিত ঘটনা উল্লিখিত হয়েছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের রিপোর্টে, তার মধ্যে মুসলমান, দলিত এবং আদিবাসী মিলে ৪২ জন মানুষ খুন হয়েছেন।
রিপোর্টে বলা হয়েছে, ২০১৫ সালে উত্তর প্রদেশের দাদরিতে গো-হত্যাকারী সন্দেহে মহম্মদ আখলাক নামে এক ব্যক্তিকে খুনের যে অভিযোগ উঠেছিল, তারপর থেকে কম পক্ষে ৬০৩ টি এমন ঘৃণা বা বিদ্বেষজনিত হিংসার ঘটনা ঘটেছে দেশে। যার অধিকাংশই গো-রক্ষা সম্পর্কিত। রিপোর্টে বলা হয়েছে, এরকম বিভিন্ন ঘটনা দেশজুড়ে ঘটলেও অনেক ক্ষেত্রেই তা সামনে আসে না। সব ক্ষেত্রে অপরাধীরা শাস্তিও পায় না। তাই পুলিশের উচিত সঠিকভাবে তদন্ত করা এবং নিগৃহীতরা যেন সুবিচার পান সে দিকে নজর দেওয়া।

এই রিপোর্টে ২০১৫, ২০১৬ এবং ২০১৭ সালেরও দেশজুড়ে ঘটে যাওয়া হিংসাত্মক ঘটনার পরিসংখ্যান দেওয়া হয়েছে। তাতে দেখা যাচ্ছে, ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশে এধরনের ঘটনা ঘটেছে ৫১ টি। ২০১৬ ও ২০১৭ সালে ঘটে যাওয়া এই ধরনের হিংসার সংখ্যা দুই শতাধিকেরও উপরে। নিগৃহীতের তালিকায় ১২-১৩ বছরের কিশোর-কিশোরী থেকে শুরু করে ৮০ বছরের বৃদ্ধ-বৃদ্ধা সকলেই রয়েছেন। শুধুমাত্র ধর্মীয় এবং জাত-পাতগত কারণে মহিলা-পুরুষ নির্বিশেষে কেউ যৌন হেনস্থার শিকার হয়েছেন, কেউ ধর্ষিতা হয়েছেন, কেউ খুন হয়েছেন। কাউকে বা শারীরিকভাবে হেনস্থার শিকার হতে হয়েছে।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের এই রিপোর্টকে ইতিমধ্যেই হাতিয়ার করেছে বিরোধীরা। অভিযোগের নিশানায় কেন্দ্রের বিজেপি সরকার। সংসদের ভিতরে এবং বাইরে সংখ্যালঘু, আদিবাসী, দলিতদের আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা তুলে ধরে সরব হয়েছে সমস্ত বিরোধী দল। আগামী লোকসভা ভোটের আগে এই ইস্যুকে সামনে রেখে জোরদার আন্দোলনের প্রস্তুতিও নেওয়া হচ্ছে। বিশেষ করে বিজেপি শাসিত একাধিক রাজ্যে এই ঘৃণা এবং বিদ্বেষজনিত অপরাধের সংখ্যা উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে বলে অভিযোগ বিরোধীদের। গো-রক্ষার নামে মানুষকে পিটিয়ে খুন করা ঠেকাতে দরকারে কড়া আইন প্রণয়ন করার জন্যও সম্প্রতি নির্দেশ দিয়েছে সুপ্রিম কোর্ট।

Leave A Reply

Your email address will not be published.