অনুরাগিণী

 

চার

চা খাওয়ার সময় অনুব্রত বললো, ‘আমার মনে হয় তোমাকে সুপার করে দেওয়া উচিত।’
রাগিণী চকিতে চোখ তুলে তাকালো। প্রথমত, তুমি শুনে আর দ্বিতীয়ত অনুব্রতর সলিউশান শুনে।
সেও এবার তুমিতে চলে গিয়ে বললো, ‘তুমি কি পাগল? হাসপাতালের বোর্ডের কেউ আমায় চেনে না। নীলমনি দাস সব সেট করে রেখেছে। ওসব ভেবে লাভ নেই। আজ উঠি।’
উঠে দাঁড়ালো রাগিণী। বন্দুকের কথাটা সে ভুলতে পারছে না।
অনুব্রত একটা স্মিত হাসি হেসে বললো, ‘সুপার হলে একদিন খাইয়ে দিও নেমন্তন্ন করে।’
রাগিণী একটা ভদ্রতা রক্ষার হাসি হেসে চলে গেলো।
রাগিণী কোয়ার্টারে ফিরে আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়লো। তার খিদে নেই। বইয়ের তাকে বন্দুক, এই ব্যাপারটা সে মেনে নিতে পারছে না। কে এই অনুব্রত? কী তার পরিচয়। তাকে সব জানতেই হবে। ঘুম আসছে না। ঘড়ি দেখলো রাগিণী। দুটো পনেরো। একটা ট্রাকের শব্দ হলো। জানলার কাছে গিয়ে রাগিণী দেখলো ট্রাকের আলোর তীব্র জ্যোতি। সেটা দাঁড়িয়েছে হাসপাতালের পেছনের গেট-এ। তিনটে লোক বেরিয়ে এল। কিছু ওঠানো নামানো হচ্ছে। রাগিণীর কৌতূহল হলো। একটা চাদর মুড়ি দিয়ে হাতে একটা টর্চ নিয়ে রাগিণী বেরিয়ে গেলো।
হাসপাতালের পেছনে মাঠ। সেখানে একটা বড় বট গাছ। তার আড়ালে দাঁড়িয়ে রাগিণী বোঝার চেষ্টা করলো কী চলছে। প্যাকেট নামছে। একটা নয়। অনেকগুলো। তদারকি করছে ডঃ নীলমনি দাস।
ভয়ে হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে রাগিণীর। এমন সময় সে চমকে উঠলো। তার কাঁধে একটা হাতের স্পর্শ পেয়েছে। তাহলে কি সে ধরা পড়ে গেলো? পেছনে তাকিয়ে দেখলো একটা লোক। মাথায় হুড টানা বর্ষাতি। রাগিণী টর্চের আলো ফেললো মুখে। অনুব্রত।
রাগিণী চিৎকার করে উঠলো, ‘একি তুমি?’
অনুব্রত মুহূর্তের মধ্যে তার মুখ চেপে ধরলো। রাগিণীও আপ্রাণ চেষ্টা করলো ছাড়াতে। ততক্ষণে লোকগুলো সতর্ক হয়ে গেছে। একটাই আওয়াজ কানে এলো। ‘পালা’।
নীলমনি দাসকেও আর দেখা যাচ্ছে না। অনুব্রত এক ছুটে ট্রাকের সামনে গিয়ে কাউকেই পেলো না। যেটা পেলো সেটা হলো পেটি ভর্তি ওষুধ আর ইঞ্জেকশনের অ্যাম্পুল। ততক্ষণে রাগিণীও এসে দাঁড়িয়েছে। রাগিণীর দিকে তাকিয়ে অনুব্রত বললো, ‘তোমার জন্য আজ শিকার ফস্কে গেলো।’ তারপর পেটিগুলো দেখিয়ে সে বললো, ‘এগুলো কী জানো?’
হতবাক রাগিণী জিগেস করল, ‘কী?’
অনুব্রত যা বললো তাতে তার আর বিস্ময়ের সীমা রইলো না। ‘এগুলো জাল ওষুধ! এখানে এর একটা বড় চক্র কাজ করে। কলকাতার সাথে এদের যোগাযোগ। প্রায় ধরে ফেলেছিলাম। একটুর জন্য ফস্কে গেলো। চলো তোমায় পৌঁছে দিই, তারপর এই সব পেটির ব্যবস্থা করতে হবে।’
কে তুমি?
প্রশ্নটা করলো রাগিণী।
অনুব্রত মুচকি হেসে বললো, ‘গ্রামের মাস্টার অনুব্রত চক্রবর্তী।’

পাঁচ

পরের দিন কলকাতা থেকে রিপোর্ট এলো। ওষুধগুলো সত্যিই জাল। এই কলঙ্ক মাথায় নিয়ে সুপার পদত্যাগ করলেন। বোর্ড মিটিং বসল নতুন সুপার কে হবে তাই নিয়ে। নীলমনি দাস আর তার দলবল এসেছে ব্যান্ড পার্টি, মালা, আবির নিয়ে। সুপার ঘোষণা আর মাত্র সময়ের অপেক্ষা। তারপরেই উৎসব। অনেকেই এসে তাকে অগ্রিম অভিনন্দন জানিয়ে যাচ্ছে।
যথা সময় মিটিং শেষ হলো। দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন বোর্ড সভাপতি। এবার ঘোষণা। সবাইকে অবাক করে ঘোষণা করলেন নতুন সুপারের নাম। ডঃ রাগিণী সেনগুপ্ত ! রাগিণী নিজেও চমকে উঠেছে। ডঃ নীলমনি দাস গলার মালা ছিঁড়ে ছুটে গেলো সভাপতির কাছে। বারবার জোর করতে লাগলো নিশ্চই কোনও ভুল হয়েছে। আর একবার যেন তিনি দেখেন। সভাপতি পরিষ্কার জানিয়ে দিলেন যে, সেটাই ফাইনাল সিদ্ধান্ত। ডঃ রাগিণী সেনগুপ্তই নতুন সুপার।
ডঃ নীলমনি দাস গলার মালা ছিঁড়ে সেটাকে ছুড়ে ফেলে বেরিয়ে গেল তার দলবল নিয়ে। ফাঁকা ঘরে একা বসে রাগিণী। তাকে অভিনন্দন জানাবার পর্যন্ত কেউ নেই। কিন্তু সত্যি কি কেউ নেই? আছে। দরজার বাইরে মালা হাতে দাঁড়িয়ে অনুব্রত। নতুন সুপারকে অভিনন্দন জানাতে।
শুরু হলো জীবনের নতুন অধ্যায়। রাগিণী জানে এ পথ খুব মসৃণ হবে না। বিপদ আসবে পদে পদে আর সেটা এলোও।
একদিন হাসপাতালে এসে রাগিনী দেখলো ফোর্থ ক্লাস স্টাফেরা বাইরে পথ আগলে বসে। তারা ধর্মঘট করেছে মাইনে বাড়ানোর দাবিতে। এটা বছরের মাইনে বাড়ানোর সময় নয়। রাগিণী বুঝলো এর পেছনে কেউ কলকাঠি নাড়ছে। প্রথমে সে বোঝানোর চেষ্টা করলো, কিন্তু তাতে ফল হলো বিপরীত। বিক্ষোভ আরও বেড়ে গেলো। রাগিণীকে মাঝখানে রেখে চারদিক থেকে স্লোগান উঠতে লাগলো। রাগিণী দেখলো দূরে হাসপাতালের জানলায় চা হাতে দাঁড়িয়ে ডঃ নীলমনি দাস। বুঝতে আর বাকি রইলো না এর পেছনে কার হাত আছে।
ঠিক সেই সময় ঘটে গেলো একটা অত্যাশ্চর্য ঘটনা। আর একটা জমায়েত তৈরি হয়েছে। যার নেতৃত্বে অনুব্রত। এই জমায়েতে উপস্থিত সবার বয়েস দশের কম। এরা সবাই এই ফোর্থ ক্লাস স্টাফেদের সন্তান। তাদের দেখে বাকিরা সবাই থমকে দাঁড়ালো। একজন এগিয়ে এসে বললো, ‘তোরা এখানে কেন?’
উত্তরে কেউ বললো, ‘পেটে ব্যথা,’ তো কেউ বললো ‘বমি হচ্ছে।’
অনুব্রত ভয়ে ভয়ে বললো, ‘স্কুলে এসেই এরা শরীর খারাপ বলছে। কাল কোথায় নেমন্তন্ন খেয়েছে তারপরেই এরকম হয়েছে। কিন্তু হাসপাতাল তো বন্ধ। কী আর করি। আমি ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। বাড়িতে কিছু হোমিওপ্যাথি বড়ি আছে সেগুলো দিয়ে দেখি।’
মুহূর্তের মধ্যে ধর্মঘট উঠে গেলো। যারা এতক্ষণ রাগিণীকে ঘিরে বিক্ষোভ দেখাচ্ছিল তারাই এবার তার পায়ে পড়ে অনুরোধ করতে লাগলো একবার দেখার জন্য। একজন এগিয়ে এসে বললো, ‘কাল নীলমনি দাস ছেলেমেয়েদের জন্য খাবার পাঠিয়েছিল। ওই খেয়েই হয়েছে। আপনি একটু দেখুন দিদি। আমাদের ভুল হয়ে গেছে। আর কখনও হবে না।’
রাগিণী বাচ্চাগুলোকে নিয়ে ঢুকলো নিজের কেবিনে। সাথে অনুব্রত। ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলো সে আর তারপর সবাই মিলে তালি দিয়ে উঠলো। রাগিণী কিছুই বুঝতে পারছেনা। অনুব্রত একটু হেসে বললো, ‘ওদের একটু অ্যাক্টিং শেখাচ্ছিলাম আর কী! তারপর বাচ্চাদের বললো, ‘বাড়িতে বলবি না কিন্তু। মনে থাকবে।’ সবাই একসাথে হ্যাঁ বলে উঠলো।
বাইরে বেরিয়ে ওরা দেখলো ত্রস্তভাবে বাবারা দাঁড়িয়ে। রাগিণী বললো, ‘ওষুধ দিয়ে দিয়েছি। বাড়ি নিয়ে যাও।’
সবাই চলে গেলে অনুব্রতও পা বাড়ালো। রাগিণী তাকে ডেকে বললো, ‘শোনো।’
ফিরে তাকালো অনুব্রত।
রাগিণী হেসে বললো, ‘থ্যাংক ইউ।’
এই বোধ হয় সে রাগিণীকে প্রথম হাসতে দেখলো।

ছয়

রাগিণী বুঝতে পারছে তার চারপাশের পৃথিবীটা পাল্টে যাচ্ছে। একদিকে যেমন নীলমনি দাসের বিষাক্ত নিঃশ্বাসে সে হাঁপিয়ে উঠেছে ঠিক তেমনি অনুব্রতর সান্নিধ্যে সে যেন নতুন জীবন খুঁজে পেয়েছে। কী আছে অনুব্রতর মধ্যে? কেন সে তার প্রতি এমন অমোঘ টান অনুভব করে? কেন একদিন তার দেখা না পেলে জীবন এমন বিস্বাদ হয়ে যায়? সে জানে না।
গত দুদিন দেখা হয়নি অনুব্রতর সাথে। সে ঠিক করলো আজ একবার স্কুলে গিয়ে দেখবে। হাসপাতালে ছুটির পর সে বেরোতে যাবে ঠিক তখনই তার ঘরে এসে ঢুকলো নীলমনি দাস। চেয়ারে বসে পায়ের ওপর পা তুলে সে বললো, ‘এই যে ডঃ সেনগুপ্ত। কোথাও বেরোচ্ছেন নাকি?’
‘একটু কাজ আছে’, সংক্ষেপে উত্তর দিলো রাগিণী। নীলমনি দাস একটা শ্লেষ মেশানো হাসি দিয়ে বললো, ‘কাজ ? কাজ মানে তো ওই মাষ্টার এর সাথে লীলা করতে যাওয়া। শুনুন এটা ভদ্রলোকের জায়গা। এখানে ওসব চলবে না।’
রাগিণী এক দৃষ্টে তাকিয়ে থেকে বললো, ‘আপনার কথা হয়ে গেলে আপনি এবার আসতে পারেন।’
নীলমনি গলার স্বর চড়িয়ে বললো, ‘না কথা শেষ হয়নি। আপনি ওষুধের সাপ্লায়ার পাল্টেছেন কাকে জিজ্ঞেস করে?’
রাগিণী উত্তর দিলো, ‘সেটা আমার ডিসিশন। আর সেখানে কেউ হাত দেয় সেটা আমি বরদাস্ত করবো না। এবার আপনি আসুন। আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। আর হ্যাঁ, পরের বার আমার ঘরে আসতে হলে দরজা নক করে অনুমতি নিয়ে ঢুকবেন।’ এই অবধি বলে রাগিণী সশব্দে বেরিয়ে গেলো। নীলমনি দাস চুপচাপ বসে রইলো। তার দু’চোখে প্রতিহিংসার আগুন।
স্কুলে এসে রাগিণী শুনলো যে, মাস্টার দুদিন হলো কলকাতায় গেছে। খুব রাগ হলো। একবার জানিয়ে যেতে পারলো না? আবার পরক্ষণেই সে ভাবলো, তাকে কেন জানাবে? আর সে এরকম প্রত্যাশাই বা করছে কেন ?
তখনও দিন শেষ হয়নি। ভালোই আলো আছে। মনে মনে ভাবলো একবার নদীর ধারে ঘুরে আসি। আজ সে একাই হাঁটছে। বড্ড বাড়ির কথা মনে পড়ছে। মা তাকে রোজ ফোন করে। কিন্তু বাবা একদিনও তার সাথে কথা বলেননি এর মধ্যে। খুব আঘাত পেয়েছেন তিনি মেয়ের সিদ্ধান্তে। মেজকা খবর নেয়। মেজকার ছেলে অনির্বানও মাঝে মাঝে ফোন করে। ছোট কাকিমা আর তার ছেলে গোগোলের কোনও খবর নেই। সে অবশ্য সেটা আশাও করে না। রাগিণী শুনেছে, সেই গ্যারেজে গোগোল ব্যবসা শুরু করেছে।
এই সব ভাবতে ভাবতে সে অনেকটা হেঁটে চলে এসেছে। এখানে একটা বসতি আছে। সেখানে কিছু নিয়ে একটা হইচই হচ্ছে। রাগিনী দেখে আসতে গেলো।
ওখানে গিয়ে যা দেখলো তাতে ও চমকে উঠলো। একজন অল্প বয়েসী বউকে বেঁধে রাখা হয়েছে। সে ধুঁকছে। মুখ দিয়ে নাল পড়ছে আর এক ভয়ানক দর্শন ওঝা তাকে ক্রমাগত ঝাঁটার বাড়ি মেরে চলেছে কিছু দুর্বোধ্য মন্ত্র পড়ে।
জিজ্ঞেস করতে একজন বললো, ‘ও কানাইয়ের বউ গো। পেত্নীতে ধরেছে। ভৈরব ওঝা ছাড়াচ্ছে।’
ততক্ষণে ওঝা চিৎকার করছে, ‘বল যাবি কিনা। বল।’
বউটা প্রায় অজ্ঞান হয় হয়।
রাগিণী ভিড় ঠেলে এগিয়ে গিয়ে বললো, ‘এটা কী করছো? ও তো মরে যাবে। ওর অসুখ হয়েছে। কোনো পেত্নীতে ধরেনি। আমি এখনি ঠিক করে দিচ্ছি।’
ভৈরব ওঝা লাল চোখ নিয়ে বললো, ‘এটা ডাক্তারের কাজ নয়। আমার কাজ আমায় করতে দাও।’
রাগিণীও নাছোড়। অবশেষে কানাই রাজি হলো।
রাগিণী ব্যাগের থেকে একটা ইঞ্জেকশান বের করে সেটা দিতেই ম্যাজিকের মত কাজ হলো। বউ উঠে বসলো। সারা গায়ে অসহ্য ব্যথা। রাগিণী কানাইকে বললো, ‘তোমার বউয়ের মৃগী আছে। কাল হাসপাতালে ভর্তি করে দিও।’
গ্রামের সবাই রাগিণীকে নিয়ে আপ্লুত। সেও বুঝচ্ছে এদের মনের অন্ধকার কেটে যাচ্ছে। কিন্তু শত্রু সংখ্যা বেড়েই চলেছে। এবার আর একজন বাড়লো। ভৈরব ওঝা। সে শুধু যাবার আগে বলে গেলো, ‘আমার ভাত মেরে আপনিও নিশ্চিন্তে থাকতে পারবেন না। এই বলে দিয়ে গেলাম।’
গ্রামে এখন রাগিণী বেশ জনপ্রিয়। সবাই এখানে ডঃ দিদি বলে ডাকে। হাসপাতালের সাথে গ্রামের চেহারাও অনেকটা সে পাল্টে দিয়েছে। সারাদিন কাজেই ডুবে থাকে। মাঝে মাঝে বন্ধ স্কুল বাড়ির দিকে চোখ পড়ে। তালাটা আজও ঝোলানো। কোথায় গেলো অনুব্রত?
মোবাইল নাম্বারটাও নেওয়া হয়নি। সে তো ভাবেনি তাকে এমন টানাপোড়েনের মধ্যে পড়তে হবে।
সেদিন হাসপাতালে গিয়ে একটা খবর পেলো রাগিনী। ঝাড়ুদার রামদিন এসে জানালো, কাল অনেক রাতে সে ভৈরব ওঝা আর ডঃ নীলমনি দাসকে হাসপাতালের পেছনে মাঠে কথা বলতে দেখেছে। আজ রাতে কিছু একটা ঘটবে।
রাগিণীর কপালে খাঁজ। কী করবে ভেবে পেলো না। সেদিন রাতে ট্রাকের আওয়াজ আবার পাওয়া গেলো। রাগিনী একটা চাদরে আপাদমস্তক মুড়ি দিয়ে এসে দাঁড়ালো সেই বট গাছের নীচে।

(পরবর্তী পর্ব আগামী রবিবার)

Comments are closed.