অনুরাগিণী

সাত

ওই তো ডঃ নীলমনি দাস। ট্রাকের আলোয় দেখা গেলো একজনের হাতে কিছু দিলো। সম্ভবত টাকা। ট্রাকটা এবার রওনা হবে।
ডালা বন্ধ করে তার পেছনে দুবার তালি দিলো নীলমনি।
ট্রাক ছেড়ে দিলো। কী করা উচিত? রাগিণী কি পুলিশে খবর দেবে? ঠিক সেই সময়ই একটা বাইক এসে থামলো রাগিণীর পাশে। সওয়ারির মাথায় কালো হেলমেট। মুখ দেখা যায় না। একবার সে হেলমেটটা খুললো। অনুব্রত। এ বেশে তাকে আগে কখনো দেখেনি রাগিণী। অনুব্রত কিছু বলার আগেই রাগিণী উঠে বসলো বাইকের পেছনে। রাতের অন্ধকার চিরে বাইক ছুটলো ট্রাকের পেছনে।
দু’দিকের ঘন জঙ্গল ভেদ করে ট্রাকের পেছনে বাইক ছুটেছে। জঙ্গল যেখানে আরও ঘন সেখানে হঠাৎ ব্রেক কোষে দাঁড়িয়ে গেলো ট্রাক।
অনুব্রতও দৌড়ে গিয়ে ট্রাকের ড্রাইভারকে টেনে নামালো। আর তার সাথে নামলো ভৈরব ওঝা।
‘ট্রাকে কী আছে?’ লৌহ কঠিন গলায় প্রশ্ন করল অনুব্রত।
‘তার আগে বলো তুমি কে?’ ভৈরব জিগেস করলো।
এবার পকেট থেকে আইডেন্টিটি কার্ডটা বের করলো অনুব্রত। রাগিণীও দেখতে পেলো সেখানে ছবি সমেত পরিষ্কারভাবে লেখা, অনুব্রত চক্রবর্তী, সি আই ডি।
অনুব্রত ভৈরবকে বললো ট্রাকের দরজা খোলো। ভৈরব সুড়সুড় করে দরজা খুলে দিলো। অনেক পিসবোর্ডের বাক্স। তার একটা খুলতেই বেরিয়ে এলো ওষুধের স্ট্রিপ।
ভৈরবের দিকে তাকিয়ে অনুব্রত বললো, ‘অনেক তো ঝাড়ফুঁক হলো। এবার একটু জেলেও তোমার জাদু দেখিয়ে এসো।’
ভৈরবের কিন্তু ভয় বলে কিচ্ছু নেই। সে বরং একবার হেসে অনুব্রতকে বললো, ‘আপনার ইয়ার সেই ডাক্তার কোথায় পুলিশবাবু?’
চমকে তাকালো অনুব্রত।
রাগিণী নেই!
অন্ধকার একটা সোঁদা ঘরে জ্ঞান ফিরলো রাগিণীর। সে জানে এখন সে বন্দি। ঘরে কিছু পরিত্যক্ত আসবাব। আর একটা বাল্ব জ্বলছে। অনুব্রত কোথায়? সে কি বেঁচে আছে? সিআইডি জানার পর তাঁকে কি আর নীলমনি দাসের দলবল বাঁচিয়ে রেখেছে? চোখ বুঁজে এলো রাগিণীর।
এমন সময় পায়ের শব্দে সে চমকে উঠলো। কেউ একজন আসছে। এবার দরজাটায় খুট শব্দ হল। লক খোলার, ঘরে ঢুকলো নীলমনি দাস।
রাগিণীর সামনে গিয়ে একটা ছোট টুলে বসলো। তারপর নীচু গলায় বললো, ‘কেমন আছেন ম্যাডাম? টিকটিকি সাজার স্বপ্ন মিটেছে? আপনার নাগরকে এতক্ষনে ভৈরব বিষ কেউটে দিয়ে সাবাড় করে দিয়েছে। এবার তোমাকেও এখানে মেরে শীলাবতী নদীতে ভাসিয়ে দিলেই ল্যাঠা চুকে যায়। সব জায়গায় না মাতব্বরি করতে নেই। এটা আমার এলাকা।’
রাগিণী চিৎকার করে উঠলো, ‘মারলে মেরে দে! বাঁচিয়ে রেখেছিস কেন আমায়?’
নীলমনি একটু হেসে বললো, তাই করলেই ভালো হোত। কিন্তু আমার পার্টনার আসছে কলকাতা থেকে। ওর একবার মতামতটা নিয়ে নিই। তবে ও আমার চেয়েও ভীতু। ও যদি জানে যে তুমি আমাদের জাল ওষুধের ব্যবসার ব্যাপারে জেনে গেছো তাহলে ও আর দেরি করবে না। নিজে হাতেই তোমায় খতম করে দেবে। তাই বলছিলাম……”
কথা শেষ হলো না। একটা গাড়ি এসে দাঁড়াবার শব্দ।
নীলমনি দাস বললো, ‘ওই এসে গেছে।’
আবার পায়ের শব্দ। দরজার বাইরে সেই শব্দ থামলো কিছুক্ষণের জন্য। এবার দরজা খোলার আওয়াজ এলো। রাগিণী দেয়ালের দিকে মুখ করে বসে।
আগন্তুক ঘরে ঢুকেছে। এবার তার গলার আওয়াজ পাওয়া গেলো। নীলমনি দাসের উদ্দেশ্যে সে বললো, ‘এর কথাই বলেছিলে?’
নীলমনি মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললো।
কই দেখি।
এই কথাটা আগন্তুক বললো রাগিণীর উদ্দেশ্যে। রাগিণী চমকে উঠলো। এ গলা তার খুব চেনা। চকিতে ঘুরে তাকালো সে। যাকে দেখলো তাতে তার মনে হলো তার ওপর একশোটা বজ্রপাত ঘটলো। বিস্ময়ে, বেদনায় মিশ্র এক অনুভূতি নিয়ে রাগিণী দেখলো তার সামনে যে দাঁড়িয়ে আছে, যে তার মৃত্যুর পরোয়ানায় সিলমোহর দিতে এসেছে, সে আর কেউ নয়। তার ছোট ভাই অর্ঘ্য সেনগুপ্ত বা তার গোগোল।
গোগোলকে দেখে মনে হলো না সে খুব অবাক হয়েছে। সে যেন জানতোই যে, যাকে ঘিরে এতো নাটক সে তারই দিদিয়া রাগিণী।
রাগিণী বরং গোগোলকে দেখে প্রথমে বাকরুদ্ধ হয়ে গেছিলো আর তারপর ভাবল, তার ভাই কোনও ভাবে খবর পেয়ে তাকে উদ্ধার করতে এসেছে। তবে তার সেই ভ্রম বেশিক্ষণ টিকলো না, কারণ সেই ভাই নির্লিপ্ত মুখে আদেশ দিয়ে গেলো, ‘আজ রাতটা এখানেই বাঁধা থাক। কাল দেখা যাবে।’
বৃষ্টির তেজটা সম্ভবত বেড়েছে। গাড়ি থেকে বেরিয়ে এই ঘর অবধি আসতে গোগোল পুরো ভিজে গেছে। সে আর না দাঁড়িয়ে বেরিয়ে গেলো। যাবার আগে বলে গেলো, ‘একজন পাহারা বসিয়ে দাও।’
নীলমনি দাস কোত্থেকে একটা ষণ্ডা মার্কা লোককে এনে বললো, ‘এখানে বসে পাহারা দিবি। ঘুমোবি না।’
লোকটা হাঁ জি বলে টুলে বসে খৈনি ডলতে লাগলো। নীলমনি দাস বেরিয়ে গেলো।
রাত কটা রাগিনী জানে না। বাইরে থেকে ঝিঝি ছাড়া আর একটা শব্দ আসছে। সেটা হলো বৃষ্টির। এর সাথে আর একটা শব্দ যোগ হলো। সেটা হলো জলস্রোতের।
ঠিক সেই সময় আর একটা লোক এসে খবর দিলো ষণ্ডা প্রহরীটাকে যে, নদীর অস্থায়ী বাঁধ ভেঙে গেছে। হুহু করে জল ঢুকছে আর এই ঘরটা আন্ডারগ্রাউন্ড হবার জন্য এখুনি জলে ভর্তি হয়ে যাবে। তাই পালানোটাই শ্রেয়। প্রহরী বললো পালাবার হুকুম নেই।
লোকটা এবার একটা মোক্ষম চাল খেললো। এ বললো, ‘আরে আপনি বাঁচলে বাপের নাম। মেয়েটাকে বেঁধে রেখে পালিয়ে চল।’
লোকটার বুদ্ধিটা মনে ধরলো প্রহরীর। রাগিণীকে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে তারা পালাল।
এর মধ্যে জল ঢুকতে শুরু করেছে। রাগিণীর পায়ের পাতা ছাপিয়ে জল বইছে। এ যে নিশ্চিত মৃত্যু। রাগিণীর বন্ধন না খুললে সে একবিন্দু নড়তে পারবে না। কিন্তু কে এখানে তার বাঁধন খুলবে? রাগিণী প্রমাদ গুনলো আর ঠিক তখনই সে অনুভব করলো দড়িতে হালকা টান। চমকে সে পেছনে তাকালো। একজন বয়স্ক মানুষ। সারা মুখে বহু দিনের না কাটা দাড়ি, গোঁফ। সে ঝুঁকে একটা একটা করে রাগিণীর বাঁধন খুলে দিয়ে বললো, ‘পালা….. পালা এখান থেকে!’
রাগিণীর মুখ থেকে সবিস্ময়ে বেরিয়ে এলো, ‘ছোটকা তুমি?’

আট

ছোটকা ডাক শুনে আগন্তুক একটা কৌতূহলী দৃষ্টি দিলো। যেন বহুদিনের পরিচিত কাউকে চেনার চেষ্টা করছেন। রাগিণী উত্তেজিত হয়ে বললো, ‘আমায় চিনতে পারছ না ছোটকা? আমি তোমার সুমি।’
রাগিণীর মনে আছে, ছোটকা তাকে এই নামেই ডাকতো।
এদিকে আগন্তুকেরও সব মনে পড়ে গেছে। আর কোনও ভুল নেই। ইনি সেই হারিয়ে যাওয়া ছোট ভাই সাগরময়। সাগরময় রাগিণীর হাত দুটো ধরে কান্নায় ভেঙে পড়লেন । আজ কত বছর তিনি গৃহবন্দি। রাগিণী জানতে পারলো যে, এই জাল ওষুধের কারবারের মাথা ডঃ নীলমনি দাস আর কেউ নন। গোগোলের এক দূর সম্পর্কের মামা আর তিনিই গোগোলকে এ পথে এনেছেন। তাকে রাগিণী কেন ও বাড়ির কেউ কখনও দেখেনি একমাত্র সাগরময় ছাড়া। সবাই জানত ছন্দার এক ডাক্তার ভাই আছে। কিন্তু সে বিদেশেই থাকে আর খুবই কম দেশে আসে। কিন্তু আসল ঘটনা হলো নীলমনি কখনও মেদিনীপুর ছেড়ে কোত্থাও যায়নি। পুরো জিনিসটাই চোখে ধুলো দিতে আগাগোড়া নাটক সাজিয়েছিলো। নীলমনি ছন্দার বাবা-কে মামা বলে ডাকতো। ছন্দার বাবা ছিলেন বায়ো কেমিস্ট। এক দূরারোগ্য ওষুধের ফর্মুলা বের করেছিলেন। নীলমনি ডাক্তার হবার সুবাদে এই গবেষণায় সাহায্য করেছিল ছন্দার বাবা ডঃ নির্মল মল্লিককে। ডঃ মল্লিক পরে নীলমনির নানা বদগুণের কথা জানতে পারেন ও তারপর বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেন। এরপরেই ছন্দার বিয়ে হয় সাগরময়ের সাথে। ডঃ মল্লিক না চাইলেও ছন্দা কিন্তু যোগাযোগ রেখে গেছিলো নীলমনির সাথে। গোগোল যখন খুব ছোট তখন নীলমনি সাগরময়কে দলে টানতে চেষ্টা করে। সাগরময় ‘না’ বলে দেয়। এরপর শুরু হয় ছন্দার মানসিক নির্যাতন। সাগরময় পুলিশে যাবে ভেবেও যাননি কারণ ছন্দার ক্ষতি হবে মনে করে। কিন্তু নির্যাতন যখন চরমে উঠলো একদিন সাগরময় চুপি চুপি বেরিয়ে গেলেন থানার উদ্দেশ্যে। মাঝ পথে কিডন্যাপ করে নীলমনি আর তার দলবল। সেই থেকে আজ প্রায় কুড়ি বছর তিনি মেদিনীপুরের এই প্রত্যন্ত গ্রামে গৃহবন্দি।
সাগরময় বললেন, ‘পালা সুমি। আমার কথা ভাবিস না। আমার এই অন্ধকার কুঠুরিতে থাকা অভ্যেস হয়ে গেছে।’
রাগিণী স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিলো যে, সে ছোটকাকে না নিয়ে ফিরবে না।
একটা সরু গলি পেরিয়ে দুজনে এসে দাঁড়ালো একটা ফাঁকা জায়গায়। জল আরও বাড়ছে। হাঁটুর ওপরে উঠে গেছে জল। হঠাৎ রাগিনী দেখলো সামনে একটা সিঁড়ি।
আর ভাবার সময় নেই। সিঁড়ি দিয়েই উঠতে শুরু করলো দুজন।
রাগিণী চাপা গলায় সাগরময়কে বললো, ‘মনে হচ্ছে লোকগুলো পালিয়েছে। কিন্তু নীলমনি আর গোগোল কোথায়?’
সিঁড়ির ওপরে ল্যান্ডিংয়ের পাশে একটা ঘর। তার মধ্যে ক্ষীণ আলোয় দেখা যাচ্ছে দুটো ছায়া মূর্তি।
এগিয়ে গিয়ে দরজায় কান লাগলো রাগিণী। ভেতর থেকে চাপা আওয়াজ আসছে। এই গলা সে চেনে। ডঃ নীলমনি দাস। ভাগ্নে গোগোলকে উদ্যেশ্য করে ভর্ৎসনার সুরে সে বলছে, পুলিশ কী করে খবর পেলো?’
এবার গোগোলের গলা।
‘সেটা আমি কী করে জানবো। আজ সকালে বাড়ির গ্যারেজ রেড হয়েছে। ওষুধ, অ্যামপিউল সব নিয়ে গেছে। গ্যারেজ সিল। উফফফ! কী যে হবে আমি ভেবে পাচ্ছি না।’
নীলমনি আবার বললো, ‘দিদি কোথায়?’
গোগোল জানালো সে জানে না। বাড়িতে পুলিশ ঢুকতে দেখে সে পেছনের দিকের পেঁচানো সিঁড়ি দিয়ে পালিয়ে এসেছে।
নীলমনি দাস বুঝতে পারছে যে তারা ভালোই ফেঁসেছে। পালানো ছাড়া কোনো উপায় নেই। গোগোলকে সে বললো, ‘যেভাবে জল বাড়ছে তাতে একটু পরেই এই ঘর ডুবে যাবে। এখনই পালতে হবে। কোনওভাবে বর্ডার পেরিয়ে নেপাল বা বাংলাদেশে ঢুকে পড়াটাই এখন একমাত্র কাজ। তারপর দু’দেশের পুলিশে সমঝোতা হতে হতে আর একটু সময় পেয়ে যাবো।’
গোগোল নিচু গলায় বললো, ‘কিন্তু ব্যাপারটা খুব গোপনে করতে হবে। মেদিনীপুর থেকে বর্ডার অনেক দূর। এর মধ্যে ধরা পড়ে গেলেই সব শেষ।’
নীলমনি বললো, ‘সে আর বলতে। আর যদি কেউ আমাদের প্ল্যান জেনে যায় তাহলে তাকে ওখানেই খতম করে দিতে হবে। যেমন এই দুজনকে। ‘
এই বলে হঠাৎ দরজা খুলে একটানে রাগিণী আর সাগরময়কে ভেতরে টেনে আনলো।’
ঘটনার আকস্মিকতায় থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে রইলো দুজন। নীলমনি বলে চললো, ‘আমি গন্ধ পাই। শিকারের গন্ধ। তোমরা ভুল জায়গায় হানা দিতে এসেছিলে। এবার বলতো। বাড়িতে পুলিশ কে পাঠালো? একটু চালাকি যদি করেছ তাহলে এই পকেটের বন্দুকটা আর পকেটে থাকবে না। দুটো গুলি অকারণ খরচা হবে।’
গোগোলকে দেখে আর্তনাদ করে উঠলো সাগরময়। ‘তুই আমার ছেলে। কিন্তু একী সর্বনাশের দিকে পা বাড়িয়েছিস। আমাকে মেরে কেন ফেললি না? তাহলে তো এই দিনটা আর দেখতে হতো না।’
নীলমনি বললো, ‘তোমার ওই ইচ্ছেটাও পূর্ণ করব। শুধু বলে দাও ফর্মুলাটা কোথায়?’
সাগরময় অবিশ্বাসের সুরে বললো, ‘আগেও বলেছি আমার কাছে কোনো ফর্মুলা নেই। ‘
‘আলবাত আছে’, চিৎকার করে উঠলো নীলমনি। মামা মৃত্যুর আগে স্বীকার করে গেছে যে ফর্মুলাটা উনি তোমায় দিয়ে গেছেন। আমি জানি মামা কত বড় বৈজ্ঞানিক ছিল। ওই ফর্মুলা হাতে পেলে আমি বড় ওষুধের কারখানা খুলতাম এ পাপের রাস্তায় আমাকে আসতে হতো না। কিন্তু মামা আমায় বিশ্বাস করলেন না। তোমায় দিয়ে গেলেন।’
সাগরময় বললো, ‘ওহ তাই আমাকে কিডন্যাপ করেও এতদিন বাঁচিয়ে রেখেছো? ওই ফর্মুলার আশায়? শুনে রাখো নীলমনি। ওই ফর্মুলা তুমি কোনও দিন পাবে না।’
নীলমনি এবার পাগলের মত চিৎকার করে উঠলো, ‘তাহলে মরো এই বার। পুলিশ সব জেনে গেছে। আর তোমাকে বাঁচিয়ে রাখলে আমার বিপদ বাড়বে। সঙ্গে এই খুকুমনিকেও সাবাড় করে দেব। তারপর সোজা বর্ডার।’
নীলমনির হাতে বন্দুক এসে গেছে। ল্যাচটায় টান দিলো। ট্রিগারে আঙুল। গুলি বেরোতে আর একটা চাপের অপেক্ষা। আর ঠিক সেই সময়েই ঘটে গেলো ধুন্ধুমার কাণ্ড।
একটা কান ফাটা গুলির শব্দে চমকে উঠলো সবাই। চোখ গেলো দরজার দিকে। সেখানে পিস্তল হাতে দাঁড়িয়ে অনুব্রত। নীলমনির হাতের পিস্তল তখন ছিটকে পড়েছে মাটিতে। হাতে গুলি লেগেছে। যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে সে। গোগোল এদিক ওদিক দেখে পালতে গেলো। কিন্তু পারলো না। দরজা আটকে দাঁড়িয়ে অনুব্রত ছাড়াও আর একজন। গোগোলের মা ছন্দা। গোগোল চিৎকার করে বললো, ‘মা সরে যাও।’
ছন্দা গোগোলকে জড়িয়ে ধরে বললো, ‘যাস না বাবু। সারেন্ডার কর। জীবনে অনেক পাপ করেছি আমরা। তোর বাবাকে হারিয়েছি সারা জীবনের মত। আর না। পুলিশে খবর আমিই দিয়েছিলাম।এই মানসিক চাপ আর নিতে পারছিলাম না। তুই আমায় কখনও বলিসনি তোর বাবা বেঁচে আছে। কিন্তু যখন জানতে পারলাম তখন আবার সব নতুন করে শুরু করার খুব সাধ হলো। কী পেলাম এই সব করে?’
গোগোলের চোখ রক্তবর্ণ। ‘কে বললো তোমায় বাবা বেঁচে আছে?’
‘আমি বলেছি’, কথাটা ভেসে এলো অন্ধকার থেকে। আর একজন এসে দাঁড়িয়েছে। ভৈরব।
নীলমনি চিৎকার করে উঠলো, ‘বিশ্বাসঘাতক! তোকে এই জন্য পুষেছিলাম?’
ভৈরব গলার স্বর কঠিন করে বললো, ‘বিশ্বাসঘাতক আমি না তুমি ? আমার নাম পুলিশে কেস ঝুলিয়ে তোমরা পালাবার মতলব করেছিলে সব টাকা কড়ি নিয়ে। আমায় অনুব্রতবাবু সব বলেছেন। আজকের পুলিসের এই রেডের জন্য আমিই ওদের সাহায্য করি। কখন কোথায় ট্রাক যাবে তার সব খবর আমিই দিই। আমায় তোমাদের কিচ্ছু জানতে দিইনি। কলকাতা থেকে আমি ওদের নিয়ে আসি। গোগোলের মা আমার সাথেই ট্রাকে ছিল। আর এই ঘর আমিই চিনিয়ে আনি।’
নীলমনি এবার একটা অদ্ভুত কথা বললো।
‘সবই তো বুঝলাম। কিন্তু আমার বিরুদ্ধে প্রমাণ কী ?আমি যদি বলি তোকে আমি চিনি না।’
এবার রাগিণীর পালা। তার শুকনো মুখে হাসি ফিরে এসেছে। সে ব্যঙ্গ করে বললো, ‘প্রমাণ তো আমার কাছে।’ এই বলে সে ব্যাগের ভেতর থেকে তার মোবাইলটা বের করে একটা বোতাম টিপতেই শোনা গেলো একটু আগে ঘরের ভেতর নীলমনি আর গোগোলের কথোপকথন।
গোগোল মাথায় হাত দিয়ে মাটিতে বসে পড়েছে। নীলমনির মুখ বিবর্ণ। অনুব্রতর ইশারায় ঘরে ঢুকে এলো পুলিশ বাহিনী। গোগোল আর নীলমনির হাতে হাতকড়া লাগিয়ে নিয়ে গেলো। ভৈরব আর ছন্দাও গ্রেপ্তার হলো কিন্তু পুলিশকে সাহায্য করার জন্য তাদের সাজা কম হবে। রাগিণী সাগরময়কে নিয়ে বাইরে এসে দেখলো সুখময়, সুধাময়, অনির্বান সবাই এসেছে। বৃষ্টি ধরেছে। এখন ঝিরঝির করে পড়ছে।
প্রিজন ভ্যানে ওঠার আগে ছন্দা সাগরময়ের কাছে ক্ষমা চাইলো। ছোট ভাইকে পেয়ে তখন বড়ো দুই ভাই আনন্দে আত্মহারা। রাগিণী ছন্দাকে বললো, ‘কাকিমনি বিশ্বাস করো তোমার ওপর আমার আর কোনো রাগ বা অভিমান নেই। অনুতাপের আগুনে দগ্ধে তুমি এখন শুদ্ধ হয়েছো। আমি জানি গোগোলের হয়ত জেল হবে। কিন্তু যখন ও ফিরে আসবে তখন ও একজন অন্য মানুষ হয়ে ফিরবে। আমরা আবার ওকে আপন করে নেবো।’ গোগোলের মাথায় হাত রাখলো রাগিণী। গোগোলের চোখের কোণে জল চিকচিক করে উঠলো।
প্রিজন ভ্যানটা বেড়িয়ে গেলে অনুব্রত সুখময়কে গিয়ে বললো, ‘আর একজনকে গ্রেপ্তার করা বাকি আছে। যদি আপনি অনুমতি দেন তাহলে আমি আপনার মেয়ে রাগিণীকে চির জীবনের মতো গ্রেপ্তার করতে চাই। আমার স্ত্রী হবার যাবজ্জীবন সাজা নিতে ওরও বোধহয় আপত্তি হবে না।’
সুখময় মেয়ের দিকে একটা কৌতুক মেশানো দৃষ্টি দিয়ে বললো, ‘কি রে গ্রেপ্তারের আদেশ দিয়ে দেব?’
রাগিণী লজ্জায় মুখ নীচু করে বললো, ‘জানি না। যা ইচ্ছে তাই করো।’
অনির্বান এতক্ষণ সব দেখে এবার মুখ খুললো। দিদির কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে চাপা গলায় বললো, ‘তোদের এই ব্যাপারটা নিয়ে একটা দারুণ সিনেমা হয় কিন্তু। ভাবছি আমিই বানাবো সিনেমাটা।’
সুধাময় ছেলের কথায় হেসে বললো, ‘কথাটা মন্দ বলিসনি অনি। তা কী নাম দিবি সিনেমাটার?’
অনির্বান বিড় বিড় করে বললো, ‘অনুব্রত আর রাগিণীর গল্প। কী নাম দেওয়া যায়? কী নাম দেওয়া যায়?’
তারপরেই ওর চোখে একটা ঝিলিক খেলে গেলো। একটা তুড়ি মেরে ইউরেকার ভঙ্গিতে বললো, ‘পেয়ে গেছি!’
সবাই প্রায় সমস্বরে জিগেস বলে উঠলো ‘কী?’
অনির্বান একটা গর্বিত হাসি হেসে একদিকে অনুব্রত আর আর একদিকে রাগিণীকে নিয়ে মুচকি হেসে বললো, ‘অনুরাগিণী!’

শেষ

Comments are closed.