আর্নল্ড সোয়ারজেনেগার, হাভানা সিগার, বিলাসবহুল পোর্শে এবং ভবানীপুরের আটপৌড়ে রোয়াক। যোগসূত্র খুঁজতে বসলে তাবড় বুদ্ধিমানও নিশ্চিত বমকে যাবেন। বুদ্ধির গোড়ায় ধোঁয়া দিয়ে পাড়ার ছেলে ফেলু মিত্তিরও কি পারবেন যোগ খুঁজে দিতে? কিন্তু মিল একটা আছে। প্রবল, জবর সে যোগ।
রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর নাম তখনও জ্যোতি বসু। নিউইয়র্কে বহাল তবিয়তে দাঁড়িয়ে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার। কলকাতায় সদ্য পা রেখেছে ইন্টারনেট। ডায়াল-আপ কানেকশনের বিশ্ব সেই যে বাঙালির বেডরুমে উঁকি দিল, জগতের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বদলে গেল চিরচেনা কলকাতাটাও। ভবানীপুরে জন্মানো ব্যতিক্রমী ছেলেটা সেই সময়ে দাঁড়িয়েই স্বপ্ন দেখেছিল উপরোক্ত এই যোগসূত্রের। স্বপ্ন বাঙালি মাত্রই দেখে। স্বপ্নের মায়াজাল বোনা বাঙালির অস্থিমজ্জায় বহমান বটে, কিন্তু আসল প্রশ্নটা হল, সেই স্বপ্নের পিছনে তাড়া করে ক’জন? তাড়া করলেও সেই স্বপ্ন ছোঁয়ার মত দুঃসাহস ক’জনেরই বা আছে? ব্যতিক্রমী বলার কারণও এটাই। ভবানীপুরের আগমার্কা রোয়াকে আর পাঁচজনের সঙ্গে আড্ডার ফাঁকে যে স্বপ্ন দেখার শুরু, তাকে বুক দিয়ে আগলে রেখে স্বপ্নপূরণ করাটাও এক স্বপ্নসম উত্তরণের রোমহর্ষক অবাঙালিসুলভ কাহিনি। এই স্বপ্নপূরণের পথেই কোথাও এক সূত্রে গাঁথা হয়ে যায় আর্নল্ড সোয়ারজেনেগার থেকে পোর্শে। এ সংযোগ ধোঁয়ার। বাঙালির চিরকালীন রোমান্টিসিজম, সিগার-বাহিত হয়ে গোটা দুনিয়ায় খোশবাই ছড়াচ্ছে, এ যেন প্রকৃত অর্থেই সিগার-নামা হওয়ার যোগ্য।
সিগার, শব্দটির সঙ্গে বাঙালির পরিচয় আজকের নয়। যদিও বছর বছর ক্যালেন্ডারের পাতা বদলালেও মহার্ঘ সেই আস্বাদ বারোয়ারি হয়ে ওঠেনি আজও। হাভানা-কিউবা-চে কিংবা চার্চিলকে বাঙালি উঁকি মেরে দেখেছে, পর্দায় সিগার চর্চিত ছবি-পাহাড়ি-কমল কিংবা হালফিলের প্রণববাবুর সিগার শোভিত ছবিও আত্মস্থ করেছে আমবাঙালি, কিন্তু ও রস গ্রহণে আজও ঠোঁট ও কাপের ব্যবধান। সিগারের আস্বাদ নেওয়ার চেষ্টা তা বলে কম হয়নি। সাগরপাড় থেকে জাহাজে করে মহার্ঘ সব সিগার এসে ভিড়েছে গঙ্গা কিংবা আরব সাগর পাড়ে। কিন্তু খাস বিলিতি সিগারের আকাশছোঁয়া দাম বরাবরই দু আঙুলের ফাঁকে গাঢ় বাদামি জাদুদণ্ড গোঁজা থেকে আমবাঙালিকে নিরস্ত করে এসেছে। না পাওয়ার বেদনা যত বেড়েছে, বাঙালি পাল্লা দিয়ে বাড়িয়েছে সিগার নিয়ে তার রোমান্টিসিজম। পরিস্থিতি হয়ত আজও এমনই থাকত, যদি না ভবানীপুরের সেই ছেলেটি স্বপ্ন দেখা শুরু করতেন।
সিগার নিয়ে বাঙালির সিরিয়াস ভেঞ্চারের সেই শুরু। আর্নল্ড সোয়ারজেনেগার থেকে দ্য গ্রেট ব্রিটিশ সিগার মার্চেন্ট জেজে ফক্স লন্ডন, দুনিয়ার তামাম সিগার-রসিকদের ভাঁড়ারে যে আন্দ্রে গার্সিয়ার গর্বিত উপস্থিতি, সেই ভুবনমোহিনী ব্র্যান্ডের স্রষ্টা অভীক রায়, এই শহরেই সন্তান।
সিগার দুনিয়ায় বিজয় পতাকা ওড়ানোর ব্যাপারটা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রিত হয় আমেরিকা ও ইউরোপের গুটিকয় দেশ থেকে। ভারত-যোগের প্রশ্নই নেই। এদেশে প্রচুর তামাক উৎপাদন হয় বটে, কিন্তু সেই তামাকে সিগার তৈরি হয় না। সিগারের তামাক আসে লাতিন আমেরিকার দেশ কিউবা, ডমিনিকান রিপাবলিক, ক্যারিবিয়ান আইল্যান্ডস, হাইতি, হন্ডুরাস, ইকুয়েডর, নিকারাগুয়া, গুয়েতেমালা, পানামা থেকে। তবে ইতালি, স্পেনের ভূমধ্যসাগরীয় দেশসমূহ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ইন্দোনেশিয়া-ফিলিপিন্সেও উৎকৃষ্ট তামাকের চাষ হয়।
সিগারের জন্মবৃত্তান্ত নিয়ে কথা হবে অন্যত্র কিন্তু একটা কথা না বললেই নয়। কলম্বাস নামটির সঙ্গে যেমন আমেরিকার নাম অবিচ্ছেদ্য, ঠিক তেমনই পর্যটক ক্রিস্টোফার কলম্বাসের হাত ধরেই ইউরোপের কুলীন সমাজে ঠাঁই পায় সিগারও। অবাক হলেন? ১৪৯২ সাল। কলম্বাসের জাহাজ তখন নোঙর ফেলেছে তৎকালীন হিসপানিওলা দ্বীপপুঞ্জ যা বর্তমানে হাইতি ও ডমিনিকান রিপাবলিক হিসেবে স্বীকৃত। শোনা যায়, কলম্বাসের তিন সহকর্মী রডরিগো ডি জেরেজ, হেক্টর ফুয়েনতেস ও লুইস ডি টোরেস নাকি সেই মাহেন্দ্রক্ষণেই প্রথম আস্বাদ গ্রহণ করেন সিগারের। বাকিটা ইতিহাস।
ইতিহাস ফেলে এবার ফেরা যাক বর্তমানের উঠোনে। ভবানীপুরের বাসিন্দা, অঙ্কের অধ্যাপকের ছেলে অভীক ছোট থেকেই ভিন্নতার সন্ধানে ঘোরা এক মানুষ। সকলে যা করে, চোখ বুজে কেবল তাই করে যেতে প্রবল আপত্তি। সকলেই পড়াশোনা করে ভালো চাকরি বাগায়, এই মানসিকতায় তাঁর মহা আপত্তি, একেবারে গোড়া থেকেই। পরিস্কার মাথার অভিক প্রথাগত পড়াশোনায় সামনের সারির হলেও চাকরি করতে এসে প্রথম সে বুঝতে পারে এ লাইন তাঁর জন্য নয়। দশটা-পাঁচটার চাকরি করা তাঁর ধাতে সইবে না। তাঁর প্রয়োজন এমন কোনও কর্মক্ষেত্রের, যেখানে চ্যালেঞ্জ নেওয়ার স্বাধীনতা থাকবে, থাকবে চ্যালেঞ্জ জেতার স্পর্ধা। প্রথম চাকরি এক সুতোকলে। সেটা নয়ের দশকের শুরু। রিষড়ার কারখানা থেকে যে সুতো পাড়ি দেয় সুদূর মার্কিন মুল্লুকে। রুবি মোড়ে অফিস। ক্লায়েন্টরা সকলেই আমেরিকান, তাই অফিসের কাজ শুরু হয় সেখানকার সময় মেনে। অর্থাৎ, অফিসে গিয়ে স্রেফ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বসে থাকা। ফাঁকা সময়টা কী করবেন অভীক? সন্ধান দিল ইন্টারনেট। সদ্য তরুণ অভীক অবাক হয়েছিলেন ইন্টারনেটের ব্যবহার ও উপযোগিতায়। সেই থেকে অভীকের সঙ্গী হল আন্তর্জালের ব্রহ্মাণ্ড। অফিসে গিয়ে আমেরিকান ক্লায়েন্টদের সামলানোর পাশাপাশি ইন্টারনেটে অবিরাম সুলুকসন্ধান চলতে লাগল। ফোর জির যুগে দাঁড়িয়ে আজ আর ভাবাই যায় না ডায়াল আপ যুগে এই কলকাতায় কীভাবে চলত নেট-ব্যবস্থা। প্রায় ঘুমন্ত ডায়াল-আপ কানেকশনের সেই দিনগুলো অভীকের কাছে ছিল কার্যত পরীক্ষা। সাতসকালে অফিসে ঢুকেই বসে পড়া নেটের দুনিয়ায়, তারপর শুরু গবেষণার পালা। কী এমন কাজ যা একাধারে চ্যালেঞ্জিং আবার চাকরির সমতুল্যও বটে? শয়নে-স্বপনে-জাগরণে তখন একটাই চিন্তা অভীকের মাথায়, কী এমন কাজ… ক্লান্তি কাটাতে সিগারেটের আশ্রয়, ফের ফিরে যাওয়া ডেস্কটপের দুনিয়ায়। এভাবেই একদিন মাথায় এল, আচ্ছা, ধোঁয়া নিয়ে কিছু ভাবলে কেমন হয়? যেই না ভাবা অমনি শুরু গবেষণা। ইন্টারনেট দেখালো ভারতে সিগারের চাহিদা ক্রমেই বাড়লেও সেভাবে সিগার তৈরি হয় না। যা তৈরি হয় তা মুখে দেওয়ারও অযোগ্য, স্বভাবতই কাটতিও কম। আচ্ছা, বিশ্বমানের সিগার তৈরি করলে কেমন হয়? হাতে পাঁজি-কম্পিউটার, এবার শুরু সিগার নিয়ে গবেষণা। মাসখানেকের মধ্যেই সিগার দুনিয়ার যাবতীয় তথ্য ঠোটস্থ করে ফেললেন অভীক। বুঝলেন, দুনিয়ার সেরাদের সঙ্গে পাল্লা দিতে গেলে মানের সঙ্গে আপস নৈব নৈব চ। তাই শিখতে যদি হয়, বিশ্বের সেরাদের কাছ থেকে শেখাটাই বুদ্ধিমানের কাজ। খ্যাতনামা সিগার প্রস্তুতকারক সংস্থা থম্পসন সিগারকে মেল করলেন অভীক। আবেদন, সিগারের খুঁটিনাটি জানতে চাই। উত্তরও এল পত্রপাঠ। শুরু হল সিগার দুনিয়ায় ভারতের জয়যাত্রা।
এরপরের অধ্যায়কে ভিনি-ভিডি-ভিসি বললে অত্যুক্তি হয় না। তবে শুধু সিগারেই অবশ্য আটকে থাকলেন না অভীক। সিগারের পাশাপাশি সিগার কেস দিয়েও বিশ্ব বাজার মাত করলেন তিনি। আন্দ্রে গার্সিয়া তর্কাতিতভাবে হয়ে উঠল দুনিয়ার সেরা সিগার কেস ব্র্যান্ড। কেমন সেই উত্তরণের কাহিনী? পরের সংখ্যায়…
(দ্বিতীয় পর্ব আগামী রবিবার)
Comments are closed.